রক্ত আমাদের দেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। রক্তের মাধ্যমেই আমাদের দেহ সচল থাকে। আমরা যে খাদ্য খাই বা যে পুষ্টি পাই তা আমাদের দেহের সকল অঙ্গে পৌঁছে দেয় এই রক্ত। এর মাধ্যমেই আমাদের ফুসফুস পর্যন্ত অক্সিজেনের মতো উপাদান পৌঁছায়।
বিভিন্ন দুরারোগ্যের চিকিৎসায় বা দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হলে বা শৈল্যচিকিৎসায় রক্ত নেয়ার প্রয়োজন হয়। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে রক্ত দেহের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। রক্ত দেওয়া বা নেওয়ার পূর্বে আমাদের বেশ কিছু দরকারি তথ্য জানা থাকা দরকার । আজ আমরা দেহের এই গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটির বিষয়েই বিভিন্ন তথ্য জানার চেষ্টা করবো ।
রক্তের গ্রুপ
রক্তের রয়েছে বিভিন্ন গ্রুপ। বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন রকম রক্তের গ্রুপ হতে পারে। রক্তের গ্রুপগুলো হচ্ছে: A+, A-, B+, B-, AB+, AB-, O+, O-। এগুলোই হল মূলত রক্তের গ্রুপ। এসব গ্রুপ রক্তদানের ক্ষেত্রে বা রোগীর শরীরে রক্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।
এ সকল গ্রুপের মধ্যে O গ্রুপের রক্ত যাদের তাদের সর্বজনীন দাতা বা Universal Donor বলা হয়। কারণ, এই গ্রুপ অন্য যেকোনো গ্রুপকে রক্ত দিতে পারে। অপরদিকে, AB গ্রুপকে সর্বজনীন গ্রহীতা বলা হয়। কারণ, এ গ্রুপ যেকোনো গ্রুপের কাছ থেকেই রক্ত নিতে পারে।
রক্ত দেয়া বা নেয়ার ক্ষেত্রে গ্রুপ কি গুরুত্বপূর্ণ?
রক্ত দেওয়া কিংবা নেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হল রক্তের গ্রুপ। সকল গ্রুপ থেকে সকল গ্রুপ রক্ত নিতে পারে না। এক্ষেত্রে জানা জরুরী কোন গ্রুপ কোন গ্রুপকে রক্ত দিতে পারে কিংবা কোন গ্রুপ থেকে কোন গ্রুপ রক্ত নিতে পারে। আসুন জেনে নিই এ বিষয়ে।
রক্তের গ্রুপ | রক্ত দিতে পারবেন | রক্ত নিতে পারবেন |
A+ | A+ AB+ | A+ A- O+ O- |
A- | A+ A- AB+ AB- | A- O- |
AB+ | AB+ | সকল গ্রুপ |
AB- | AB+ AB- | A- B- O- AB- |
B+ | B+ AB+ | B+ B- O+ O- |
B- | B+ B- AB+ AB- | B- O- |
O+ | A+ B+ AB+ O+ | O+ O- |
O- | সকল গ্রুপ | O- |
রক্ত দেয়া বা নেয়ার সময় করনীয়

রক্ত দেওয়া বা নেওয়ার আগে কিছু বিষয় মাথায় রাখা প্রয়োজন। এ সকল বিষয় মাথায় না রাখলে হতে পারে বিভিন্ন সমস্যা। রক্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে যে বিষয় খেয়াল রাখবেন:
- অপরিচিত মানুষের কাছ থেকে রক্ত না নেওয়া উচিৎ। কারণ অপরিচিত মানুষে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা থাকলেও তা থেকে যায় অজ্ঞাত।
- যার কাছ থেকে রক্ত নিবেন তার যেনো কোনো শারীরিক সমস্যা না থাকে সে বিষয়ে খেয়াল রাখা।
- ইনসুলিন গ্রহণকারীর কাছ থেকে রক্ত না নেওয়া।
রক্তদানকারী যেসব বিষয় মাথায় রাখবেন:
- একদম খালি পেটে রক্ত দেওয়া উচিৎ না আবার একদম ভরা পেটেও দেওয়া উচিৎ না। হালকা খাবার খেয়ে আধা ঘন্টা থেকে এক ঘন্টা পর রক্তদান করা উচিৎ।
- রক্তদানের আগে বেশি পরিমাণ পানি পান করুন।
- তিন মাসের মধ্যে একাধিকবার রক্ত দিবেন না।
- রক্তদাতার ধূমপানের অভ্যাস থাকলে রক্তদানের দিন ধূমপান থেকে বিরত থাকুন।
রক্ত দানের উপকারিতা
স্বেচ্ছায় নিজের রক্ত অন্যকে দেওয়াই হল রক্তদান। রক্তদানে ক্ষতি হয় এমন ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে অনেকের। আসলে রক্তদানে ক্ষতি নেই। বরং এতে অন্যের জীবন বাঁচার মতো উপকার যেমন হয়, তেমনি নিজেরও অনেক উপকার হয়। রক্তদান করতে হলে কমপক্ষে ১৮ বছর বয়সী হতে হয়। ১৮ বছর বয়সের নিচে কারও রক্ত দান করা উচিৎ নয়। প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর রক্ত দান করা যায়। রক্তদানের যে সকল উপকারিতা রয়েছে আসুন সেগুলো জেনে নিই।
- নিয়মিত রক্ত দিলে ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে।
- বছরে কমপক্ষে তিন বার রক্ত দিলে দেহে নতুন লোহিত রক্তকণিকা উৎপাদন হয়। এতে করে অস্থিমজ্জা সক্রিয় থাকে এবং রক্তস্বল্পতা পূরণ হয় খুব দ্রুতই।
- নিয়মিত রক্ত দিলে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে। এতে করে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমে।
- রক্ত দিলে ক্যালরি খরচ হয়। এর ফলে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে। পাশাপাশি এটি রক্তচাপও নিয়ন্ত্রণ করে। ওজন কমার ফলে বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি কমে যায়।
- নিয়মিত রক্তদানে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তাই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে নিয়মিত রক্ত দিন। এতে অন্যের পাশাপাশি নিজেরও উপকার।
- রক্তদান শরীরের ভারসাম্য ঠিক রাখতে সাহায্য করে। ফলে শরীরে সহজে রোগ হয় না বা শরীরের অবসাদ জমা হয় না। এক্ষেত্রে রক্তদান বেশ উপকারী।
রক্তদান করলে উপরিউক্ত উপকারসমূহ আপনি পাবেন। এতে করে আপনার উপকার হবে। আর সবচেয়ে বড় উপকারটি হয় অন্য একজন মানুষের জীবন বাঁচানো যায় এর মাধ্যমে। তাই আসুন রক্তদানে উৎসাহী হই।
আরও জানতে চাইঃ
ক) রক্ত কি?
রক্ত মূলত কঠিন ও তরল পদার্থের সমন্বয়ে গঠিত একপ্রকার প্রাকৃতিক কলয়েড। দেহের মধ্যে অস্বচ্ছ যে লাল পদার্থ আমাদের দেহের শিরা বা ধমনীর মধ্য দিয়ে বাহিত হয়ে দেহের সকল টিস্যু বা কোষে অক্সিজেন ও খাবার পৌঁছে দেয় তাই হল রক্ত। রক্তের রঙ লাল এটা আমরা সবাই জানি। এটি আমাদের দেহের বিভিন্ন গ্রন্থি হতে নিঃসরিত হরমোন দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে পৌঁছে দেয়। এর ফলে সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কর্মক্ষমতা নিশ্চিত হয়।
খ) রক্ত কিভাবে তৈরি হয়?
অস্থিমজ্জা বা বোনমেরো থেকে মূলত রক্ত তৈরি হয়। দেহের হাড়কে যদি টুকরো করা যায় তখন এর মধ্যে এক ধরনের জালিকার মতো লাল পদার্থ পাওয়া যায়। এটিই অস্থিমজ্জা। এখান থেকেই রক্ত তৈরি হয়। তবে মায়ের পেটে থাকা ভ্রূণের ক্ষেত্রে লিভার থেকে রক্ত তৈরি হয়।
গ) ডায়াবেটিস রোগীরা কি রক্ত দিতে পারে?
রক্তদান একটি মহৎ কাজ। এতে অন্যের পাশাপাশি নিজেরও যে উপকার হয় তা আমরা ইতোমধ্যেই জেনে গেছি। তবে যাদের ডায়াবেটিস আছে তারা কি রক্ত দিতে পারেন? এ বিষয়েই এখন আলোচনা করবো।
ডায়াবেটিস রোগীরা যদি রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন তবে তারা কোনো সমস্যা ছাড়াই রক্ত দিতে পারেন। টাইপ ওয়ান ও টাইপ টু উভয় ক্ষেত্রেই শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রেখে ডায়াবেটিস রোগীরা রক্ত দিতে পারবেন। তবে রোগী যদি পূর্বে বেভিন ইনসুলিন নিয়ে থাকেন সেক্ষেত্রে রক্ত দিতে পারবেন না।
তাছাড়া রক্ত দেওয়ার পূর্বে অবশ্যই পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম, পুষ্টিসম্পন্ন খাবার খাওয়া ও বিশ্রাম জরুরী। এছাড়া রক্তদানের পরও খাবার, ঘুম ও বিশ্রাম জরুরী, পাশাপাশি রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করা ও চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিৎ।
ঘ) রক্ত লাল হয় কেন?
রক্তে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের উপাদান। এ সকল উপাদানের মধ্যে অন্যতম হল রক্তকণিকা, রক্তরস, হিমোগ্লোবিন ইত্যাদি। এর মধ্যে রক্তে থাকা হিমোগ্লোবিন এর কারণেই মূলত রক্তের রঙ লাল হয়। এই হিমোগ্লোবিনই রক্তের লাল রঙের জন্য দায়ী।
ঙ) রক্তের গ্রুপ কি পরিবর্তন হয়?
রক্তের গ্রুপ পরিবর্তন হয় কি না এটি নিয়ে মানুষের মনে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। এর উত্তর হল রক্তের গ্রুপ আসলে পরিবর্তন হয় না। তাহলে অনেক সময় রক্ত পরীক্ষায় একেকবার একেকরকম ফল আসে কেন? এক্ষেত্রে মূলত রক্ত পরীক্ষায় ভুল হওয়ার কারণেই এমন হয়।
তবে সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা অনুযায়ী, ক্যান্সার বা অটোমেন ডিজিস হলে এ সকল রোগের প্রভাবে রক্তের গ্রুপ পরিবর্তন হতে পারে। যদিও এর সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
এছাড়াও বোনমেরো বা অস্থিমজ্জা ট্রান্সপ্লান্ট করলে রক্তের গ্রুপ পরিবর্তন হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে রোগীকে A/B/AB গ্রুপের রক্তের অধিকারী হতে হবে এবং রক্তদাতাকে O গ্রুপের রক্তের অধিকারী হতে হবে।
রক্তের গ্রুপ পরিবর্তন হয় না বললেই চলে। এর সম্ভাবনা ৬০০ কোটিতে একজনের ক্ষেত্রে এমন হতে পারে। অর্থাৎ, রক্তের গ্রুপ পরিবর্তন হয় না বললেই চলে। কারণ ৬০০ কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র একজনের সম্ভাবনা মানে একদমই ক্ষীণতর সম্ভাবনা।
পরিশেষে-
রক্ত আমাদের দেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। আমাদের দেহকে সচল রাখতে মূল কাজ করে এই রক্ত। এর মাধ্যমেই সারা দেহে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান, হরমোন ইত্যাদি পৌঁছায়। সারা দেহে খাদ্য ও অক্সিজেন সরবরাহ করে রক্ত আমাদের দেহের সকল কার্যক্রম ঠিক রাখে।
বোঝাই যাচ্ছে রক্তের গুরুত্ব কতটা। তাই কারও রক্ত লাগলে পিছ পা না হয়ে রক্তদানে এগিয়ে আসা উচিৎ। কারণ, রক্তের অভাবে মানুষ সহজেই মারা যেতে পারে। তাই রক্তদান করে অন্যের ও নিজের উভয়েরই উপকার করার সুযোগ থাকায়, সে সুযোগ কাজে লাগানো উচিৎ আমাদের সকলেরই।
তথ্যসূত্রঃ