অনেকেই আশা প্রকাশ করেছেন, উষ্ণ এবং আর্দ্র আবহাওয়া -তে করোনা ভাইরাস এর প্রাদুর্ভাব কমে যাবে। এর সপক্ষে কোভিড ১৯ এর সাথে সেইসব ফ্লু এর তুলনা দেয়া হচ্ছে , যেসব ভাইরাস এর জীবনচক্র ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে নিয়ন্ত্রিত হয়। সত্যিকার অর্থেই কি নভেল করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য? চলুন দেখা যাক করোনা ভাইরাস কিভাবে আবহাওয়ার উপর নির্ভরশীল এবং এর ছড়িয়ে পরা থামানোর জন্য শুধুমাত্রই আবহাওয়ার উপর ভরসা করা যায় কিনা !
এনভেলপড ভাইরাসঃ
করোনা এমন এক ভাইরাস শ্রেণীর অন্তর্গত যাদের বলা হয় “এনভেলপ” ভাইরাস । অর্থাৎ এসব ভাইরাস তেল বা চর্বির আবরণে আবৃত (coated in an oily coat)। এর আরেক নাম লিপিড বাইলেয়ার , এই লিপিড বাইলেয়ার এর সাথে যুক্ত থাকে প্রোটিন অনেকটা মুকুটের একটি স্পাইক এর মত । ল্যাটিন ভাষায় করোনা মানে মুকুট , এই নামেই এই ভাইরাস শ্রেণিটির নাম দেয়া হয়েছে করোনা । করোনার চিত্রটি আপনাদের “এনভেলপ” কিভাবে প্রোটিনকে আটকে থাকতে সহায়তা করে তা বুঝতে সাহায্য করবে।

রান্না করা মাংসে চর্বি যেমন ঠাণ্ডায় শক্ত হয়ে যায় , ঠিক তেমনিভাবে লিপিড এর এই আবরন করোনাকে পোষক দেহের বাইরে যদি ঠাণ্ডা আবহাওয়া থাকে তবে দীর্ঘক্ষণ প্রোটিন এবং অন্য অঙ্গাণুগুলো সহ একীভূত বা ইন্টেক্ট অবস্থায় বাঁচিয়ে রাখতে পারে। সুতরাং, অপেক্ষাকৃত শীতল আবহাওয়া এই ভাইরাসের জন্য উপযোগী পরিবেশ। গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার অন্যান্য ভেরিয়েন্ট সমূহ , উদাহরণ স্বরুপ “সার্স“এবং “সার্স- কোভ-২” খুব বেশি উষ্ণ এবং আর্দ্র পরিবেশে বেশীক্ষণ টিকে থাকতে পারে না, তাই অনেক গবেষক মনে করছেন ,”কোভিড-১৯” ও হয়ত একই রকম আচরণ প্রকাশ করবে ।
কিন্তু সত্যি কি তাই?
স্পেনের মাদ্রিদের গবেষক ‘মিগুএল আরুজু’ মনে করেন-“মানুষের শরীরের বাইরে অবস্থিত ভাইরাসগুলির জন্য পরিবেশ এবং অনুকুল আবহাওয়া অবশ্যই জরুরী ভুমিকা পালন করবে ” কিন্তু তিনি মনে করেন , এটিই একমাত্র বিবেচ্য বিষয় নয় , কারন এই ভাইরাসটি মুলত মানুষের মাধ্যমেই এক পোষক দেহ থেকে আরেক দেহে ছড়াচ্ছে তার মতে “ যে অঞ্চলে মানুষের সংস্পর্শ বেশি থাকবে সেখানে ভাইরাসটির ছড়িয়ে পরার প্রবনতাও বেশি থাকবে “
অনেকেই হয়ত বলছেন , ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ড এর একদল গবেষক দেখিয়েছেন অপেক্ষাকৃত কম আর্দ্র আবহাওয়া এবং ৫-১১ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় করোনা ছড়ানোর হার সবচেয়ে বেশি ।
অপরদিকে হার্ভার্ড মেডিক্যাল এর বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই নতুন করোনা ভাইরাসটির পরিবেশের উপর নির্ভরতা অনেকেই যেমন আশা করছেন তার তুলনায় কম।
চিনের এক গবেষণায় (গবেষণা পত্রটি প্রকাশের অপেক্ষায় আছে । উঠে এসেছে করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু সংখ্যার সাথে সেইদিনের আবহাওয়ার সম্পর্ক আছে। উহানে করনায় মৃত ২৩০০ রোগীর উপর চালানো এক গবেষণায় দেখা যায় ,মৃত্যুর হার সেইদিন কম ছিল যেদিন ঐ অঞ্চলের তাপমাত্রা এবং আপেক্ষিক আর্দ্রতা বেশি ছিল ।
অপরদিকে তাদের গবেষণা আবার এটাও দাবি করে যে , যেদিন সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার ব্যাবধান বেশি ছিল মৃত্যুর হার ঐ দিন গুলতেও বেশি।
নভেল করোনা অপেক্ষাকৃত নতুন একটি ভাইরাস , যার নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য প্রতিনিয়ত আবিষ্কৃত হচ্ছে , গবেষকরা সবাই এ ব্যাপারে একমত যে , কোভিড -১৯ এর ব্যাপারে যেকোনো চূড়ান্ত মতবাদে পৌছানোর আগে আরও ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন ।
করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় আমাদের করণীয়ঃ
French Institute of Health and Medical Research এর পরিচালক ভিট্টরিয়া কলিজ্জা এর মতে
“ ভাইরাস বহনের প্রকৃত মাধ্যম যদিও বায়ু কিন্তু এক্ষেত্রে এটি যখন কমিউনিটি সংক্রমণ শুরু করে তখন, কাছাকাছি সংস্পর্শে থাকা মানুষগুলোর মাধ্যমেই রোগটি সংক্রমিত হতে থাকে। সুতরাং মানুষের মাঝে সামাজিক দূরত্ব বাড়লে স্বাভাবিক ভাবেই ভাইরাসের সংক্রমণ হার তথা সংক্রমণ ক্ষমতাও কমে আসবে ।“
সুতরাং , যদিওবা তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতার প্রভাব থেকেও থাকে , কঠোর লকডাউন এবং সামাজিক দূরত্ব এই দুঃসময় থেকে মুক্তি পাবার একমাত্র চাবিকাঠি ।
গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহাওয়া অর্থাৎ উষ্ণ এবং আর্দ্র আবহাওয়া হয়ত আমাদের করোনার বিরুদ্ধে পরিবেশগত একটা সুবিধা এনে দিতে পারে, কিন্তু সেটি তখনই সফল হবে, যখন আমরা সামাজিক দূরত্ব এবং করোনা প্রতিরোধের নিয়মগুলি সকলে মেনে চলব ।
তথ্য সুত্রঃ
https://www.bbc.com/future/article/20200323-coronavirus-will-hot-weather-kill-covid-19
আরও পড়তে পারেনঃ