একটি অপরিচিত সবজি হিসেবে অনেকেই বিট খেতে পছন্দ করেন না। কিন্তু পুষ্টিবিদরা বিট রুট এর উপকারিতাকে বিবেচনায় নিয়ে এটি খাওয়ার পরামর্শ প্রদান করে থাকেন। অনেকের কাছেই বিট (beetroot) একটি অপরিচিত ফলের নাম। বর্তমানে এটি ধীরে ধীরে সুপার ফুড হিসেবে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। বিটের বৈজ্ঞানিক নাম “বেটা ভালগারিস”।
বিট (beetroot) দেখতে কেমন?
যদিও এটি একটি শীতকালীন সবজি তারপরও সারাবছরই এর দেখা পাওয়া যায়। একে দেখতে কিছুটা কালচে লাল রঙ বিশিষ্ট্য কন্দযুক্ত পেঁয়াজের মতো হয়। পদ্ধতিভেদে অনেকে একে নানাভাবে গ্রহণ করে থাকেন। সামান্য অদ্ভুত দেখতে হলেও এর উপকারি দিকসমূহকে কখনো অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়।
বিটের পুষ্টিগুণ
নীচে প্রতি ১০০ গ্রাম বিটে থাকা পুষ্টি উপাদান সম্পর্কে তুলে ধরা হলো:
ক্যালোরি | : ৪৩ |
চর্বি | : ০.২ গ্রাম |
সোডিয়াম | : ৭৮ মিলিগ্রাম |
পটাশিয়াম | : ৩২৫ মিলিগ্রাম |
সর্বমোট কার্বোহাইড্রেট | : ১০ গ্রাম |
ফাইবার | : ২.৮ গ্রাম |
চিনি | : ৭ গ্রাম |
প্রোটিন | : ১.৬ গ্রাম |
সম্পৃক্ত চর্বি | : ০ গ্রাম |
কোলেস্টেরল | : ০ মিলিগ্রাম |
অন্যান্য প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদানঃ
খাদ্য উপাদানঃ | ভিটামিন সি | আয়রন | ভিটামিন বি৬ | ম্যাগনেসিয়াম | ক্যালসিয়াম | ভিটামিন ডি | কোবালামিন | |
প্রতিদিনের প্রয়োজনের % | ৮% | ৪% | ৫% | ৫% | ৮% | ০% | ০% |
বিটের স্বাস্থ্য উপকারিতা
নীচে বিটের উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
ক) ক্যান্সার প্রতিরোধে:
ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস করতে বিটের জুস অত্যন্ত উপকারী। এর মধ্যে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও অ্যান্টিইনফ্ল্যামেটরি উপাদান যা ক্যান্সার প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। এটির গাঢ় লাল রঙ হওয়ার জন্য ব্যটালাইনস নামক পদার্থ দায়ী যা ক্যান্সার সৃষ্টিকারী ক্ষতিগ্রস্ত কোষের হাত থেকে সুস্থ কোষগুলোকে রক্ষা করে।
খ) মাসিকের সমস্যা দূর করে:
অনিয়মিত মাসিকের সমস্যা সমাধানে বিট খুবই উপকারে আসে। এতে থাকা আয়রন নতুন লোহিত রক্তকণিকা তৈরি করতে সক্ষম। এরফলে মাসিকের সময় হওয়া সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
গ) হাড় মজবুত করে:
দেহে ক্যালসিয়াম বিষয়ক সমস্যা দূরীকরণে এটি অত্যন্ত উপকারী। এটি শরীরে ক্যালসিয়াম ধরে রাখতে পারে বলে হাড়ের সমস্যা সমাধানে এটি বহুল প্রচলিত। এর হাড়কে মজবুত রাখার সক্ষমতা রয়েছে ফলে বেশি বয়সে হাড়ের সমস্যায় ভুগতে হয়না।
ঘ) মানসিক সমস্যায়:
মন ভালো রাখতে বিটের সরবত খেয়ে দেখতে পারেন। এতে থাকা বিটেইন ও ট্রিপটোফোন নামক উপাদানে মন ভালো রাখার সক্ষমতা রয়েছে। ফলে মানসিক অবসাদ বা ডিপ্রেশনের ঝুঁকি হ্রাস পায়।
ঙ) দৃষ্টিশক্তির উন্নতি:
এটিতে বিটা-ক্যারোটিন এবং ভিটামিন এ থাকে। প্রতিদিন বিট খাওয়া রেটিনার ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে। এতে চোখের ছানির মত রোগও প্রতিহত হয়।
চ) রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়:
বিটের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট থাকে। একটি গবেষণা অনুযায়ী, নিয়মিত বিটের জুস পান করলে অক্সিজেন গ্রহণের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। বিটে থাকা হাই অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের ফলে শরীর থেকে টক্সিন উপাদান বের হয়ে যায় এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
ছ) রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে:
যারা হাই প্রেসার বা উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় ভুগেন তাদের প্রতিদিন অন্তত দুই গ্লাস বিটের জুস পান করা উচিৎ। বর্তমান বিশ্বে প্রায় প্রতিটি পরিবারেই উচ্চ রক্তচাপের রোগী দেখতে পাওয়া যায়। একটি গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী শীতকালে হাতের কাছে থাকা বিট বা বিটের রস পান করলে উচ্চরক্তচাপের সমস্যা কমে। এতে নাইট্রেট নামক একটি উপাদান থাকে যা শরীরের রক্ত সঞ্চালন ব্যবস্থা স্বাভাবিক রেখে উচ্চরক্তচাপ তথা স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়।
জ) ত্বকের উন্নতি:
প্রতিদিন এক গ্লাস বিটের জুস উজ্জ্বল ত্বক লাভ করতে সাহায্য করে। এতে অ্যান্টি-এজিং উপাদান রয়েছে যা ত্বকের তারুণ্য ধরে রাখতে সহায়তা করে। এতে ত্বকের ব্রন, বলিরেখা, কালোদাগ, মেছতা সমস্যা দূর হয়।
ঝ) পরিপাকতন্ত্রের উপকার:
বর্তমানে অস্বাস্থ্যকর খাবারের প্রভাবে আমাদের লিভারের অবস্থা খুবই খারাপ করে দিচ্ছে। বিট আমাদের পরিপাকতন্ত্রকে উন্নত করতে সাহায্য করে। এতে বেটাইন নামে এক উপাদান থাকে যা লিভার ফাংশনকে আরো ভালো করে। এছাড়াও এটি বদহজম, ডায়রিয়া, জন্ডিসসহ অন্যান্য পেটের সমস্যায় অত্যন্ত উপকারী।
এছাড়াও শরীর সুস্থ ও সতেজ রাখতে রোজ শরীরচর্চার পাশাপাশি চিকিৎসকরা বিটের রস পানের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এই রস শরীরে দ্রুত শক্তির যোগান দিতে সক্ষম। একইসঙ্গে এটি পেশিশক্তিরও উন্নতি ঘটায়।
বিট খাওয়ার পদ্ধতি:
- বেশিরভাগ মানুষ বিটের জুস খেতেই বেশি পছন্দ করেন। অনেকে আবার এরসাথে স্বাদ ও পুষ্টি বাড়াতে গাজরের ব্যবহার করে থাকেন।
- বড় বড় রেস্টুরেন্টে বিটকে সালাদের উপকরণ হিসেবে কাজে লাগানো হয়। সেহেতু আমরা নিজেদের বাসায়ও বানিয়ে খেতে পারি।
- শীতকালীন সবজি হিসেবে অনায়াসে এটিকে যেকোনো খাবারের সাথে মিশিয়ে রান্না করা যায়।
বিটের জুস:
যারা নিয়মিত বিট খান তাদের মধ্যে অধিকাংশই শুধু এটির জুস খেতে পছন্দ করেন। আলাদা আলাদা প্রক্রিয়া অনুসরণ করে কয়েক রকমের জুস বানিয়ে ফেলা সম্ভব। নীচে কয়েকটি সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলো:
১। বিট ও আপেলের জুস:
আপেল ও বিট দুটোই সুস্বাস্থ্য রক্ষায় দারুণ উপকারী। আপেল মিষ্টি হওয়া সত্ত্বেও এতে খুব অল্প পরিমাণে ক্যালোরি থাকে। তাই পুষ্টিগুণ ও স্বাদ বাড়াতে এটিকে বিটের জুসে মিশিয়ে নিতে পারেন।
প্রয়োজনীয় উপকরণ:
- ১ কাপ আপেল
- ২ কাপ বিট
- দারুচিনির, লবণ ও গোলমরিচের গুঁড়ো
কার্যপদ্ধতি:
এবারে সকল উপাদানকে একত্রে পরিমাণ মতো ব্লেন্ড করে তৈরি করে ফেলুন আপেল ও বিটের জুস। স্বাদ বাড়াতে পরিমিত পরিমাণে বিটলবণ ও লেবুর রস মিশিয়ে নিতে পারেন।
২। বিট ও গাজরের জুস:
গাজর ও বিটে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে। ফলে এসব হজম হতে স্বাভাবিকের তুলনায় সামান্য বেশি সময় লাগে তাই বার বার খেতে ইচ্ছে হয় না। তাই নিজের ওজন কমাতে চাইলে এই দু’টোকে একত্রে জুস বানিয়ে পান করুন।
প্রয়োজনীয় উপকরণ:
- ২ কাপ গাজর
- ২ কাপ বিট
- ১/২ কাপ পানি
- লেবুর রস ৫ টেবিল চামচ
- পুদিনা পাতা পরিমাণমতো
- লবণ পরিমাণমতো
কার্যপদ্ধতি:
প্রথমে বিট, গাজর ও পুদিনা পাতাকে একত্রে ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড করে ঘন করে নিন। এবার এতে পানি, লেবুর রস ও লবণ মিশিয়ে ভালো করে নেড়ে নিতে হবে। খাওয়ার মতো তরল হয়ে গেলে তৃপ্তি নিয়ে এটিকে পান করুন।
৩। বিট ও টমেটোর জুস:
টমেটো ও বিট দুটোতেই প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে। এদের খেলে শরীরের রক্ত সঞ্চালন ব্যবস্থার দারুণ উন্নতি ঘটে।
প্রয়োজনীয় উপকরণ:
- টমেটো দেড় কাপ
- ২ কাপ বিট
- লেবুর রস ৩ টেবিল চামচ
- পরিমাণমতো লবণ
কার্যপদ্ধতি:
প্রথমে বিট, টমেটো ও লেবুর রস একসাথে ব্লেন্ড করে নিন। এরপর পরিমাণমতো লবণ দিয়ে ভালোভাবে নেড়ে নিন।
৪। বিট ও ডালিমের জুস:
ডালিম ও বিট দেহে রক্তের পরিমাণ বাড়াতে সহায়তা করে। এছাড়াও ডালিমে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স থাকার ফলে এটি হজমে সাহায্য করে। একইসাথে এতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ফাইবার রয়েছে।
প্রয়োজনীয় উপকরণ:
- ডালিমের বীজ ১ কাপ
- ২ কাপ বিট
- লেবুর রস ৩ টেবিল চামচ
- বিটলবণ
কার্যপদ্ধতি:
প্রথমতো বিট ও ডালিম একত্রে ভালোভাবে ব্লেন্ড করে নিন। এবার এতে লেবুর রস ও বিটলবণ মিশিয়ে ভালো করে নাড়িয়ে নিন। প্রয়োজনে পুদিনা পাতা মিশিয়ে একে আরো সুস্বাদু করে তোলা যায়।
বিট এর অপকারিতা
আসলে বিটের অতিরিক্ত আপনার জন্য খারাপ পরিণাম বয়ে নিয়ে আসতে পারে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে বাঁচতে পরিমিত পরিমাণে একে খাওয়া দরকার। নীচে এর কিছু অপকারিতা তুলে ধরা হলো:
- কারো যদি এতে এলার্জির সমস্যা থেকে থাকে তাহলে এটি খাওয়ার খারাপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।
- এতে থাকা অতিরিক্ত ফাইবারের কারণে বেশি খেলে পেটে ব্যথা হতে পারে।
- বীট উচ্চ পরিমাণে ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন – সি সমৃদ্ধ তাই বেশি খেলে কিডনিতে পাথরের সমস্যা হতে পারে।
- বেশি পরিমাণে গ্রহণ করলে চুলকানি, এলার্জি এবং ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে।
আরও জানতে চাইঃ
ক) বিট (beetroot) কোথায় পাওয়া যায়?
জার্মান বা ইতালি ইউরোপের উত্তর – পূর্ব অংশ থেকে এর উৎপত্তি বলে ধারণা করা হয়। তবে বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ ,উত্তর প্রদেশ এবং মহারাষ্ট্রে বিটরুট বা বিটের ব্যাপকহারে ফলন করানো হয়। বড় শহরগুলোর যেকোনো সুপারশপে বিটফলের দেখা পাওয়া সম্ভব। এখন শীতকালে স্থানীয় বাজারেও একে বিক্রি করতে দেখা যায়।
খ) বাংলাদেশে কোথায় বিট পাওয়া যায়?
ঢাকার মহাখালী,কাওরান বাজারসহ দেশের বড় সবজির বাজারগুলোয় মাঝে মাঝেই বিটরুট পাওয়া যায়। এছাড়াও সারা বছরই দেশের সুপাশপগুলোয় বিটরুট পাওয়া যায়। এছাড়াও আপনি অনলাইন বা বাজার থেকে এর বীজ সংগ্রহ করে বাড়িতেই এটির চাষাবাদ করতে পারেন।
গ) বিট এর দাম কেমন?
বিট হচ্ছে একটি মৌসুমী সবজি। এর মৌসুমে অর্থাৎ শীতকালে এটি প্রতি কেজি ৯০ থেকে ১০০ টাকা দরে বিক্রি করা হয়। তবে বছরের অন্যান্য সময় এটির দাম ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি পর্যন্ত ওঠানামা করে। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, জায়গা ও সময়ভেদে এর দাম উপরনিচ হয়।
পরিশেষে –
প্রকৃতপক্ষে বিট আমাদের সুস্বাস্থ্য রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সবজি। উল্লেখ্য এতে ক্যালোরি কম থাকা সত্ত্বেও প্রচুর পরিমাণে ফাইবার, ফোলেট এবং ভিটামিন সি রয়েছে। সবশেষে বলা যায়, বিট অত্যন্ত সুস্বাদু, স্বাস্থ্যকর ও বহুমুখী উপকারিতায় পরিপূর্ণ।
Very good food blood er somasoy vlo
উপকৃত হলাম