গর্ভাবস্থায় সতর্কতা: যা করা যাবে ও যা করা যাবে না


মা হওয়া প্রতিটি মেয়ের স্বপ্ন। একটা মেয়ে যখন জানতে পারে যে সে মা হতে চলেছে, তখন তার জীবনে শ্রেষ্ঠ একটা অনুভূতি কাজ করে। তবে অনেকে এই সময় ঘাবড়ে যায়। প্রতিটি মেয়ের জীবনে এটি একটি বিশেষ সময়। তাই গর্ভাবস্থায় কি কি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে তা জানতে হবে। এবং জানা থাকা দরকার এই সময় যা করা যাবে আর যা যা করা যাবে না তা সম্পর্কে।

গর্ভাবস্থায় সতর্কতা

গর্ভাবস্থার সম্পূর্ণ সময়কে ডাক্তারগন তিনটি ধাপে ভাগ করে থাকেনঃ

  • ১ম সেমিস্টার
  • ২য় সেমিস্টার
  • ৩য় সেমিস্টার

১ম সেমিস্টার বলতে গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসকে বুঝায়। এই তিনটি ধাপের মধ্যে প্রথম ধাপ ও শেষের ধাপ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। কারন এই সময় বিভিন্ন উপসর্গ ও সমস্যা দেখা দেয়। তাই এই সময় প্রতিটি মাকেই সতর্ক থাকতে হবে। কেননা একজন সুস্থ মাই পারেন একটি সুস্থ সন্তান জন্ম দিতে।

গর্ভধারণের পূর্বের সতর্কতাঃ

গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন ঝুঁকি ও সমস্যা এড়ানোর জন্য গর্ভ ধারণের পূর্বেই বেশ কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। যদি মায়ের শরীরে ভিটামিন ডি, ক্যালসিয়াম, আয়রন সঠিক মাত্রায় থাকে তাহলে এইসময় বিভিন্ন সমস্যার হাত থেকে রেহায় পাওয়া যায়।

গর্ভাবস্থায় প্রথম ৩ মাসের সতর্কতাঃ যা করা যাবে ও যা করা যাবে না

গর্ভাবস্থার প্রথম ৩ মাস একজন মায়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়ে সঠিক নিয়ম মেনে সাবধানতার সাথে চললে বাকি সময়টা সহজ হয় ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানো যায়।

ক) চিন্তামুক্ত থাকাঃ

প্রতিটি হবু মাকেই মনে রাখতে হবে, এই সময় দুশ্চিন্তা করা যাবে না, যতটা সম্ভব প্রফুল্ল থাকতে হবে। কারন দুশ্চিন্তা থেকেই শরীরে ভিবিন্ন ধরণের সমস্যা তৈরি হতে পারে। এ সময় পরিবারে সকল সদস্য ও বিশেষ করে স্বামীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।

কোন অবস্থাতেই উত্তেজিত হওয়া যাবে না। উত্তেজনা গর্ভের বাচ্চার জন্য ক্ষতির কারন হতে পারে। এবং এই সময় প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা ঘুমাতে হবে। এতে মানসিক অবস্থা ভালো থাকবে। চিন্তামুক্ত থাকা, উত্তেজিত না হওয়া, পরিমিত ঘুম – এগুলো শুধু প্রথম তিন মাসের জন্যই নয়, বরং গর্ভাবস্থার শুরু থেকে বাচ্চার জন্ম গ্রহন পর্যন্ত এগুলো মেনে চলতে হবে।

খ) ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবেঃ

গর্ভাবস্থার প্রথম ৩ মাস ব্যাক্তি বিশেষ এক একজনের একেক ধরণের সমস্যা হয়ে থাকে। যেমন কার বেশি বেশি বমি হয়, আবার কার অনেক কম । আবার প্রথম তিন মাস বাচ্চার ওজন নাও বাড়তে পারে, কারন এ সময় অনেক মায়ের খাবারের রুচি কমে যায়। এ সময় সবচেয়ে বড় যে সমস্যা ধরা হয় তা হল রক্তপাত। অতিরিক্ত রক্তপাতের ফলে গর্ভপাতের ঘটনাও ঘটতে পারে। তাই এ সময় বিভিন শারীরিক ও মানসিক সমস্যা এড়ানোর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া। গর্ভধারণের শুরু থেকে শিশুর জন্ম জন্ম পর্যন্ত একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের সংস্পর্শে থাকলে মা ও শিশু উভয়ই নিরাপদ থাকবে।

গ) খাদ্যাভ্যাস ও অন্যান্যঃ

  • কোন কাঁচা শাঁক সবজি গ্রহন করা যাবে না। কিছু ফল যেমন – কাঁচা পেঁপে, আনারস ও কাঁঠাল এগুলো না খওয়াই ভালো।
  • এ সময় মায়ের শরীরে প্রচুর ফলিক এসিড দরকার হয়। তাই ফলিক এসিড সমৃদ্ধ ফল ও খাবার বেশি গ্রহন করতে হবে।
  • এ সময় হজম শক্তি কমে যায়। তাই গ্যাস ও কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিতে পারে। সহজে হজম হয় না এমন খাবার, ভাজা পোড়া, তৈলাক্ত খাবার, শক্ত খাবার খওয়া যাবে না।
  • ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোন ঔষধ গ্রহণ করা যাবে না। গর্ভের শিশুর জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারন হতে পারে।
  • কোন ভারী কাজ করা যাবে না। সিঁড়ি বেয়ে না উঠাই ভালো।
  • ভ্রমণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কারন ভ্রমণ জনিত ঝাকুনির কারনে গর্ভপাত পর্যন্ত হতে পারে।
  • কোন ভাবেই জাতে ঠাণ্ডা না লাগে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। কারন ঠাণ্ডা জনিত কাশির কারনে তল পেটে চাপ পড়ে। এটা প্রথম তিন মাসের জন্য ক্ষতিকর।
  • প্রথম তিন মাসে রক্তে শর্করার সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই সতর্ক থাকতে হবে।
  • উঁচু হিল বা জুতা ব্যবহার করা যাবে না। উঁচু জুতা পরলে পা পিছলে পড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। এতে করে গর্ভপাত পর্যন্ত হতে পারে।
  • নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবনের অভ্যাস থাকলে তা পরিহার করতে হবে। চা বা কফি খাওয়ার অভ্যাস থাকলে তাও এ সময় বাদ দিতে হবে। চা বা কফির ক্যাফেইন বাচ্চার বিকাশের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে।

গর্ভাবস্থায় শেষ তিন মাসঃ যা করা যাবে ও যা করা যাবে না

গর্ভাবস্থায় প্রথম তিন মাসের মত শেষের তিন মাসও গুরুত্বপূর্ণ । এইসময় বিশেষ সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে। কারন এইসময় বাচ্চা পূর্ণতা লাভ করে।

  • মাকে প্রচুর প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহন করতে হবে। যেমন- মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, বিভিন্ন বাদাম, ইত্যাদি। এ খাবার গুলো পর্যাপ্ত খেলে বাচ্চার ওজন সঠিক ভাবে বাড়বে ও সুস্থ বাচ্চার জন্ম হবে আশা করা যায়।
  • এছাড়াও কোষ্ঠকাঠিন্য এড়ানোর জন্য আঁশযুক্ত খাবার প্রচুর পরিমাণে গ্রহন করতে হবে। এবং ৮-১০ গ্লাস পানি পান করতে হবে।
  • এ সময় মায়ের পেট যেহেতু অনেক বড় হয়ে যায়, তাই মা ঠিকমতো ঘুমাতে বা বিশ্রাম নিতে পারে না। যেভাবে শুইলে বাচ্চার কোন ক্ষতি হবে না, মাকে সেভাবেই শুয়ে বিশ্রাম নিতে হবে বা ঘুমাতে হবে। ঢিলে ঢালা পোশাক পরিধান করতে হবে।
  • শেষ তিন মাসে ভারী কোন কাজ বা ভ্রমণ একেবারেই করা যাবে না। ভ্রমণ বা ভারী কাজ করলে পানি ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এতে বাচ্চার জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে।
  • মাকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে যে, তার বাচ্চার নড়াচড়া ঠিক আছে কি না। বিশেষ করে, খওয়ার পর বাচ্চা নড়াচড়া করছে কিনা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। বেশি নড়াচড়া করলে সমস্যা নেই, কিন্তু কম করলে ডাক্তারকে জানাতে হবে।
  • খাবার গ্রহনের পর শুয়ে না থেকে ১০-১৫ মিনিট হাঁটা ভালো। এতে গ্যাসের সমস্যা কম হবে।
  • এ সময় মায়ের শরীরে ডায়াবেটিস বা অন্য কোন সমস্যা থাকলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়াও গর্ভফুল ঠিক জায়গায় আছে কিনা, পানির পরিমাণ ঠিক আছে কিনা, শরীরে হিমোগ্লোবিন ঠিক আছে কিনা, ইত্যাদি বিষয়ে ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলতে হবে।
  • গর্ভাবস্থায় প্রথম ও শেষের তিন মাস সাদা স্রাব যেতে পারে। এটা তেমন কোন সমস্যা না। তবে, যদি অতিরিক্ত পরিমাণে যায়, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
  • কোন ভাবেই উত্তেজিত হওয়া যাবে না। উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা থাকলে আরও বেশি সচেতন থাকতে হবে।
  • শেষের তিন মাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল হাসপাতাল বা ডাক্তারের নিকটবর্তী স্থানে অবস্থান করা। যাতে যেকোন সমস্যায় চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া যায়।

গর্ভাবস্থায় সহবাস

প্রথম তিন মাস সহবাস থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হবে। অন্যথায় গর্ভপাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া শেষ তিন মাসেও সহবাস একদমই করা যাবে না। এতে করে পানি ভেঙ্গে যেয়ে প্রসব ব্যাথা উঠতে পারে।

গর্ভাবস্থায় পেটে ব্যথা

গর্ভাবস্থার প্রথম থেকেই অনেকে পেট ব্যাথা অনুভব করে থাকে। গর্ভাবস্থায় প্রথম ১২ সপ্তাহ পেট ব্যাথা একটি স্বাভাবিক বিষয় হলেও অনেক সময় এ ব্যাথা বড় সমস্যার কারন হতে পারে। অনেকেই এটাকে গুরুত্ব দেন না, মনে রাখতে হবে, ব্যাথা হলে অবশ্যই আপনার ডাক্তারকে জানাতে হবে। গর্ভাবস্থায় পেট ব্যাথা হওয়ার কারন গুলো জানা থাকলে গর্ভপাত এড়ানো যাবে –

  • গর্ভাবস্থায় জরায়ু সামনের দিক থেকে নিচে নেমে কোক দিয়ে প্রবেশ করে যার ফলে অনেক সময় তল পেটে ব্যাথা অনুভূত হয়। একটু হাঁটাচলা করলে এ ব্যাথা কমে যায় অনেক সময়।
  • যদি কারও ডিম্বাণু জরায়ুর বাহিরে প্রতিস্থাপিত হয় তবে ব্যাথা অনুভূত হবে ও রক্তপাত হতে পারে। প্রথম ৬ – ১০ সপ্তাহের মধ্যে এ ব্যাথা হতে পারে।
  • প্রস্রাবের প্রদাহ বা ইনফেকশনের কারনে অনেক গর্ভবতী মহিলার পেট ব্যাথা হয়ে থাকে। এ সমস্যা এড়ানোর জন্য প্রথম থেকেই প্রচুর পানি পান করতে হবে।
  • জরায়ু থেকে প্লাসেন্টা পৃথক হওয়ার কারনে পেট ব্যাথা হতে পারে ও রক্ত পাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তখন শিশুর জীবন হুমকির সম্মুখীন হয়। তাই গর্ভাবস্থার শুরু থেকেই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
  • কোষ্ঠকাঠিন্য ও গ্যাসের কারনেও পেট ব্যাথা হতে পারে। ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ সেবন করা যেতে পারে।
  • গর্ভাবস্থায় পেট ব্যাথা নিয়ে সতর্ক অবস্থায় থাকতে হবে। কারন দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, ১৫-২০ শতাংশ গর্ভপাতের লক্ষণ হল হালকা থেকে তীব্র পেট ব্যাথা ও যোনি দিয়ে রক্ত পড়া ।

আরও পড়তে পারেনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.