মিষ্টি কুমড়া আমাদের অতি পরিচিত সবজিগুলোর মধ্যে একটি। বারো মাসই এটি পাওয়া যায়। তাই এটি বারোমাসী সবজি নামে পরিচিত। এটি কাঁচা কিংবা পাঁকা উভয় অবস্থাতেই খাওয়া যায়। কাঁচা অবস্থায় দেখতে সবুজ ও পেঁকে গেলে হালকা সবুজ ও হলুদ রঙের সংমিশ্রণ দেখা যায় এতে। অনেক পুষ্টি সমৃদ্ধ এই সবজিটি হালকা মিষ্টি স্বাদের হয়। নানা উপকারী এই সবজিটি সম্পর্কে আজ আমরা আলোচনা করবো।
মিষ্টি কুমড়া
মিষ্টি কুমড়াকে ইংরেজিতে Sweet gourd বা Pumpkin বলা হয়। আর এর বৈজ্ঞানিক নাম Cucurbita moschata. এটি একটি হালকা মিষ্টি স্বাদের সুস্বাদু সবজি। এতে রয়েছে নানাবিধ পুষ্টি উপাদান। ভিটামিন এ (বিটা-ক্যারোটিন), ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স, ভিটামিন সি এবং ভিটামিন ই, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, আয়রন, জিঙ্ক, ফসফরাস, কপার, ক্যারটিনয়েড এবং অন্যান্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস ইত্যাদির মতো জরুরী ও প্রয়োজনীয় এবং উপকারী সকল পুষ্টি উপাদান রয়েছে এতে। এটি যেমন চরাঞ্চলের পলি মাটিতে চাষ করা যায়, তেমনি বাসা কিংবা বাড়ির ছাদেও এর চাষ করা সম্ভব।
মিষ্টি কুমড়ার পুষ্টিগুণ
মিষ্টি কুমড়ায় নানাবিধ পুষ্টি উপাদান থাকে। এতে ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, জিংক, পটাসিয়াম, ফসফরাস ইত্যাদির মতো নানা উপাদান রয়েছে। প্রতি ১০০ গ্রাম মিষ্টি কুমড়ায় রয়েছে-
পুষ্টি উপাদান | খাদ্যশক্তি | আমিষ | শর্করা | ফাইবার | চর্বি | ভিটামিন-এ | ভিটামিন-সি | পটাশিয়াম | ক্যালসিয়াম | সোডিয়াম | জিংক | লৌহ | ফসফরাস |
পরিমাণ | ২৬ কিলোক্যালরি | ১ গ্রা. | ৫ গ্রা. | ০.৫ গ্রা. | ০.১ গ্রা. | ৭২০০ মাইক্রোগ্রা. | ৯ মি.গ্রা. | ৩৪০ মি.গ্রা. | ২৪ মিগ্রা | ১ মিগ্রা | ০.৩ মিগ্রা | ০.৮ মিগ্রা | ৪৪ মিগ্রা |
মিষ্টি কুমড়া খাওয়ার উপকারিতা
মিষ্টি কুমড়ায় বহু পুষ্টি উপাদান থাকায় এটি আমাদের দেহের অনেক উপকার করে থাকে। তাই বিশেষজ্ঞরা নিয়মিত খাদ্য তালিকায় মিষ্টি কুমড়া রাখার পরামর্শ দেন। কারণ এর রয়েছে অনেক উপকারিতা। আসুন জেনে নিই মিষ্টি কুমড়ার উপকারিতা গুলো।
চোখের উপকারে
এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-এ ও বিটা ক্যারোটিন। এরা উভয়েই আমাদের চোখের জন্য ভালো। তাই এটি খেলে এতে থাকা ভিটামিন-এ আমাদের চোখের রেটিনার বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করে এবং বিটা ক্যারোটিন চোখে ছানি পড়া রোধ করে। ফলে চোখ সুস্থ থাকে। তাই চোখকে সুস্থ রাখতে এটি খেতে পারেন।
ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়
মিষ্টি কুমড়ায় থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ভিটামিন-ই মানুষের দেহের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। পাশাপাশি এটি আলঝেইমার রোগের ঝুঁকিও কমায়। এছাড়াও এতে থাকা ভিটামিন-সি দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং সর্দি, কাশি ইত্যাদির মতো রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
হজমশক্তি বাড়ায়
এটি একটি প্রচুর ফাইবার বা আঁশ যুক্ত খাবার। তাই এটি আপনার হজম শক্তি বাড়াবে। পাশাপাশি ফাইবার যুক্ত হওয়ায় এটি পেটকে অনেকক্ষণ ভরা রাখে। ফলে অন্য খাবার খেতে ইচ্ছা হয় না। তাই ওজন কমাতেও সাহায্য হয়।
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে
মিষ্টি কুমড়ায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম, যা মানুষের দেহের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে দারুণ ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি এতে থাকা ভিটামিন-সি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।
ত্বক ও চুলের যত্নে
ত্বক ও চুলের জন্য এটি খুবই উপকারী একটি খাদ্য। এতে থাকা ভিটামিন-সি চুলকে শক্ত ও মজবুত করে। পাশাপাশি ত্বককেও উজ্জ্বল করে। এছাড়াও এটি ত্বকে বয়স বা বার্ধক্যের ছাপ পড়া প্রতিরোধ করে।
ইমিউনিটি বাড়ায়
মিষ্টি কুমড়ায় রয়েছে জিংক যা দেহের ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে। পাশাপাশি এটি অস্টিওপোরেসিস রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
এছাড়াও এটি গর্ভবতী মায়েদের রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধ করে। ফলে অকালে অপরিপক্ক সন্তান জন্মানোর ঝুঁকি কমে। তাই গর্ভবতী মায়েরা নিশ্চিন্তে এটি খেতে পারেন।
কিডনি, লিভার ও বাতের ব্যথায়
এতে থাকা ফাইবার রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে। পাশাপাশি এই সবজি কিডনি, লিভার ও হৃৎপিন্ডকে সুস্থ রাখে। এছাড়াও বাতের ব্যথার মতো দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা প্রতিরোধেও এটি বেশ কার্যকর।
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে
মিষ্টি কুমড়া খাদ্য হজমে যেমন সাহায্য করে তেমনি কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দূর করতেও এটি সাহায্য করে। পাশাপাশি এটি ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণেও কার্যকর। এছাড়াও এটি পরিপাক নালী থেকে খাদ্য সরবরাহ সঠিক উপায়ে নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করে।
মিষ্টি কুমড়া কীভাবে খাবেন?
মিষ্টি কুমড়া ভাজি
মিষ্টি কুমড়া খাওয়ার একটি অন্যতম জনপ্রিয় পদ্ধতি হল ভাজি করে খাওয়া। এটি খেতেও বেশ সুস্বাদু। মিষ্টি কুমড়ার ভাজি করতে যা যা উপকরণ লাগে:-
- ৪০০ গ্রাম মিষ্টি কুমড়া
- ১টি ছোট (কুচি করা ) পেঁয়াজ
- ৫-৬ টি ( চিরে দিতে হবে ) কাঁচা মরিচ
- ১ চা চামচ কুচি করা রসুন
- ১/২ চা চামচ হলুদের গুঁড়া
- আনুমানিক ৪ টেবিল চামচ তেল
- ১/২ চা চামচ বা আপনার স্বাদ মত লবণ
রেসিপি
খোসা ছাড়িয়ে মিষ্টি কুমড়া টুকরো করে কেটে ভালো করে ধুয়ে নিন। এরপর কড়াই বা ফ্রাই প্যানে ৪ থেকে ৫ চামচ তেল দিয়ে এতে পেঁয়াজ ও রসুন কুচি দিয়ে নরম না হওয়া পর্যন্ত ভাজুন। তারপর পেঁয়াজ ও রসুন নরম হয়ে গেলে মিষ্টি কুমড়া সহ বাকি উপকরণ দিয়ে হালকা করে নাড়তে থাকুন। মিষ্টি কুমড়া সেদ্ধ হয়ে গেলে ভাজি নামিয়ে পরিবেশন করুন।
মিষ্টি কুমড়া ভর্তা
মিষ্টি কুমড়া খাওয়ার আরেকটি জনপ্রিয় উপায় হলো এর ভর্তা করে খাওয়া। আসুন জেনে নিই কি কি উপাদান লাগবে এর ভর্তা করতে:-
- ২ কাপ মিষ্টি কুমড়া
- পরিমাণমতো লবণ
- ২ টেবিল চামচ ধনেপাতা কুঁচি।
- ২ টেবিল চামচ কাঁচা মরিচ কুঁচি
- ৪/১ কাপ পেঁয়াজ কুঁচি
- পরিমাণ মতো সরিষার তেল
রেসিপি
মিষ্টি কুমড়া ভালো করে ধুয়ে, খোসা ছাড়িয়ে কেটে সিদ্ধ করে নিন। এর পর সিদ্ধ মিষ্টি কুমড়ার সাথে অন্য সব উপকরণ দিয়ে ভর্তা মেখে নিন। এবার এটি গরম গরম ভাতের সাথে পরিবেশন করুন।
মিষ্টি কুমড়া ফুল এর উপকারিতা
মিষ্টি কুমড়ার মতো এর ফুলও কিন্তু খাওয়া যায়। আর এই ফুল থেকেও কিন্তু রয়েছে অনেক উপকারিতা। ভাজি করে এই ফুল খাওয়া বেশ জনপ্রিয়। আসুন জেনে নিই এই ফুলের উপকারিতা গুলো।
- এই ফুলে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন-এ। তাই এটি দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।
- প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকায় এই ফুল হজম শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।
- এই ফুলে রয়েছে ভিটামিন-সি। তাই এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে বেশ কার্যকর।
- মিষ্টি কুমড়া ফুলে থাকা ম্যাগনেসিয়াম ডিপ্রেশন বা মানসিক অবসাদ দূর করতে সাহায্য করে।
- এই ফুল ত্বক ও চুলকে উজ্জ্বল করে।
- এই ফুলে রয়েছে প্রচুর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, যা ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক।
মিষ্টি কুমড়া বীজ খাওয়ার উপকারিতা
মিষ্টি কুমড়ার পাশাপাশি এর বীজ ও কিন্তু বেশ উপকারী একটি খাবার। সকালের কিংবা বিকালের নাস্তায় এটি কাঁচাই খেতে পারেন কিংবা এটি দিয়ে কেক, পায়েস কিংবা অন্য খাদ্য তৈরি করে খেতে পারেন। ছোট হলেও এই বীজের কিন্তু অনেক উপকারিতা রয়েছে। ভিটামিন বি, ম্যাগনেশিয়াম, প্রোটিন ও আয়রনের মতো গুরুত্বপূর্ণ সব খাদ্য উপাদান এতে রয়েছে। পুষ্টির দারুণ এক উৎস এই খাবারের উপকারিতা গুলো এবার জেনে নেওয়া যাক।
- কুমড়ার বীজ হার্ট বা হৃৎপিণ্ডকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
- কুমড়ার বীজে রয়েছে সেরোটোনিন। এই সেরোটোনিন স্নায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করতে খুবই কার্যকর। আর স্নায়ু নিয়ন্ত্রণে থাকার ফলে ভালো ঘুমও হয়।
- বাতের ব্যথা কমাতেও এটি বেশ সহায়ক। পাশাপাশি পেশির জ্বালাপোড়া কমাতেও এটি সাহায্য করে।
- এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ও ফাইটোকেমিক্যাল, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। পাশাপাশি এটি ভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনাও কমিয়ে দেয়।
- কুমড়োর বিচিতে থাকা জিংক প্রোটেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
- রক্তে শর্করা বা চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে এটি সাহায্য করে। পাশাপাশি দেহে ইনসুলিনও জোগায়। তাই ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এটি বেশ উপকারী।
- ফাইবার বা আঁশ যুক্ত খাবার হওয়ায় কুমড়োর বিচি ওজন কমাতে সহায়তা করে।
মিষ্টি কুমড়ার অপকারিতা
মিষ্টি কুমড়ার তেমন কোনো অপকারিতা নেই। অপকারিতা বা ক্ষতি না থাকলেও সীমিত পরিমাণেই এটি খাওয়া উচিৎ। কারণ, কোনো খাবারই অতিরিক্ত খাওয়া উচিৎ নয়। তাই এর অপকারিতা না থাকলেও এটি পরিমিত পরিমাণে খাবেন।
উপসংহার
মিষ্টি কুমড়া ও এর বীজ খুবই পুষ্টিকর একটি খাদ্য। সহজেই এটি পাওয়া যায়। পাশাপাশি এটি সারা বছর পাওয়া যায় বলে বছর জুড়েই এটি থেকে পুষ্টি পাওয়া সম্ভব। তাই নিয়মিত এটি খেতে পারেন। এর যেহেতু কোনো অপকারিতা নেই তাই এটি পরিমিত পরিমাণে খেলে এ থেকে দারুণ সব উপকার পাবেন। এতে আপনার শরীর ও স্বাস্থ্য ভালো থাকবে।
তথ্যসূত্রঃ
- https://www.medicalnewstoday.com/articles/279610
- https://www.healthline.com/nutrition/pumpkin
- https://www.webmd.com/diet/ss/slideshow-health-benefits-pumpkin