দাঁত আমাদের দেহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। এটি আমাদের খাবার খেতে সাহায্য করে। নরম কিংবা শক্ত যেকোনো ধরনের খাবার চিবিয়ে খেতে সাহায্য করে দাঁত। শুধু যে খেতেই সাহায্য করে তা কিন্তু নয়। এই অঙ্গটি মানুষের সৌন্দর্যেরও একটি অংশ। সুন্দর, সুস্থ দাঁত মানুষকে সুন্দর করে তোলে।
আর এই সুন্দর অঙ্গটিই যদি অসুস্থ হয়, ব্যথা আক্রান্ত হয়? দাঁতের ব্যথা কতটা মারাত্মক হতে পারে সেটা যারা ভুক্তভোগী তারা ভালো করেই জানেন। শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেই এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। অত্যন্ত মারাত্মক এক রোগ এটি। প্রচন্ড ব্যথায় মানুষের এ সময় কিছুই করার থাকে না। আজ আমরা এই দাঁত ব্যথা সম্পর্কেই জানার চেষ্টা করবো।
দাঁতের ব্যথা কমানোর উপায়
অন্য যেকোনো ব্যথা বা যন্ত্রণার চেয়ে অনেক বেশি মারাত্মক ও যন্ত্রণাদায়ক হল দাঁত ব্যথা। অসহ্য যন্ত্রণাদায়ক এই ব্যথা কতটা মারাত্মক হতে পারে সেটা ভুক্তভোগী ভালো করেই জানেন। এই ব্যথা হলে খাবার খেতে অসুবিধা তো হয়ই, পাশাপাশি অসহ্য যন্ত্রণায় রোগীর বসে থাকা, ঘুমানো কিংবা অন্য যেকোনো কাজেও অসুবিধা হয়। কিন্তু এই অসহ্য ব্যথা কমানোর কি কোনো উপায় নেই? আছে। ডাক্তার বা চিকিৎসক দ্বারা চিকিৎসা করানো ছাড়াও আরও বেশ কিছু উপায় রয়েছে এই ব্যথা কমানোর। আসুন জেনে নিই দাঁতের ব্যথা কমানোর উপায়গুলো।
ক) গরম পানি ও লবণ
এক গ্লাস পানি কুসুম গরম করে নিন। তারপর তাতে এক চিমটি লবণ দিয়ে মুখে কিছুক্ষণ রেখে তারপর কুলি করে নিন। এভাবে তিন বেলা এটি করতে পারেন। এতে দাঁত ব্যথা থেকে আরাম পাবেন।
খ) রসুন
ঘরোয়া অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে পরিচিত রসুন দাঁতের ব্যথায় উপকার দিতে পারে, পাশাপাশি দাঁতে থাকা ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলতেও সাহায্য করে। তাই রসুন থেতলে নিয়ে ব্যথা স্থানে লাগাতে পারেন। আবার চাইলে রসুন চিবিয়েও খেতে পারেন। ব্যথা বা যন্ত্রণা না কমলে প্রতিদিন এভাবে লাগাতে পারেন।
গ) সরিষার তেল কিংবা লেবুর রস
সরিষার তেল কিংবা লেবুর রসের সাথে লবণ মিশিয়ে দাঁতে লাগাতে পারেন। এক চামচ লবণ নিয়ে তাতে সরিষার তেল কিংবা লেবুর রস মিশিয়ে মাড়িতে লাগাতে পারেন প্রতিদিন। এতে দাঁতের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস হবে। ব্যথা না কমা পর্যন্ত প্রতিদিন এটি করে যান।
ঘ) হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড
দাঁতের ব্যথা কমাতে ব্যবহার করতে পারেন হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড। এটি ব্যথা কমাতে ও জীবাণু ধ্বংস করতে বেশ কার্যকর। পানির সাথে সমপরিমাণ হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড মিশিয়ে তা দিয়ে কুলি করলে উপকার পাবেন। তবে এ মিশ্রণ কোনোভাবেই গিলা যাবে না। এ মিশ্রণ দিয়ে কুলি করার কিছুক্ষণ পর পরিষ্কার পানি দিয়ে আবার কুলি করে মুখ পরিষ্কার করে নিতে হবে।
ঙ) অ্যালোভেরা জেল
দাঁত ব্যথা হলে ব্যবহার করতে পারেন অ্যালোভেরার জেল। অ্যালোভেরাতে অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান থাকায় এ থেকে তৈরি জেল লাগালে ব্যথায় উপকার পাওয়া যায়। যতদিন ব্যথা না কমে ততদিন এটি লাগাতে পারেন।
চ) গোলমরিচ
লবণের সাথে গোলমরিচের পেস্ট তৈরি করে কিছুক্ষণ দাঁত ও মাড়িতে লাগিয়ে রাখুন। এতে উপকার পাবেন। দিনে ২ থেকে ৩ বার এটি লাগাতে পারেন। এছাড়া ব্যথা না কমা পর্যন্ত প্রতিদিন এটি ব্যবহার করুন।
ছ) লবঙ্গ ও অলিভ অয়েল
লবঙ্গ থেকেও দাঁত ব্যথায় উপকার পেতে পারেন। ২-৩ টি লবঙ্গ নিয়ে থেতলে অল্প অলিভ অয়েলের সাথে মিশিয়ে দাঁতে লাগালে ব্যথা উপশম হয়।
জ) পেঁয়াজ
দাঁতের ব্যথায় আরেকটি সহজ সমাধান হতে পারে পেঁয়াজ। এতে রয়েছে অ্যান্টিসেপটিক গুণ। তাই কাঁচা পেঁয়াজ চিবিয়ে খেতে পারেন কিংবা পেঁয়াজ ঝাঁজের কারণে চিবিয়ে খেতে সমস্যা হলে দাঁতের নিচে পেঁয়াজ রেখে দিতে পারেন। এতেও উপকার হবে।
এছাড়াও দাঁতে প্রচন্ড ব্যথা হলে পেয়ারা পাতা চিবিয়ে খেতে পারেন। পেয়ারা পাতা দাঁত ব্যথায় খুবই কার্যকর। দাঁতে বরফের টুকরো তুলো দিয়ে মুড়ে কিছুক্ষণ ধরে রাখুন। এতেও ব্যথা কমতে থাকবে ধীরে ধীরে।
দাঁতের মাড়ি ব্যথা কমানোর উপায়
শুধু যে দাঁতই ব্যথা হয় এমন কিন্তু নয়। দাঁতের পাশাপাশি মাড়িও কিন্তু ব্যথা হতে পারে। আর মাড়ির ব্যথাও একইরকম যন্ত্রণাদায়ক হয়। এই ব্যথাও মানুষকে মারাত্মক ভোগান্তি দেয়। এবার আমরা জানবো দাঁতের মাড়ি ব্যথা কমানোর উপায়। আসুন জেনে নিই।
১) সেঁক দেওয়া
দাঁতের মাড়ি ব্যথা হলে অন্যতম কার্যকর একটি উপায় হল সেঁক দেওয়া। সেঁক গরম পানি দিয়েও দিতে পারেন, আবার ঠান্ডা পানি দিয়েও দিতে পারেন। যেভাবেই দেন তাতেই কাজ হবে। কুসুম গরম পানিতে পরিষ্কার কাপড় ভিজিয়ে তা দিয়ে সেঁক দিতে পারেন। অপরদিকে ঠান্ডা পানির ক্ষেত্রে বরফ পরিষ্কার কাপড়ে মুড়িয়ে তা দিয়ে সেঁক দিতে পারেন।
২) লবণ পানি
দাঁতের মাড়ি ব্যথা কমানোর আরেকটি দারুণ ও কার্যকর উপায় হল লবণ পানি। কুসুম গরম পানিতে এক চিমটি লবণ দিয়ে তা মুখে নিয়ে কিছুক্ষণ রেখে পরে তা দিয়ে কুলি করে নিন। এতে আরাম পাবেন ব্যথা থেকে। প্রতিদিন ৩ বেলা এটি করতে পারেন ব্যথা না কমা পর্যন্ত।
৩) গ্রিন টি
গ্রিন টি কিংবা ব্ল্যাক টি এর টি ব্যাগ নিয়ে গরম পানিতে ভিজিয়ে এরপর কিছুক্ষণ ঠান্ডা করে নিন। ব্যাগ ঠান্ডা হলে ব্যাগটি আক্রান্ত মাড়িতে লাগিয়ে রাখুন। ধীরে ধীরে ব্যথা কমতে শুরু করবে।
৪) কাঁচা হলুদ
কাঁচা হলুদের পেস্ট বানিয়ে এতে অল্প পরিমাণ পানি মিশ্রিত করুন। এরপর মিশ্রণটি আক্রান্ত মাড়িতে বেশ কিছুক্ষণ লাগিয়ে রাখুন। এতে আরাম পাবেন ও ব্যথা কমতে শুরু করবে। ব্যথা না কমা অবধি প্রতিদিন এভাবে লাগিয়ে যেতে পারেন।
দাঁতের ব্যথা কমানোর ওষুধ
দাঁতের ব্যথায় অসহ্যকর পরিস্থির সৃষ্টি হয়ই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। এ পরিস্থিতিতে ঘরোয়া বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করতে পারেন। লবণ পানি দিয়ে কুলি করা, পেয়ারা পাতা চিবানো, লবঙ্গ পেস্ট করে লাগানো, পেঁয়াজ কাঁচা চিবিয়ে খাওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন উপায় ব্যবহার করতে পারেন।
তবে এ সকল উপায় থেকে যে ব্যথা পুরোপুরি কমবেই এমন কিন্তু নয়। কমতেও পারে আবার নাও কমতে পারে। তখন চাইলে ব্যথানাশক ট্যাবলেট বা ওষুধ খেতে পারেন। তবে ওষুধ খাওয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই শ্রেয়।
এছাড়াও একদমই না কমলে এন্টিবায়োটিক ওষুধও খেতে হতে পারে এবং সেটা অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে। সাধারণত দাঁতের ব্যথায় ডাইক্লোফেনাক সোডিয়াম (ডাইভন), ইবুপ্রোফেন, ইত্যাদির মতো ব্যথানাশক ওষুধ দেওয়া হয়। এছাড়া এন্টিবায়োটিকের ক্ষেত্রে এমোক্সিসিলিন এবং অগমেনটিন ইত্যাদি এর মত ওষুধ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা।
পরিশেষে-
দাঁত ব্যথা হলে তা আপনাকে প্রচন্ড যন্ত্রণা দিবে এটাই বাস্তবিক। এ ক্ষেত্রে তাই অধৈর্য না হয়ে ঘরোয়া বিভিন্ন উপায় চেষ্টা করুন। ঘরোয়া উপায়ে অনেক সময়েই ব্যথা উপশম হতে শুরু করে। আর দাঁত ব্যথা হলে আপনি চাইলেও যেহেতু শক্ত খাবার খেতে পারবেন না তাই নরম খাবার খাওয়াই ভালো।
এছাড়া ঠান্ডা পানীয়, আইসক্রিম ইত্যাদি খাবার পরিহার করুন এ সময়। কারণ এ সকল খাবার ব্যথা বাড়িয়ে দিতে পারে। আর অতি অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিৎ। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো প্রকার ওষুধ সেবনও উচিৎ নয়। এতে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তাই দাঁত ব্যথায় অধৈর্য্য না হয়ে ঘরোয়া বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করুন এবং চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।