ছাতু খাওয়ার উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম


ছাতুতে প্রচুর মাত্রায় ফাইবার, ম্যাঙ্গানিজ, আয়রন আর ম্যাগনেশিয়াম রয়েছে। একাধিক গবেষণার ফলফল অনুযায়ী এটি শরীরের নানাবিধ উপকার করার পাশাপাশি অনেকক্ষণ আমাদের পেট ভরে রাখে, ফলে বারবার খেতে হয় না। ফলশ্রুতিতে ওজন বাড়ার সম্ভাবনা হ্রাস পায়। অর্থাৎ ছাতু ওজন কমাতেও সাহায্য করে। ছাতু খাওয়ার এতো উপকারিতা থাকার ফলে ছাতুকে ‘দেশি হরলিক্স’ নামেও ডাকা হয়।

ছাতু কি

ছাতুর উৎপত্তি অবাঙালিদের হাত ধরে। ভারতের উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ ও বিহারে এটির প্রচলন দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে প্রোটিনে ভরপুর হলেও আমাদের নিত্যদিনের খাবারে জায়গা করে উঠতে পারেনি। প্রতি ১০০ গ্রাম ছাতুতে প্রায় ৬০-৬৫ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট থাকে।

ছাতু খাওয়ার উপকারিতা

ছাতু অনেক ক্ষেত্রে আমাদের শরীরের জন্য উপকারী প্রমাণিত হয়। বেশ কয়েকটি গবেষণায় এটি প্রমাণিত যে এটি আমাদের দেহের সার্বিক উন্নতিতে বড় ভূমিকা রেখে চলেছে। এতে থাকা বিভিন্ন প্রকারের খনিজ, ভিটামিন ও উপকারি ফ্যাট ও ফাইবার নানান ভাবে আমাদের উপকারে লাগে। নিম্নে ছাতুর বিভিন্ন উপকারিতা তুলে ধরা হয়েছে:

১) হজমে সাহায্য করে-

এটি একইসাথে সহজে হজম হয় এবং হজমশক্তি বাড়াতেও সাহায্য করে। ছাতুতে হজমশক্তি বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ফাইবার প্রচুর পরিমাণে থাকে। এতে বিভিন্ন প্রকারের ভিটামিন এবং খনিজ থাকে যা দেহের সাথে সাথে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বাড়াতেও কাজ করে।

২) কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে উপকারি

এতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকার ফলে নিয়মিত এটি খেলে কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো সমস্যা কমাতে সহায়তা করে। এই ফাইবার পেট পরিষ্কার করতেও অত্যন্ত উপাদেয়। একইসঙ্গে এটি পাকস্থলীতে জমে থাকা ক্ষতিকর তেল-মশলা ও অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থ দূর করে। প্রতিদিনকার খাবারের সাথে যাওয়া অতিরিক্ত তেল শরীর থেকে বের করে দিতেও এটি কার্যকরী।

৩) ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখে

ছাতুর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম ফলে শর্করা খুব ধীরে ধীরে রক্তে মিশে। ফলে এটি সেবন করলে ডায়বেটিস রোগীদের শর্করা বেড়ে যাওয়ার কোনো সমস্যা হয় না।‌ উল্টো এতে উপস্থিত পুষ্টিকর উপাদান সমূহ ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। তবে এটি খাওয়ার সময় মিষ্টি ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক।

৪) রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে থাকে

উচ্চরক্তচাপের রোগীরা কোনো প্রকার সমস্যা ছাড়াই এটিরসঙ্গে অল্প লবণ মিশিয়ে পানিতে গুলে নির্ভয়ে খেতে পারেন। এর ফলে প্রেশার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। নির্দিষ্ট মাত্রায় ফাইবার থাকার ফলে এটি কোলেস্টেরল কমাতেও সাহায্য করে।

৫) মাসিকের সমস্যায় সহায়তা করে

মেয়েদের মাসিকের সময় শরীরে পুষ্টির ঘাটতি দেখা দেয়। একই সমস্যা সন্তান জন্মদানের পরেও দেখা দিতে পারে। এসকল সমস্যার সমাধানে কাজে আসবে ছাতু। এতে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় খনিজ এবং ভিটামিন থাকে, যা শরীরের দূর্বলতা দূরে রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।

৬) শিশুদের বিকাশে

শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে যেসকল খাদ্য উপাদানের প্রয়োজন পড়ে তার প্রায় সবগুলোই ছাতুর মধ্যে রয়েছে। তাই শিশুদের নিয়মিতভাবে এটি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত। এতে তাদের দারুণ উপকার হবে।

৭) ত্বকের সৌন্দর্য বাড়ায়

ছাতু প্রোটিন এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এই দুটি ত্বক ও চুলের সৌন্দর্যতা ও ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। একদিকে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের ক্ষতিকর উপাদানগুলোকে বের করে দেয় এবং প্রোটিন শরীরের ভিতরের পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি রয়েছে, পূরণ করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ত্বক ও চুলের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়।

৮) শরীর ঠাণ্ডা রাখে

ছাতু প্রচুর পরিমাণে জল শোষণ করে ধরে রাখতে পারে। তাই এটি খেলে শরীরে ডিহাইড্রেশন হওয়ার সম্ভবনা থাকে না। ফলে অনেকেই সকালে খালি পেটে ছাতুর সরবত খান ও খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

৯) শরীরের শক্তি বাড়ায়

অতিরিক্ত পরিশ্রমে আমাদের প্রচুর ঘাম হয়, এর মানেই দেহে শক্তির অভাব। শরীরে চলে আসে ক্লান্তি আর ঘুম ঘুম ভাব। এসব থেকে বাঁচতে রোজ এক গ্লাস ছাতুর সরবত খেতে পারেন। এটি খাওয়ার সাথে সাথেই এর পুষ্টি উপাদানগুলো রক্তে মিশে যায়। ফলে ভিটামিন এবং খনিজের ঘাটতি পূরণ হয়ে শরীর এবং মস্তিষ্কের সার্বিক কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

১০) বয়স্কদের জন্য উপকারী

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে নানাবিধ শারীরিক সমস্যা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠতে থাকে। এখানে ছাতু বিশেষভাবে উপকারি ভূমিকা রাখে। একাধিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, নিয়মিত এটি খাওয়া হলে একাধিক বার্ধক্যকালীন রোগ শরীরে বাসা বাঁধতে পারে না। ফলে শেষ বয়সে নিরোগ থাকা যায়।

ছাতু তৈরি করার পদ্ধতি

প্রধানত ছোলার ডাল থেকেই ছাতু তৈরি করা হয়। প্রথমে ডালকে ভেঙ্গে মিহি করা হয়। এরপর এটিকে ছেকে পাউডারে পরিণত করা হয়। মাঝে মাঝে আবার এতে ছোলার ডালের সঙ্গে মটর দানার পাউডারও মিশিয়ে ছাতু বানানো হয় স্বাদ বৃদ্ধি করার জন্য। তবে একেক ধরনের ছাতু একেকভাবে তৈরি করা হয়।

ছাতু খাওয়ার নিয়ম

ছাতুকে নানাভাবে খাওয়া যায়। এটিকে খাওয়া বিভিন্ন উপায় নীচে উল্লেখ করা হলো:

  • পেঁয়াজ, মরিচ, রসুন কুঁচি কুঁচি করে কেটে ছাতুর সাথে মিশিয়ে তৈরি করে নিতে পারেন ঝাল ছাতু।
  • ছাতু দিয়ে লাড্ডু, হালুয়া বা বরফিও বানিয়ে ফেলতে পারেন।
  • ডায়বেটিসের সমস্যা না হলে দুধ, চিনি, কলা মিশিয়ে খান।
  • এটির শরবত বানিয়ে পান করুন, এতে শরীর ঠান্ডা থাকে।
  • যদি ওজন কমাতে চান তাহলে পাতি লেবুর রস এবং বীট লবণ দিয়ে মেখে খেতে পারেন। বা এই নিয়মে সামান্য পানি মিশিয়ে শরবত বানিয়েও খেতে পারেন।
  • ছাতুর পুর দিয়ে রুটি, পরোটা এমনকি কাবাবও বানিয়ে ফেলতে পারেন।
  • বাচ্চাদের জন্য এটিকে একটু জুসের মতো খাওয়ানো যেতে পারে যেনো তাদের এটির প্রতি উৎসাহ তৈরি হয়।
  • অনেকে আবার মুড়ি কলা গুড় বা চিনি দিয়েও এটি খেতে পছন্দ করেন। আবার অনেকে চিনি, গুড় পানি বা দুধের সাথে মেখেও খেতে ভালোবাসেন।

খাওয়ার পদ্ধতিতে পরিবর্তন থাকলেও, এর পুষ্টিগুণে কোনো পরিবর্তন হবে না, তাই নিশ্চিন্তে এটিকে সেবন করুন এবং সুস্থ্য সবল নিরোগ জীবন যাপন করুন।

যবের ছাতু বানানোর নিয়ম

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে যব কি? যব হচ্ছে Poaceae পরিবারের Hordeum গণের অন্তর্ভুক্ত একটি বিরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ। এর বৈজ্ঞানিক নাম Hordeum vulgare এবং ইংরেজিতে Barley বলা হয়।

যবের ছাতু খাওয়ার উপকারিতা

যবের ছাতু সহজে হজম করে, শরীরকে শীতল‌ করে একইসঙ্গে বল ও পুষ্টি বৃদ্ধিতেও সহায়তা করে। প্রাচীন ভারতে একটা সময় যবকে অন্যান্য খাদ্যশস্যের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হতো। নীচে যবের ছাতু বানানোর প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানানো হলো:

  • প্রথমে কিছুদিন রোদে শুকিয়ে নিতে হয়। এটি করার ফলে যবের ভেতরের আদ্রর্তা কমিয়ে আসে।
  • দ্বিতীয় পর্যায়ে এসে একে সামান্য ভিজিয়ে নিয়ে হালকাভাবে পিষিয়ে নিন। পেষাই কাজের জন্য আপনারা ঘরোয়া ভাবে মিক্সার বা গ্রাইন্ডার ব্যব্যহার করতে পারেন। এই পর্যায়ে এটির বাইরের খোসা বের হয়ে যাবে এবং ছোট যবের দানা বের হয়ে আসবে।
  • এবার ছোট দানাটিকে সামান্য আঁচে তেল ছাড়া ভেজে নিন, সবথেকে ভালো হয় এয়ার-ফ্রাইয়ার ব্যবহার করলে। এতে এটির আদ্রর্তা আরো কমে আসে।
  • সবার শেষে আবার মিক্সার বা গ্রাইন্ডারে পেষাই করে মিহি পাউডার বানিয়ে নিন।

ব্যাস আপনার কাজ শেষ, সহজেই আপনি বাসায় খাবারযোগ্য যবের ছাতু  তৈরি করে ফেললেন। ‌তবে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি শেষ করতে ৫-৭ দিন সময় লাগতে পারে।

ছাতু খাওয়ার অপকারিতা

আপাতদৃষ্টিতে এটি খাওয়ার কোনো অপকারিতা নেই।‌ যেহেতু এটি সম্পূর্ণভাবে ভেষজ তাই এটির কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। তবে দিনের বেলায়ই এটি খাওয়া ভালো কেননা এটি হজমে সামান্য সময় নেয়।

পরিশেষে

ছাতু অত্যন্ত উপাদেয় একটি খাদ্য।ছাতু খাওয়ার উপকারিতা অনেক। বর্তমান আধুনিক সময়ে ফাস্টফুড খাবারের আড়ালে উপাদেয় এই খাদ্যটির কথা মানুষ প্রায় ভুলেই গেছে। ৮ – ৮০ বছরের সবাই এটিকে নিশ্চিন্তে গ্রহণ করতে পারেন এবং নিজেদের সুস্থতা নিশ্চিত করতে পারেন।

তথ্যসূত্র –

https://amazingbarley.org

আরও পড়তে পারেনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.