চা একটি জনপ্রিয় পানীয়ের চেয়েও অনেক বেশি কিছু। হাজার হাজার বছর ধরে, চা একটি ঐতিহ্যের অংশ। সর্বপ্রথম চীনে চায়ের প্রচলন হয় বলে ধারণা করা হয় তাও সম্ভবত ২৭৩৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। পরবর্তীতে জাপান, হল্যান্ডে এবং শেষ পর্যন্ত ইউরোপের বাকি অংশে এটি ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এই আধুনিক যুগে এসেও আমরা অনেকেই ভালো চা চিনতে পারিনা। চলুন জেনে নেই ভালো চা চেনার উপায় ও চা খাওয়ার উপকারিতা।
ভালো চা চেনার উপায়
চা আমাদের দেশে সর্বাধিক ব্যবহৃত পানীয়। এটি আমাদের জন্য শুধু পানীয় নয় বরং একটি আবেগ। একজন ব্যক্তির স্বাদ, পছন্দ এবং অপছন্দের ভিত্তিতে আলাদা আলাদা প্রকারের চায়ের উপস্থিতি লক্ষণীয়। তবে ভালো চা পাতা চেনাও ততোটাই গুরুত্বপূর্ণ যতটা এটির বানানোর প্রক্রিয়া। নিম্নে ভালো চা চেনার কয়েকটি উপায় সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
১) স্পর্শ করে দেখা:
ভাল মানের পাতার মধ্যে কিছুটা মসৃণতা থাকে। প্রকৃতপক্ষে, বিশেষজ্ঞদের মতে, পাতা হালকা অনুভব করে এবং হাতের তালুতে পাতা রেখে এটির মান পরীক্ষা করা যায়। যে কোনো ধরনের রুক্ষতা পরীলক্ষিত হলে সেই পাতাগুলো খুঁজে বের করে ফেলে দেওয়াই হল সেরা উপায়।
২) ঘ্রাণশক্তির ব্যবহার করুন:
চায়ের নিজস্ব স্বতন্ত্র সুগন্ধ রয়েছে এবং যা যে কোন ভেজাল চা পাতা থেকে সহজেই আলাদা করা যায়। পাতার গন্ধে যদি বিবর্ণ গন্ধ থাকে তবে তা নিম্নমানের চা। চায়ের একটি শক্তিশালী, ঘাসযুক্ত এবং তাজা সুগন্ধ রয়েছে, যা এর নিজস্বতা যাচাই করতে সহায়তা করে।
৩) চা পাতার চেহারা:
বৃক্ষ তোমার নাম কি? ফলে পরিচয়। ঠিক তেমনি ভালো মানের চা পাতা নিছক চেহারা দেখেই চেনা সম্ভব। বিশেষজ্ঞদের ধারণা অনুযায়ী, চা পাতায় দাগ বা ডালপালা থাকা উচিত নয় এবং কম চূর্ণবিচূর্ণ হওয়া উচিত। এছাড়াও, নিশ্চিত করতে হবে যে পাতাগুলিতে যেনো কাঠের টুকরো না থাকে, এটি পাতাগুলিকে কম সুগন্ধযুক্ত করতে পারে।
৪) স্বাদ পরীক্ষা করুন:
ভালো চায়ের কোনো পরিচয়ের প্রয়োজন হয় না এর স্বাদই এটির সতেজতা নির্ধারণ করে এবং সর্বোপরি স্বাদ বিচার করাই সর্বোত্তম উপায়। আপনি যে ধরনের চা-ই পছন্দ করেন না কেন শুধুমাত্র একটি চুমুক আপনার স্বাদ সংবেদনকে উদ্দীপিত করতে পারে এবং আপনি বুঝে যাবেন চা পাতা ভাল না খারাপ।
চা পানের উপকারিতা
একাধিক গবেষণার ফলাফল থেকে এটি প্রমাণিত যে, নিয়মিত চা পান করলে শরীরের নানা রকম উপকার হয়। এছাড়াও নানা ধরনের জটিল রোগ দূরে রাখতেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। অনেকেই এমন রয়েছেন যারা রিফ্রেশমেন্টের জন্য দিনে কয়েক কাপ চা অনায়াসেই পান করে থাকেন। নীচে চা পানের অন্যান্য উপকারিতা সমূহ তুলে ধরা হলো:
ক) হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়:
এটি শরীরের খারাপ কোলেস্টেরল দূর করে ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি করে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। এর জন্য গ্রীন টি ও ব্ল্যাক টি বিশেষভাবে কাজ করে। এটি রক্তের শর্করার পরিমাণ, রক্তচাপ, লিপিড কন্টেন্ট নিয়ন্ত্রণে রাখে। তাই আমাদের হৃদপিন্ড সুস্থ রাখতে নিয়মিত পরিমাণমতো চা পান করা উচিৎ।
খ) ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে:
এটি ডায়াবেটিসসহ এর সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য জটিলতা কমাতে সাহায্য করে। বেশকিছু গবেষণা থেকে জানা যায়, এটি ইনসুলিনের ক্ষমতা বাড়ায় যা রক্তে শর্করার মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সহায়তা করে। তবে গ্রিন টি এবং লিকার চা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য সবচেয়ে বেশি উপকারী।
গ) অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট উপাদান সমৃদ্ধ:
এতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান রয়েছে যা, হৃদরোগ, ক্যান্সার, বার্ধক্যজনিত সমস্যা দূরে রাখতে সক্ষম। ফলে চিকিৎসকগণ শরীর রোগমুক্ত রাখতে অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট সমৃদ্ধ খাবারের পাশাপাশি নিয়মিত চা পানের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এটি একইসঙ্গে ফ্রি র্যাডিক্যালসের প্রভাব কমাতে সাহায্য করে।
ঘ) মাথাব্যথা কমাতে:
আশাকরি চা পানের এই উপকারিতা সম্পর্কে কাউকে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে না। প্রায় সকলেই জানে এক কাপ চা ক্লান্তি দূর করার পাশাপাশি মাথা ব্যাথাও দূর করতে অত্যন্ত কার্যকরী। এর পেছনে চা তে থাকা ক্যাফিন নামক উপাদান দায়ী, যা মাথা ব্যাথার প্রভাবকে কমাতে পারে। তবে এর অতিরিক্ত ব্যবহার মাথাব্যথা, অনিদ্রা এবং অস্থিরতার মতো সমস্যা তৈরি করতে পারে।
ঙ) বাতব্যথা দূর করতে:
গ্রিন টি বাতব্যথায় সাময়িক আরাম দিতে পারে। একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, গ্রিন টি এবং ব্ল্যাক টিতে থাকা অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি বৈশিষ্ট্য বাতের ঝুঁকি এবং ব্যথা কমাতে সহায়তা করে। তবে মনে রাখতে হবে এটি একটি ঘরোয়া চিকিৎসা।
চ) ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস:
এটিতে পলিফেনল নামে একধরনের যৌগের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এই যৌগটির ফলে টিউমার কোষগুলি পার্শ্ববর্তী অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে না এবং কোষের সঠিক বৃদ্ধিতে নিশ্চিত হয়। তবে চা শুধু ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে কিন্তু এর প্রতিকার করতে পারে না।
ছ) ত্বক ও চুলের উন্নতি:
এটিতে থাকা ক্যাফিন ত্বক ও চুলের জন্য অনেক উপকারী। কিন্তু এতে অতিরিক্ত দুধ ও চিনির ব্যবহার করলে তা মোটেও কাজে আসবে না। তাই ত্বক ও চুলের ঔজ্জ্বল্যতা ধরে রাখতে রোজ সকালে এক কাপ চিনি ছাড়া ব্ল্যাক টি খেতে পারেন।
জ) প্রদাহ কমায়:
শরীরের কোথাও ব্যথা থেকে প্রদাহ হলে এক কাপ মধু চা খেয়ে নিলে তা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। এর এমন গুণাবলীর পেছনে এতে থাকা অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি বৈশিষ্ট্যের অবদান অনস্বীকার্য। এটি একইসাথে প্রদাহজনিত ফোলা ভাব কমাতেও সহায়ক।
অতিরিক্ত চা খাওয়ার ক্ষতিকর দিক
যদিও পরিমাণমতো চা খাওয়া বেশিরভাগ মানুষের জন্য স্বাস্থ্যকর, তবে অত্যধিক চা পান নেতিবাচক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণ হতে পারে, যেমন উদ্বেগ, মাথাব্যথা, হজম সংক্রান্ত সমস্যা এবং অনিদ্রা ইত্যাদি। নীচে অতিরিক্ত চা পানের অপকারিতা সমূহ তুলে ধরা হলো:
- আয়রন গ্রহণ করার ক্ষমতা কমায়
- উদ্বেগ, মানসিক চাপ এবং অস্থিরতা বাড়িয়ে দিতে পারে
- অনিয়মিত নিদ্রা
- বমি বমি ভাব
- হজমে সমস্যা দেখা দিতে পারে
- গর্ভাবস্থায় জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে
- মাথাব্যথা ও মাথা ঘোরানো
- ক্যাফেইনের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা
পরিশেষে –
দিনে দিনে চা আমাদের সংস্কৃতির একটি অংশ হয়ে উঠেছে। চীনে উৎপাদন হয়ে ইউরোপীয়দের হাত ধরে এই জনপ্রিয় পানীয়টি বর্তমানে সারাবিশ্বে নিজের একটি আলাদা স্থান তৈরি করে নিয়েছে। আজও একজন বাঙালির বাসায় আপ্যায়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে এই পানীয়টি। তবে এর অতিরিক্ত গ্রহণ শরীরের স্বাভাবিক ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তবে এর উপকারিতা সমূহকেও ভুলিয়ে দেওয়া যায় না।
তথ্যসূত্র:
- http://www.ais.gov.bd/site/view/krishi_kotha_details/
- https://selecthealth.org/blog/2018/11/benefits-of-drinking-tea
- https://www.healthline.com/nutrition/side-effects-of-tea
- https://happyearthtea.com/blogs/tea-101/10738421-selecting-good-tea
ভালো লিখা, অনেক কিছু জানা গেলো চা সম্পর্কে।
মূল্যবান মন্তব্যের জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।