আলকুশি বীজের উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম


আলকুশি বীজ অনেকটা শিমের মত। ইংরেজি নাম Velvet beans এবং বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় Mucuna Prurien বলা হয়। এটি প্রোটিন, ফ্যাটি অ্যাসিড, স্টার্চ এবং অ্যামিনো অ্যাসিডের একটি সমৃদ্ধ উৎস। যদিও এ উদ্ভিদের সমস্ত অংশই ঔষধি গুণাবলীর অধিকারী। একাধিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে জানা যায় যে আলকুশি বীজের পাউডার বিভিন্ন রোগের ঔষধ হিসেবে প্রাচীন কাল থেকেই ব্যবহার হয়ে আসছে। বাংলায় এই উদ্ভিদটি বিলাই খামচি হিসেবেও পরিচিত। চলুন জেনে নেই আলকুশি বীজের ব্যবহার ও খাওয়ার নিয়ম সমূহ।

১ চামচ (৪গ্রাম) আলকুশি পাউডারের পুষ্টি উপাদান

উপাদানফ্যাটকার্বোহাইড্রেটপ্রোটিনভিটামিন সি
পরিমাণ০.০১ গ্রাম৩.২৪ গ্রাম০.৩৪ গ্রাম১৭ মিগ্রা
 বাটিতে আলকুশি বীজ

আলকুশি বীজের ৫টি উপকারিতা

উদ্বেগ, বিষণ্নতা, আমাশয়, সাপের কামড় এবং বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায় প্রাচীন কাল থেকেই ওষুধ হিসাবে আলকুশি ব্যবহার ব্যবহার হয়ে আসছে। উপরন্তু, আলকুশি বীজের নির্যাস কাশি, ডায়াবেটিস এবং ক্যান্সারের চিকিৎসায়ও সাহায্য করে।

১. মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বৃদ্ধিতেঃ

আলকুশি বীজের সবচেয়ে শক্তিশালী ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট হল লেভোডোপা (এল-ডোপা) নামক একটি অ্যামিনো অ্যাসিড। এটি ডোপামিন বৃদ্ধির জন্য কাজ করে। ডোপামিন একটি নিউরোট্রান্সমিটার যা স্নায়ু সংকেত প্রেরণ করতে সহায়তা করে। আমাদের মেজাজ পরিবর্তন, স্মৃতিশক্তি নিয়ন্ত্রণ, সতর্কতা, একাগ্রতা, সুখ, ইত্যাদির জন্য পর্যাপ্ত ডোপামিন প্রয়োজন হয়। এছাড়াও সেরোটোনিন এবং অ্যাড্রেনালিনের মতো অন্যান্য নিউরোট্রান্সমিটারের সাথে মিলে এটি সংবেদনশীলতা এবং মোটর নিয়ন্ত্রণ, অনিদ্রা, হজম, এবং হরমোন সংশ্লেষণ নিয়ন্ত্রণ করে।

আলকুশি বীজ ন্যুট্রপিক উপাদানে পূর্ণ, যা আপনার মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়াতে পারে। আপনি তাদের জ্ঞান বা স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিকারী হিসাবেও আখ্যা দিতে পারেন। এই উপাদানগুলির মধ্যে রয়েছে পিরাসিটাম এবং অ্যানিরাসিটাম। ডোপামিনের সাথে, তারা আপনার ইন্দ্রিয় এবং চিন্তাভাবনাকে পরিমার্জিত করতে পারে এবং আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য আপনার চিন্তাগুলি পরিষ্কার করতে পারে।

২. অ্যান্টি-পারকিনসন প্রভাবঃ

পারকিনসন্স ডিজিজ (Parkinson’s Disease) স্নায়ুতন্ত্রকে প্রভাবিত করে। ডোপামিনের অভাব এজন্য দায়ী।  এছাড়াও, পারকিনসন রোগের লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে পেশীর অনমনীয়তা, কাঁপুনি এবং সীমিত নড়াচড়া।

পারকিনসন্সের প্রচলিত ওষুধ তেমন কার্যকর নয়। কিন্তু আলকুশি বীজ ডোপামিনের মাত্রা বাড়াতে পারে। এর এন্টিডিপ্রেসেন্ট প্রভাবও রয়েছে। সেরোটোনিন এবং অ্যাড্রেনালিনের সাথে মিলিত ডোপামিন পারকিনসনের লক্ষণগুলো কমিয়ে আনতে সাহায্য করতে পারে।

৩. যৌনস্বাস্থ্য সুরক্ষায়ঃ

আলকুশি বীজ প্রজনন সমস্যা উন্নত করতে পারে। এতে বিভিন্ন অ্যালকালয়েড থাকে, যা টেস্টোস্টেরন সংশ্লেষণকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে। ফলস্বরূপ, এটি আপনার শুক্রাণুর সংখ্যা, গতিশীলতা এবং কার্যক্ষমতা বাড়াতে পারে। উপরন্তু, টেস্টোস্টেরন উন্নতি স্বাস্থ্যকর শুক্রাণুর আরও ভাল সংশ্লেষণে সাহায্য করতে পারে।

বন্ধ্যাত্ব দূরীকরণ

কম টেস্টোস্টেরন, অস্বাভাবিক ফলিকল-স্টিমুলেটিং হরমোন (FSH), এবং প্রোল্যাকটিন বন্ধ্যাত্বের কারণ। আলকুশি বীজ গ্রহণ FSH এবং প্রোল্যাকটিন (Prolactin) কমাতে পারে. অতএব, এটি মহিলাদের বন্ধ্যাত্ব দূর করতে পারে।

৫. ক্যান্সার রোধ

নিয়মিত সুপারিশকৃত পরিমাণে আলকুশি বীজ গ্রহণ ক্যান্সার বিরোধী প্রভাব দেখাতে পারে। এটি আপনার শরীরে গ্লুটাথিয়ন, সুপারঅক্সাইড ডিসমুটেজ এবং ক্যাটালেজের মাত্রা বাড়াতে পারে। এরা শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ফ্রি র‍্যাডিক্যালের আঘাত থেকে আপনার কোষ রক্ষা করতে পারে।

উপরন্তু, এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গুণ কোষের অক্সিডেশন প্রতিরোধ করে। কোষে অক্সিডেশন কোষের প্রয়োজনীয় উপাদানগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। উদাহরণস্বরূপ, এটি কোষের ঝিল্লি, প্রোটিন এবং ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত করে, যার ফলে কোষের কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত হয়। অতএব, আপনার খাদ্যতালিকায় আলকুশি বীজ অন্তর্ভুক্ত করে ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি রোধ এবং সীমাবদ্ধ করতে পারেন।

এছাড়াও, আলকুশি বীজের মিথানল উপাদান টিউমারের বৃদ্ধিও কমাতে পারে।

৫. ডায়াবেটিস প্রতিরোধঃ

আলকুশি বীজের পাউডারে ডি-চিরো-ইনোসিটল নামক একটি উপাদান রয়েছে, যা ইনসুলিনের প্রভাব অনুকরণ করতে পারে এবং রক্তে সুগারের মাত্রা কমাতে সাহায্য করতে পারে। আলকুশিতে levodopa রয়েছে, যা রক্তে শর্করা ও কোলেস্টেরলের স্বাস্থ্যকর মাত্রা বজায় রাখতে সাহায্য করে। ফলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে।

আলকুশি বীজ খাওয়ার উপায়ঃ

সপ্তাহে একবার বা দুবার ১৫-২০ গ্রাম আলকুশি খাওয়া একজন সুস্থ প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য আদর্শ হতে পারে। যাইহোক, প্রতিদিন ৫ গ্রাম দিয়ে শুরু করুন। এই পরিমাণ আপনাকে আপনার শারীরিক সহনশীলতা পরীক্ষা করতে সাহায্য করতে পারে এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনাও কমিয়ে দেয়।

ক) পাউডার হিসেবে

আলকুশি বীজ দুধে শোধন করে শুকিয়ে পাউডার করে নিতে পারেন। এ পাউডার রুটি বানানোর সময় আটার সাথে মিশিয়ে খেতে পারেন। এছাড়াও গরম দুধ বা পানির সাথে মিশিয়ে খেতে পারেন।

খ) বীজ হিসেবে

সিমের বিচির মত করে তরকারি রান্না করেও খাওয়া হয়ে থাকে আলকুশি। তাজা বীজ সিদ্ধ করে সালাদ হিসেবেও খাওয়া যেতে পারে।

গ) ক্যাপসুল হিসেবে

ফুডসাপ্লিমেন্ট হিসেবে আলকুশি বীজের ক্যাপসুল পাওয়া যায়। তবে তা গ্রহনের পূর্বে হাকিম বা ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত।

ঘ) চা এর মত করে

গরম পানিতে দারুচিনি গুঁড়া, চিনি ও আলকুশি পাউডার মিশিয়ে চা এর মত খাওয়া যায়। ১ চামচ আলকুশি পাউডার, ১/২ চামচ দারুচিনি ও ১ চামচ গুর/চিনি গরম পানিতে ২ মিনিট জ্বাল দিয়ে ২ কাপ চা প্রস্তুত করা যায়।

আলকুশির পাতা ও শিকড়ের উপকারিতা

আলকুশি বীজের পাশাপাশি এর পাতা এবং শিকড়ও অনেক উপকারী। এর পাতা বেটে রস ফোঁড়ায় দিলে অচিরেই সেটি ফেটে যায় এবং পুঁজ বের হয়ে আসে। ফলে দ্রুত ব্যাথা উপশম ও নিরাময় হয়। এর শিকড়ের রস জ্বর, সর্দি-কাশি ভালো করে। এছাড়াও, আলকুশি শিকড়ের নরম অংশ মূত্রবর্ধক ও জননাঙ্গের রোগ নিরাময়ে বেশ উপকারী।

আলকুশি বীজের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সমূহ

যাদের সাইকোসিস, নিউরোপ্যাথি, অনিয়মিত হৃদস্পন্দনের চিকিৎসা চলছে তাদের আলকুশি বীজ খাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত।

গর্ভাবস্থায় এই আলকুশি খাওয়া নিরাপদ নাও হতে পারে। আলকুশি বীজে জরায়ু উদ্দীপক প্রভাব থাকে, যার ফলে জরায়ু ফেটে গিয়ে রক্তপাত হতে পারে। এছাড়াও, এটি ভ্রুণের ক্ষতি করতে পারে। ফলস্বরূপ, এটি জন্মগত বিভিন্ন ত্রুটির কারণ হতে পারে। তাই গর্ভবতী মহিলা এবং স্তন্যদানকারী মায়েদের আলকুশি খাওয়া এড়িয়ে চলা উচিত।

লিভারের রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদেরও আলকুশি খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। আলকুশির মধ্যে থাকা লেভোডোপা সিরাম লিভারের রোগকে আরও প্রভাবিত করতে পারে।

অতিরিক্ত আলকুশি সেবনের ফলে উচ্চ মাত্রার এল-ডোপা হতে পারে। ফলস্বরূপ, হ্যালুসিনেশন, বিভ্রান্তি এবং সিজোফ্রেনিয়ার মতো লক্ষণ দেখা দেয়।

আলকুশি বীজে ট্যানিন, ফেনল ইত্যাদি রয়েছে। তাই খাওয়ার আগে আপনার এটি ভালোভাবে শোধন করা উচিত।

পরিশেষে –

ব্যাপক ঔষধি গুণের কারণে আলকুশি বীজ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এর স্বাস্থ্য ও পুষ্টিগুণ অনন্য। উদাহরণস্বরূপ, এগুলি প্রোটিন এবং প্রয়োজনীয় খনিজের একটি সমৃদ্ধ উৎস। ফলস্বরূপ, প্রাচীন এবং আধুনিক ওষুধ তৈরিতে এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। তাই সঠিকভাবে পরিশোধিত আলকুশি বীজ পরিমিত পরিমাণে সেবন করুন।

রেফারেন্স

আরও পড়তে পারেন –

4 Replies to “আলকুশি বীজের উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম”

  1. আমার ফ্যাটিলিভার আছে ,আমি খেতে পারব কিনা ।

  2. পুরুষ বন্ধ্যাত্যের জন্য আলকুশি কতটা কার্যকরী?
    শুক্রাণু কম মাত্র ৫ মিলিয়ন ।
    এক্ষেত্রে আলকুশি কি উপকারী হতে পারে।
    হলে কিভাবে খেতে হবে?
    ধন্যবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.