থাইরয়েড কি? রোগের কারন লক্ষণ ও করনীয়


থাইরয়েড কি ?

থাইরয়েড একটি গ্রন্থি যা আমাদের গলার সামনের দিকে অবস্থান করে এবং শ্বাস নালীকে (trachea) বেষ্টন করে থাকে। দেখতে অনেকটা প্রজাপতির মত আকৃতি যার দুই পাশের বর্ধিত অংশ শ্বাস নালীকে ঘিরে জড়িয়ে থাকে। আমাদের শরীরে ছড়িয়ে থাকা অন্যান্য গ্রন্থির মতই থাইরয়েড একটি গ্রন্থি যা নির্দিষ্ট কিছু তরল তৈরি করে এবং নিঃসরণ করে । এসব তরল শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ  এবং নির্দিষ্ট কিছু কাজে ব্যবহৃত হয় । থাইরয়েড  গ্রন্থি যে হরমোন তৈরি করে তা মানুষের শরীরের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন করার নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে থাকে ।

সুতরাং যখন আপনার শরীরের  থাইরয়েড গ্রন্থি ঠিক মত কাজ করে না , তখন পুরো শরীরে এর প্রভাব দেখা যায় । যদি  কোন কারনে শরীর খুব বেশী  থাইরয়েড হরমোন তৈরি করে তাহলে তাকে বলা হয়  হাইপারথাইরয়েডইজম (hyperthyroidism) । আর যদি শরীর খুব অল্প পরিমান থাইরয়েড হরমোন তৈরি করে তাহলে তাকে বলা হয় হাইপোথাইরয়েডইজম (hypothyroidism) । মনে রাখবেন দুটির যেকোনো একটি হলেই দেরি না করে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এর পরামর্শ গ্রহন করতে হবে , না হলে মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে ।

থাইরয়েড আমাদের শরীরে কি কাজ করে থাকে?

আমাদের শরীরেরকে একটা মেশিন কল্পনা করুন । যার শক্তি উৎপন্ন হয় আমরা যা খেয়ে থাকি তা হজম হয়ে , একে  বলে বিপাক প্রক্রিয়া । এই বিপাক প্রক্রিয়া খাদ্য থেকে শক্তি উৎপন্ন করার কাজটি স্বাভাবিক ভাবে করে থাকে ফলে  এই শক্তি শরীরের অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ব্যাবহার করতে পারে অন্যান্য শরীরবৃত্তীয় কাজে।

থাইরয়েড এই বিপাক প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রন করে থাকে ।একাজে মুলত দুটি নির্দিষ্ট হরমোন ব্যাবহৃত হয় যা থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে নিঃসরিত হয়, প্রথমটি হচ্ছে চারটি আয়ডাইড নিয়ে গঠিত T4 (thyroxine) হরমোন এবং অপরটি তিনটি আয়ডাইড নিয়ে গঠিত T3 (triiodothyronine) । এই দুটি হরমোন শরীরের কোষ গুলোকে বলে দেয় কতটুকু শক্তি প্রতিটি কোষ ব্যাবহার করবে ।

যখন আপনার শরীরের থাইরয়েড গ্রন্থি ঠিকমত কাজ করে , তখন এটি সঠিক মাত্রায় হরমোন তৈরি করে যাতে বিপাক প্রক্রিয়া সঠিক হারে চলতে থাকে । হরমোন গুলো ব্যাবহার হয়ে যাওয়া মাত্র থাইরয়েড আবার নতুন হরমোন তৈরি করে । আর এ সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রন করে থাকে আমাদের শরীরের পিটুইটারি গ্রন্থি ।  পিটুইটারি গ্রন্থি আমাদের মস্তিষ্কের সাথেই অবস্থান করে । পিটুইটারি গ্রন্থি খেয়াল রাখে যে আমাদের রক্তে ঠিক কতটুকু থাইরয়েড হরমোন থাকবে ।

যখন পিটুইটারি গ্রন্থি আবিস্কার করে  শরীরে থাইরয়েড হরমোন কম বা বেশী আছে তখন তার নিজস্ব একটি হরমোন “টি এইচ এস” (thyroid stimulating hormone “TSH”) নিঃসরণ করে । “টি এইচ এস” হরমোন থাইরয়েড এ যায় এবং ঠিক করে দেয় স্বাভাবিক মাত্রা রাখার জন্য আর কতটুকু হরমোন থাইরয়েডকে নিঃসরণ করতে হবে ।

থাইরয়েড সমস্যা জনিত রোগ

মানুষের শরীরের থাইরয়েড গ্রন্থি যে হরমোন তৈরি করে তা রক্তের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গে পৌঁছে গিয়ে শরীরবৃত্তীয় বিভিন্ন কাজ করে থাকে । যখন থাইরয়েড প্রয়োজন মাফিক হরমোন তৈরি না করে, খুব বেশি অথবা খুব অল্প পরিমান হরমোন তৈরি করে , তখনই থাইরয়েড সমস্যা জনিত রোগ সৃষ্টি হয় ।

বিভিন্ন ধরনের থাইরয়েড সমস্যা জনিত রোগ রয়েছে , যেমন-

  • হাইপারথাইরয়েডইজম (hyperthyroidism)
  • হাইপোথাইরয়েডইজম (hypothyroidism)
  • থাইরয়েডিটিস (thyroiditis) এবং
  • হাসিমটোথাইরয়েডিটিস (Hashimoto’s thyroiditis)

থাইরয়েড রোগ তাহলে কি ?

আপনার শরীর যখন সঠিক অনুপাতে থাইরয়েড হরমোন তৈরি করে না তখন থাইরয়েড রোগ হয় । একটি নির্দিষ্ট মাত্রার থাইরয়েড হরমোন শরীরে থাকা আবশ্যক । যখন থাইরয়েড খুব বেশী পরিমান হরমোন তৈরি করে, আপনার শরীর খুব তারাতারি শক্তি খরচ করে ফেলে । একে বলা হয়  হাইপারথাইরয়েডইজম (hyperthyroidism) । এই অবস্থায় শরীর অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে যায় , হৃদস্পন্দন দ্রুততর হয়ে যায় । শরীরের ওজন হ্রাস পায় , এবং নার্ভাস বোধ হয় ।

অপরদিকে যখন থাইরয়েড খুব অল্প পরিমান হরমোন তৈরি করে, তাকে বলে হাইপোথাইরয়েডইজম (hypothyroidism) । যখন আপনার শরীর খুব কম থাইরয়েড হরমোন তৈরি করে তখন শরীরে ক্লান্তিভাব তৈরি হয় , শরীরের ওজন বৃদ্ধি পায় , এমনকি কিছু ক্ষেত্রে শীতল তাপমাত্রা সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে ।

নানা কারনে এই রোগ দুটি হতে পারে । অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় পরিবারের কারো এই রোগ থেকে থাকলে অন্য সদস্যর ও হওয়ার সম্ভবনা থাকে ।

কারা এই রোগে আক্রান্ত হয় ?

যে কারো যেকোনো সময় এই রোগ হতে পারে । পুরুষ , নারী , শিশু , কিশোর , বয়স্ক এমনকি নবজাতকের ও জন্মের সময় (typically hypothyroidism) এই রোগ হতে পারে । বয়স বাড়ার সাথে সাথে বিশেষ করে মহিলাদের এই রোগ হওয়ার ঝুকি রয়েছে।

আমাদের দেশে এই রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রচুর । বিশেষ করে আমাদের দেশে অনেক মহিলারা এই রোগে ভুগে থাকেন।

কারা বেশী ঝুকির মধ্যে রয়েছেন –

  • পরিবারে কেও এই রোগে আক্রান্ত ।
  • টাইপ ১ ডায়াবেটিস এ আক্রান্ত
  • pernicious anemia তে আক্রান্ত ব্যক্তি
  • লুপাস রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি
  • Rheumatoid arthritis  রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি
  • আয়োডিন জাতীয় ওষুধ ( যেমন amiodarone) সেবন করে থাকেন যারা
  • ষাটোর্ধ ব্যক্তি । মূলত মহিলারা বেশী ঝুকিতে থাকেন ।
  • অতিতে থাইরয়েড রোগে ভুগেছেন এমন ব্যক্তি অথবা ক্যান্সার চিকিৎসা করেছেন এমন ব্যক্তি (thyroidectomy or radiation)
থাইরয়েড কি? মহিলার থাইরয়েড গ্রন্থির আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষা করা হচ্ছে

যেসব কারনে থাইরয়েডজনিত রোগ হতে পারেঃ

যে দু ধরনের থাইরয়েড রোগ সচরাচর দেখা যায় তা হল হাইপারথাইরয়েডইজম এবং হাইপোথাইরয়েডইজম । এই দুটি ধরন অন্য কোন রোগের কারনেও হয়ে থাকতে পারে । নিম্নোক্ত কারন গুলো থাইরয়েড রোগ সৃষ্টিতে ভুমিকা রাখতে পারেঃ

যেসব  কারনে হাইপোথাইরয়েডইজম হতে পারেঃ

১. থাইরয়ডিটিস (Thyroiditis)ঃ

থাইরয়েড গ্রন্থি ফুলে যাওয়াকে থাইরয়ডিটিস বলা হয় । এমন হলে রোগীর শরীরে থাইরয়েড উৎপন্ন হওয়ার পরিমান কমিয়ে দেয়।

২. হাসিমটোথাইরয়েডিটিস (Hashimoto’s thyroiditis)ঃ

এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি শরীরে কোন ব্যথা বেদনা অনুভব করেন না । এটি একটি অটো ইমিউন কন্ডিশন যেখানে শরীরের কোষগুলই থাইরয়েডকে আক্রমন করে এবং আক্রান্ত করে । এবং এটি বংশানুক্রমিক ।  

৩. পোস্ট পারটাম থাইরয়েডিটিস( Postpartum thyroiditis)ঃ

শতকরা  ৫% থেকে ৯% প্রসুতি মায়েদের বাচ্চা  জন্মের  পর হতে পারে।  সচরাচর  এটি  অল্প কিছু  সময়ের জন্য হয়ে থাকে। 

৪. আয়ডিন এর অভাবঃ

থাইরয়েড  হরমোন তৈরি  করার কাজে আয়ডিন  ব্যাবহার করে থাকে।  সুতরাং  আয়ডিন এর অভাবে এই রোগ  হতে পারে। 

অকেজো থাইরয়েড গ্রন্থিঃ

কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে  জন্মের পর  থেকেই থাইরয়েড গ্রন্থি ঠিকমতো কাজ করে না। এমন হলে ঠিকমতো  চিকিৎসা শুরু না করা হলে পরবর্তীতে মারাত্মক সমস্যা হতে পারে। এরকারনেই হাস্পাতাল গুলোতে নবজাতকের জন্মের সময় থাইরয়েডের পরিক্ষা করা হয়ে থাকে। 

যেসব  কারনে হাইপারথাইরয়েডইজম হতে পারেঃ

গ্রেভ ডিজিজঃ

যখন থাইরয়েড গ্রন্থি প্রয়োজনের চেয়ে বেশী হরমোন তৈরি করে তখন এই সমস্যা দেখা দেয় ।

নডিউলস এবং গলগণ্ডঃ

থাইরয়েড গ্রন্থি বিষাক্ত নডিউলস তৈরি করে এবং ফুলে গিয়ে গলগণ্ড রোগ সৃষ্টি করে থাকে । 

থাইরয়ডিটিস (Thyroiditis)ঃ

এমতাবস্থায় প্রদাহ হতে পারে আবার না ও হতে পারে । এমন হলে অনেক ক্ষেত্রে  রোগীর শরীরের থাইরয়েড গ্রন্থি এর ভেতর অবস্থিত সকল হরমোন দ্রুত নিঃসরণ করতে থাকে । 

শরীরে মাত্রাতিরিক্ত আয়ডিন থাকাঃ

বস্তুত আয়োডিন থাইরয়েড হরমোন তৈরি করে থাকে । সুতরাং শরীরে যদি খুব বেশি পরিমানে আয়োডিন থাকে তখন এই বাড়তি আয়োডিন প্রয়োজনের চেয়ে বেশী হরমোন তৈরি করে যা বিপদের কারন হয়ে দাড়ায়। হৃদরোগে  ব্যাবহার হওয়া কিছু কিছু ঔষধ এবং কাশির সিরাপে সচরাচর আয়ডিন বেশী মাত্রায় থাকে । 

ডায়াবেটিস এবং থাইরয়েড ঝুকিঃ

কারো ডায়াবেটিস থাকলে তার থাইরয়েড রোগের ঝুকি তুলনামুলক বেশী থাকে ।  বিশেষ করে টাইপ ১ ডায়াবেটিস নিজেই একটি অটোইমিউন ডিসঅর্ডার। সুতরাং আপনার একটি অটোইমিউন ডিসঅর্ডার থাকলে শরীর থাইরয়েড সমস্যার মত অন্যান্য অটোইমিউন ডিসঅর্ডার তৈরি হওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয় । সুতরাং টাইপ ১ ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর এ ব্যাপারে সচেতন থাকা উচিৎ। অপর দিকে টাইপ ২ ডায়াবেটিস  টাইপ ১ এর মত অতটা ঝুকির মধ্যে না থাকলেও , বয়স বাড়ার সাথে সাথে ঝুকি বাড়তে থাকে । সুতরাং ডায়াবেটিস থাকলে অবশ্যই নিয়মিত পরিক্ষার বিকল্প নেই । 

ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর থাইরয়েডজনিত সমস্যা ধরা পরলে নিম্নোক্ত  অভ্যাস আপনাকে সুস্থ থাকতে সহায়তা করবে 

  • পর্যাপ্ত ঘুম
  • নিয়মিত হাল্কা বেয়াম করা 
  • ডায়াবেটিস এর ডায়েট অনুযায়ী খাওয়া 
  • ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী যেকোনো ওষুধ সেবন 
  • চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত সাস্থ পরীক্ষা করা । আরও পড়তে পারেনঃ ডায়াবেটিস কমানোর উপায়

থাইরয়েড রোগের লক্ষণঃ

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে থাইরয়েড এর লক্ষন সমুহ অন্যান্য কিছু রোগের লক্ষনের সাথে মিলে যায় । বয়সের সাথে সাথে মানুষের কিছু পরিবর্তনের সাথেও এর লক্ষণ সমুহের মিল পাওয়া যায় ।  

হাইপারথাইরয়েডইজম (hyperthyroidism) এর কিছু লক্ষণ নিম্নরূপঃ

  • দুশ্চিন্তা , নারভাসনেস 
  • ঘুমের সমস্যা হয় 
  • ওজন কমে যায় 
  • থাইরয়েড গ্রন্থি ফুলে যাওয়া 
  • মাংসপেশি দুর্বল হয়ে যাওয়া 
  • মহিলাদের পিরিয়ড এ সমস্যা দেখা দেওয়া 
  • অধিক ঠাণ্ডা বা তাপমাত্রার পরিবর্তনে সমস্যা হওয়া 
  • দৃষ্টি শক্তি দুর্বল হয়ে যাওয়া  এবং চোখে সমস্যা হওয়া 

হাইপোথাইরয়েডইজম (hypothyroidism) এর কিছু লক্ষণঃ 

  • ক্লান্তিভাব 
  • ওজন বেড়ে যাওয়া 
  • বিস্মরণ 
  • মহিলাদের পিরিয়ড এ সমস্যা দেখা দেয় । 
  • শুষ্ক ও রুক্ষ চুল 
  • গলার আওয়াজ ভেঙ্গে যাওয়া । 
  • ঠাণ্ডা তাপমাত্রা সহ্য না হওয়া 

উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা জানলাম থাইরয়েড কি? এর রোগ, লক্ষণ ও আমাদের করনীয় কি। সুতরাং লক্ষণগুলো প্রকাশ পেলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহন করতে হবে । মনে রাখবেন থাইরয়েড এর রোগ অনেকসময় দীর্ঘদিন চিকিৎসা করতে হয় । এ সময় ডাক্তারের পরামর্শ এবং নিয়মিত ওষুধ সেবন করে যেতে হয় । এমন অনেক উদাহরন দেখা যায় যে  চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করে অনেকেই সুস্থ এবং সবল আছেন । 

কিছু জিজ্ঞাসা 

থাইরয়েড এর সমস্যার কারনে কি আমার চুল পরে যেতে পারে ?

উত্তরঃ হাঁ পারে । বিশেষ করে  হাইপোথাইরয়েডইজম এর একটি লক্ষন চুল পরা । সুতরাং সন্দেহ হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া আবশ্যক । 

থাইরয়েড এর সমস্যার করনে কি খিচুনি হতে পারে ?

উত্তরঃ স্বাভাবিক অবস্থায় থাইরয়েড রোগীদের খিচুনি হতে দেখা যায় না। কিন্তু একেবারেই  চিকিৎসা করা না হলে, হাইপোথাইরয়েডইজম এ আক্রান্ত রোগীদের খিচুনি হতে পারে । 

তথ্য সুত্র 

আরও পড়তে পারেনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.