ড্রাগন ফল কেন খাবেন জানেন কি?


ড্রাগন ফল আমাদের দেশে এতো প্রচলিত কোনো ফল নয়। আমাদের প্রত্যেকেরই এটির সম্পর্কে জানার আগ্রহ রয়েছে। আজকের আলোচনায় আমরা এই ফলটির পুষ্টিগুণ, এর উপকারিতা এবং এটির ঘরোয়া চাষাবাদ পদ্ধতি সম্পর্কে জানবো।

ড্রাগন ফল কি?

এটি একটি ভিনদেশি ফল। যদিও এই ফলটি বিদেশ থেকে আমদানি ‌করা হয়েছে তবে এটির সুমিষ্ট স্বাদ ও পুষ্টিগুণের জন্য ইতিমধ্যে আমাদের দেশে এটির বানিজ্যিক চাষাবাদ শুরু হয়েছে। এই ফলটিকে রেড পিটায়া, স্ট্রবেরি পিয়ার, কনডেরেলা প্ল্যান্ট নামেও ডাকা হয়। সাধারণত জুলাইয়ের শেষের দিকে বাজারে এটিকে পাওয়া যায়।

এশিয়ান ড্রাগন ফল

ড্রাগন ফলের গুরুত্ব:

  • ক্যারোটিন সমৃদ্ধ থাকায় চোখ ভালো রাখে।
  • এই ফলে বিদ্যমান প্রোটিন শরীরের যাবতীয় বিপাকীয় কাজে সহায়তা করে।
  • এর ক্যালসিয়াম হাড় শক্ত ও দাঁত মজবুত রাখে।
  • আঁশের পরিমাণ বেশি থাকায় হজমে সহায়তা করে। এছাড়া আঁশ শরীরের চর্বি কমায়।
  • ভিটামিন বি-৩ রক্তের কোলেস্টেরল কমায় এবং ত্বক মসৃণ রাখে।
  • ভিটামিন সি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ত্বক, দাঁত ও চুল ভালো রাখতে সাহায্য করে।
  • হৃদপিন্ডের সুস্বাস্থ্যের জন্য ভালো।
  • কোষ্ঠকাঠিন্য দূরে রাখে।
  • ডায়াবেটিস ও ক্যানসার প্রতিরোধে ফলপ্রসূ।

ড্রাগন ফলের ইতিহাস:

Hylocereus Undatus হচ্ছে এটির বৈজ্ঞানিক নাম। ২০০৭ সালের দিকে থাইল্যান্ড, ফ্লোরিডা ও ভিয়েতনাম থেকে এই ফলের বিভিন্ন জাত আমাদের দেশে আনা হয়। এটি প্রধানত মধ্য আমেরিকার প্রসিদ্ধ একটি ফল। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে দক্ষিণ এশিয়া বিশেষ করে মালয়েশিয়াতে এ ফলের চাষাবাদ শুরু হয়। তবে ভিয়েতনামে এ ফল সর্বাধিক বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়। বর্তমানে এ ফলটি আমাদের দেশেও চাষ করা হচ্ছে।

ড্রাগন ফল দেখতে কেমন:

এই ফলটি সম্পর্কে জানতে আমাদের সকলেরই কমবেশি আগ্রহ রয়েছে। এই ফলটি এক ধরনের ফণীমনসা (ক্যাক্টাস) প্রজাতির। তাই এর গায়ে সামান্য কিছু কাঁটার মতো অংশ রয়েছে। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এই ফলটি লাল রংয়ের হয়ে থাকে। তবে মাঝে মাঝে চার রকমের ড্রাগন ফল দেখতে পাওয়া যায়—লাল বাকল, লাল শাঁস; হলুদ বাকল, সাদা শাঁস; লাল বাকল, সাদা শাঁস; লাল বাকল ও নীলচে লাল শাঁস।

রঙের ভিন্নতা অনুযায়ী স্বাদের ক্ষেত্রেও কিছু পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায়। এটি পাতাবিহীন এবং দেখতে কিছুটা ডিম্বাকার হয়ে থাকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, রূপকথার ড্রাগনের পিঠের সাথে এই ফলের বাইরের খোসা মিলে যায় বলে এটিকে এমন নামে ডাকা হয়।

ড্রাগন ফলের পুষ্টিগুণ:

ড্রাগন ফলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি রয়েছে। প্রতিটি ফলে ক্যালরি এবং প্রচুর ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন সি, ওমেগা ৩ ও ওমেগা ৯ থাকে। এই ফলে বিটা ক্যারোটিন ও লাইকোপিনের মতো অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টের উপস্থিতি লক্ষনীয়। এটিতে থাকা ফাইবার ও আয়রন আমাদের শরীরের পক্ষে খুবই উপকারী।

একটি সুন্দরী মেয়ের হাতে ড্রাগন ফল

প্রতি ১০০ গ্রাম ভক্ষণযোগ্য ড্রাগন ফলে যে পুস্টিমান পাওয়া যায় তা দেওয়া হলো-

  • পানি- ৮০-৯০ গ্রাম
  • শর্করা- ৯-১০ গ্রাম
  • আঁশ- ০.৩৩-০.৯০ গ্রাম
  • প্রোটিন- ০.১৫-০.৫ গ্রাম
  • খাদ্যশক্তি- ৩৫-৫০ কিলোক্যালরি
  • চর্বি- ০.১০-০.৬ গ্রাম
  • আয়রন- ০.৩-০.৭ মি.গ্রাম
  • ফসফরাস- ১৬-৩৫ গ্রাম
  • ক্যালসিয়াম- ৬-১০ মি গ্রাম
  • ক্যারোটিন- (Vitamin A থায়ামিন, রিবোফ্লাবিন সামান্য
  • ভিটামিন- বি-৩ – ০.২ – ০.৪ মি গ্রাম

ড্রাগন ফল এর উপকারিতা:

পুষ্টিগুণ ও শারীরিক উপকারিতা কথা বিবেচনায় ড্রাগনফলের গুরুত্ব অপরিসীম। এই ফলটি শরীরের জন্য খুবই উপকারী। নীচে এই ফলের উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হল:

ক) রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি:

প্রায়সই চিকিৎসকরা ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করতে ভিটামিন সি খেতে উপদেশ দেন। আমাদের ইমিউন সিস্টেমের শ্বেত রক্তকণিকা বাইরে থেকে আসা ক্ষতিকর পদার্থকে প্রতিহত করে। ভিটামিন সি শ্বেত রক্তকণিকাকে সুরক্ষা প্রদান করে। রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে প্রতিদিনকার খাদ্যতালিকায় ড্রাগন ফলকে রাখা যেতে পারে।

খ) হাড়ের স্বাস্থ্য ঠিক রাখে:

ড্রাগন ফলে প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেসিয়াম থাকে।  অন্যান্য সকল ফলের চেয়ে এটিতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ম্যাগনেসিয়াম রয়েছে। ম্যাগনেসিয়াম হাড়ের ঘনত্ব বৃদ্ধি করে এবং অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধ করে। অস্টিওপোরোসিস এমন একটি অবস্থা যার ফলে হাড় দুর্বল হয়ে সহজেই ভেঙে যেতে পারে। জার্নাল অব ইন্টারন্যাশনাল মেডিক্যাল রিসার্চের প্রকাশিত তথ্য বলছে, মাসিক চক্র স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে এমন নারীদের হাড়ের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে ড্রাগন ফল বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

গ) রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখে:

হিমোগ্লোবিন উৎপাদনের জন্য আয়রনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। হিমোগ্লোবিন শরীরের টিস্যুতে অক্সিজেন পৌঁছাতে লোহিত রক্তকণিকাকে সাহায্য করে। দেহের পুষ্টি ঘাটতিগুলোর মধ্যে আয়রনের ঘাটতি অন্যতম। ড্রাগন ফলে আয়রনের পরিমাণ অন্যান্য ফল‌ অপেক্ষা বেশি থাকে।

হলুদ ড্রাগন ফল

ঘ) চুলপড়ার সমস্যা দূর করে:

চুল পড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে আয়রনের অভাব। নিয়মিত ভাবে এই ফল গ্রহণ করলে চুল পড়া সমস্যা কমতে পারে। এই ফল আয়রনের ঘাটতির কারণে রক্তস্বল্পতার অন্যান্য উপসর্গও প্রশমিত করতে পারে।

ঙ) কোষ্ঠকাঠিন্য দূরে রাখে:

ড্রাগন ফল ফাইবার বা আঁশের একটি দারুন উৎস। এটি অন্ত্রের বর্জ্য দূরীকরণে ভূমিকা রাখে। যাদের কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা রয়েছে তারা এই ফল খেলে উপকার পেতে পারেন।

চ) হার্টের উপকার করে:

ড্রাগন ফলে হার্টের জন্য দরকারি ওমেগা ৩ ও ওমেগা ৯ ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে। ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডে প্রদাহনাশক উপাদান রয়েছে। সেকারণে এই ফল খেলে হার্টের রোগের ঝুঁকি ও জয়েন্টের ব্যথা কমে যায়।

ছ) ওজন কমানো:

ড্রাগন ফলে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার ও প্রোটিন থাকে। যার ফলে এটি খেলে শরীরে মেদ কম হয়। তাই সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতে আমাদের এই ফলটি গ্রহণ করা উচিত।

জ) ক্যান্সার প্রতিরোধ:

এই ফলে ফাইবার, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস আর ভিটামিন বি ২ পাওয়া যায় সেকারনে শরীরের বিষাক্ত (Toxins) পদার্থগুলি যা ক্যান্সারে পরিণত হতে পারে সেগুলো অপসারিত হয়। সুতরাং এটিকে সেবন করলে ক্যান্সার রোগ জন্মাতে পারেনা।

ঝ) ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে কাজ করে:

ডায়াবেটিস একটি রক্ত রোগ। এই রোগ কে নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখা উচিত। এই রোগে রক্ত সুগারের পরিমাণ বেড়ে যায়। ড্রাগন ফলে অনেক ধরনের ভিটামিন ও খনিজ থাকে যা রক্তে সুগারের স্তর কে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে এবং শরীরে ইনসুলিন বানাতে সহায়তা করে। ডায়াবেটিস রোগীদের অবশ্যই নিজেদের খাদ্য তালিকায় এই ফলটিকে রাখা উচিত।

ড্রাগন ফল দিয়ে তৈরি প্যান কেক ও চা

এছাড়াও ড্রাগন ফল ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি, দাঁতের শক্তিবৃদ্ধির জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে। হাঁপানি রোগ দমন ও মনোরোগের বিরুদ্ধেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। হজমে সহায়তা করাও এটির অন্যতম কাজ। আরও পড়তে পারেনঃ ডায়াবেটিস কমানোর উপায়

ড্রাগন ফল খাওয়ার নিয়ম:

প্রথমে ফলটির মাথার অংশ এবং পিছনের অংশ কেটে নিন। এরপর ফলটির মাঝ বরাবর চিড়ে ফেলুন এবং ফলের উপর থেকে খোসাটি সরিয়ে ফেলুন। এখন আপনি এটিকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলুন।

এবার আপনি এটিকে স্যালাদ বানিয়ে গ্রহণ করতে পারেন। ব্ল্যান্ডার ব্যবহার করে প্রয়োজনে জুস বানিয়ে পান করতে পারেন। এছাড়াও আপনি এটিকে অন্যান্য ফলের মতোই খেতে পারেন।

ড্রাগন ফলের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া:

সুস্বাস্থ্য ও পুষ্টিগুণ বিচারে ড্রাগন ফলের উপকারিতা অনবদ্য। এত কিছু ভালো দিক থাকার পরেও এর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা অপকারিতা রয়েছে। এগুলো সম্পর্কে নিচে আলোকপাত করা হলো:

এলার্জি:

ড্রাগন ফল ভিটামিন, অ্যান্টি- অক্সিডেন্ট, পলিফেলন এবং ফাইবারের ভালো উৎস। কারোর কারো এই অতিরিক্ত ফলটি গ্রহণ করলে এলার্জির সমস্যা দেখা দিতে পারে। আপনার যদি এই ফলে এলার্জির সমস্যা থাকে তবে আপনার এটি না খাওয়াই উত্তম। আরও পড়তে পারেনঃ এলার্জি দূর করার উপায়

ডায়রিয়া:

ড্রাগন ফলে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে। অতিরিক্ত ফাইবার খেলে আমাদের পেটে সমস্যা হতে পারে। এমনকি ডায়রিয়াও দেখা দিতে পারে।

হাইপারটেনশন:

ড্রাগন ফল পটাশিয়ামের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এটি একটি অপরিহার্য খনিজ যা আমাদের রক্তবাহী পদার্থকে শিথিল করে, রক্ত সঞ্চালনকে উন্নত করে এবং আমাদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। নিয়মিতভাবে সঠিক পরিমাণে ড্রাগন ফল খেলে আমাদের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ হবে।

বেশি পরিমাণ পটাশিয়াম আমাদের শরীরের ব্লাড প্রেসারকে কমিয়ে দেয় যাকে হাইপোটেনশন বলে। হাইপোটেনশনের ফলে আমাদের ব্লাড প্রেসার ওঠা নামা করতে পারে যার ফলে মাথা ঘোরা, বমিভাব, ডিপ্রেশন, জ্ঞান হারানো ইত্যাদি সমস্যা হয়।

কিছু পরিমাণে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকলেও ড্রাগন ফলের গুরুত্ব ভুলিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। আমাদেরকে এটি অল্প বা সঠিক পরিমাণে গ্রহণ করতে হবে।

ড্রাগন ফল চাষ পদ্ধতি (ছাদ বাগানে):

যে কেউ বাড়ির ছাদ বাগানে বড় টবে বা ড্রামে ড্রাগন ফল চাষ করতে পারেন। নীচে ছাদ বাগানে ড্রাগন ফল চাষ পদ্ধতি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:

মাটির পাত্রে ড্রাগন ফল চাষ
credit: gardenerd.com

সঠিক সময়: এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে ছাদবাগানে চারা রোপণ করলে বেশি উপকার পাবেন।

উপযোগী পাত্র: মাটির টবে বা ড্রামে চারা রোপণ করলে সুবিধা পাবেন। ২০ ইঞ্চি আকারের ড্রাম বেছে নিলে সবচেয়ে বেশি ভালো হয়। কারণ এই আকারের ড্রামে চারা ভালোভাবে শিকর ছড়াতে পারে আর এতে ফলন অনেক ভালো হবে।

মাটি: উৎকৃষ্ট জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ বেলে দোঁআশ মাটিই এর জন্য সহায়ক। পরিমান মত গোবর, ৫০ গ্রাম পটাশ সার ও ৫০ গ্রাম টি,এস,পি, সার সংগ্রহ করে মাটির সাথে ভালো ভাবে মিশিয়ে নিন। উপকরণ গুলো ১০ থেকে ১২ দিন একসাথে রেখে দিন। এরপর খুন্তি দিয়ে ঝুরঝুরে করে আরো ৪ থেকে ৫ দিন রেখে দিন।

সেচ ও পরিচর্যা: চারায় পানি দেয়ার সময় গোড়ায় যেন পানি না জমে। ড্রামের ভিতরের বাড়তি পানি সহজে বের হওয়ার জন্য মাটি ভরাট করার পুর্বে ড্রামের নিচের দিকে ৪ থেকে ৫ টি ছিদ্র করে দিন।

ফল সংগ্রহ: ফুল ফোঁটার মাত্র ৩৫-৪০ দিনের মধ্যেই ফল খাওয়ার উপযুক্ত হয়ে পড়ে। চারা রোপনের ১২ মাস থেকে ১৮ মাস বয়সে ফল সংগ্রহ করতে পারবেন।

ড্রাগন ফল অত্যন্ত উপকারী একটি ফল। এটি আমাদের মানসিক অবসাদ দূরীকরণ এবং ত্বক সুন্দর রাখতে সহায়তা করে। এছাড়াও প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও খনিজ লবণযুক্ত হওয়ার জন্য এটি ডায়বেটিস রোগীদের জন্য উপকারী।

তথ্যসূত্র:

আরও পড়তে পারেনঃ

2 Replies to “ড্রাগন ফল কেন খাবেন জানেন কি?”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.