ডিম প্রতিদিন খাবেন নাকি মাঝে মাঝে খাবেন?


ডিম খেতে পছন্দ করেন না এমন মানুষ হয়ত খুব কম আছে। একটি সুষম খাদ্য হিসেবে ডিমকে প্রোটিন এবং পুষ্টি উপাদানের ‘Power House’ বলা হয়ে থাকে। এটি পুষ্টি উপাদানে ভরপুর একটি খাদ্য। আমাদের দেহ গঠনের জন্য যে ৮ টি অ্যামাইনো অ্যাসিড প্রয়োজন, ডিমে তার সব কয়টি রয়েছে। এবং ডিম সহজপাচ্যও বটে।

ডিম কেন খাবেন?

কেউ বলে থাকেন- প্রতিদিন খাবেন, কেউ বলেন খাবেন না, প্রতিদিন খেলে মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে। আবার এমনও শোনা যায় – ডিমের কুসুম বাদ দিয়ে শুধু সাদা অংশ খাবেন। আবার এও শোনা যায় – সপ্তাহে বেশি হলে দুটো খাবেন। ‍তবে যে যাই বলুক সব বয়সের মানুষের জন্য শিশু থেকে বৃদ্ধ, এটি একটি অত্যন্ত উপাদেয় খাদ্য। এবার জানা যাক কেন আমরা ডিম খাবো।

ডিমে রয়েছে উচ্চমাত্রার প্রোটিন, যা শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো খুবই জরুরি। তাই প্রতিদিন একটি খাওয়া উচিত। চিকিৎসকরা শারীরিক দুর্বলতায় সকালের নাশতায় সিদ্ধ ডিম খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন ।

সাদা ও বাদামি রং এর ডিম

ডিমের গুণাগুণ

প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় ৫০-১৭৫ গ্রাম প্রোটিন প্রয়োজন। প্রোটিন মাংসপেশি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একটি ডিম গ্রহণে ৬-৭ গ্রাম প্রোটিন পাওয়া যায়। ডিমে আছে-

প্রোটিন, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট, কোলেস্টেরল, বিভিন্ন ভিটামিন, খনিজ, ফ্যাটি অ্যাসিড এবং ২০ টি গুরুত্বপূর্ণ অ্যামিনো অ্যাসিড, যা ছাড়া শরীরে প্রোটিন তৈরি হয় না। এ কারনেই ডিম একটি সুপার ফুড, যাতে এতগুলো প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান একসাথে পাওয়া যায়।

প্রতিদিন ডিম খেলে কি হয়?

প্রতিদিন কাজ করার জন্য আমাদের যে শক্তির দরকার হয়, ডিম খেলে আমরা সহজেই তা পেতে পারি। ডিমে থাকা ভিটামিন বি ১২ আমাদের খাওয়া খাদ্যকে শক্তিতে রূপান্তর করে।

  • রয়েছে ভিটামিন ডি, যা পেশীকে শক্তিশালী রাখতে সাহায্য করে।
  • এর ভিটামিন দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে সহায়তা করে। এছাড়াও ডিমের ক্যারোটিনয়েড, লুটেন ও জিয়েক্সেনথিন চোখের ছানি কমাতে সাহায্য করে।
  • ডিমের সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে এটি ওজন কমাতে সাহায্য করে।
  • একটি ডিমে রয়েছে ৬.৫ গ্রাম প্রোটিন বা ৭০-৮৫ ক্যালরি। যা প্রতিদিনের প্রোটিন এর চাহিদার অনেকটা পূরণ করে।
  • ডিমে রয়েছে আয়রন, জিংক, ফসফরাস। যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
  • ফসফরাস হাড় ও দাঁত মজবুত রাখে।
  • ডিম কোলেস্টেরল বাড়ায় না। দিনে একটা খেলেও আপনার লিপিড প্রোফাইল কোনো প্রভাব পড়বে না।
  • একটি ডিমে প্রায় ৩০০ মাইক্রোগ্রাম কোলাইন থাকে। যা কার্ডিওভাস্কুলার সিস্টেম, স্নায়ু, যকৃত ও মস্তিষ্কের জন্য ভালো।
  • নখ ভেঙে যাওয়া এবং চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে এটি অত্যাবশকীয় খাদ্য। ডিমে থাকা সালফার অনেকটা যাদুর মতো কাজ করে থাকে।    
  • ডিমে থাকা ভিটামিন ই আমাদের কোষে আর ত্বকে থাকা ফ্রি র‍্যাডিক্যাল ধ্বংস করে দেয়। তাই ক্যানসারের ঝুঁকি কমে। এছাড়াও নতুন কোষ তৈরিতেও সাহায্য করে থাকে।
  • নিয়মিত (সপ্তাহে ৬টি) খাওয়া হলে ব্রেস্ট ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়।   
ডিম ও সব্জির স্যুপ

ডিম কিভাবে খাওয়া উচিত?

ডিম আমরা বিভিন্নভাবে খেয়ে থাকি – ভাজি, ভুনা, সিদ্ধ, বা ডিমের কালিয়া ইত্যাদি। তবে বেশিক্ষণ রান্না হলে এর ক্যালরি কমে যায়। সিদ্ধ ডিমে যে পরিমাণ পুষ্টি পাওয়া যায় রান্না করা ডিমে তা পাওয়া যায় না।

পুষ্টিমান ঠিক রেখে ডিম খেতে হবে। সুষম খাদ্য হিসেবে ডিমে বেশি লবণ, তেল, বা ঘি না দেয়াই ভালো। এতে ডিমের ফ্যাট আরো বেড়ে যাবে ।

ভেজে খেলে তাপ স্থিতিশীল তেল (heat stable oil) যেমন, এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ ওয়েল বা সূর্যমুখী তেল দিয়ে ভাজুন। তাছাড়া সবজি ফ্যাট হজমে বাধা দেয়, তাই ডিমের সঙ্গে সালাদ বা সবজি খাওয়া উত্তম। যদি পুরো ক্যালরী পেতে চান তবে পোচ বা সেদ্ধ খান। সাধারণত কোনো মশলা ছাড়া ‍ডিম- সিদ্ধ, আধা সিদ্ধ, এবং তেলবিহীন পোচ করে খাওয়া স্বাস্থ্যসম্মত।

খালি পেটে ডিম খেলে কি হয়?

সুষম খাদ্যের আধার ডিম। রোজ খালি পেটে সেদ্ধ ডিম খাওয়ার উপকারিতা অনেক-

  • খালি পেটে ডিমসেদ্ধ খওয়া হলে শরীরের ক্লান্তিভাব দূর হয় ও কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ডিমের স্বাস্থ্যকর ফ্যাট এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান দেহের প্রয়োজনীয় জ্বালানি চাহিদা পূরণ করে।
  • সকালে ডিম খেলে দিনের অনেকটা সময় ক্ষিদে পায় না। ফলে খাওয়ার পরিমাণ কমে। সেই সঙ্গে অতিরিক্ত ক্যালরি জমার সম্ভাবন হ্রাস পায়। ফলে ওজন কমতে শুরু করে।
  • ডিমে রয়েছে প্রায় ৯ রকমের অ্যামাইনো অ্যাসিড যা মস্তিষ্কে সেরাটোনিন নামক হরমোনের ক্ষরণ বাড়ায়, এই হরমোন দুশ্চিন্তা বা অ্যাংজাইটি কমিয়ে মন ভাল করে দিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এবং বুদ্ধির বিকাশ ঘটে, স্মৃতিশক্তি এবং মনোযোগও বৃদ্ধি পায়।
  • ডিমের অ্যালবুমিন পেশির গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি শরীরের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্যও এটি খাওয়া জরুরি।
  • ডিমের ভিটামিন এ ও ই চুলের গোড়ার পুষ্টির ঘাটতি দূর করে, ফলে চুল পড়া কমে।
  • ডিমে উপস্থিত অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, লুটিন এবং জিয়েক্সসেনথিন দৃষ্টিশক্তির উন্নতিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।

ডিমের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া:

ডিমে সালমোনেলা নামক ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া যায়। যা মুরগি থেকে আসে। যদি সঠিকভাবে ডিম সিদ্ধ না করা হয় তবে, এই ব্যাকটেরিয়া স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে।

অনেকেরই ডিমে অ্যালার্জি থাকে, তাহলে এটি খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। তাই সীমিত পরিমাণে (প্রতিদিন ১/২ টি) ডিমে কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

রূপচর্চায় ডিম ও মধুর হেয়ার প্যাক:

ডিমের যেমন রয়েছে স্বাস্থ্য উপকারিতা তেমনি রূপচর্চায়ও এর জুড়ি নেই। যাদের চুল দ্রুত বাড়ে না বা চুল পড়ে যাচ্ছে তারা ব্যবহার করতে পারেন ডিম, অলিভ অয়েল ও মধুর হেয়ার প্যাক। ডিমে রয়েছে প্রোটিন ও জিঙ্ক এবং মধু ও অলিভ অয়েল প্রাকৃতিক ময়েশ্চারাইজারের কাজ করে।

চুলের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য সপ্তাহে দুই দিন ব্যবহার করতে পারেন। জেনে নিন কীভাবে তৈরি করবেন-  

উপাদান গুলো ১ টেবিল চামচ করে নিয়ে একটি মিশ্রণ তৈরি করুন। মিশ্রণটি ভালো ভাবে নেড়ে নিন। মাথার তালু ও চুলে লাগান। ২০ মিনিট পর ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন চুল।

(এ প্যাক ব্যবহারের পর ঠাণ্ডা পানি দিয়ে চুল পরিষ্কার করতে হবে। গরম/হালকা গরম পানি ব্যবহার করলে চুলে ডিম জমে যেতে পারে। এবং শ্যাম্পু করতে হবে।)

আরও জানতে চাইঃ 

ক) কাঁচা ডিম খেলে কি হয়?

উত্তরঃ অনেকেরই ধারণা কাঁচা ডিমে বেশি শক্তি পাওয়া যায়- কথাটি একেবারে ভুল। এর কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যখ্যা নেই। বরং এ থেকে রোগব্যাধি হতে পারে। এছাড়াও কাঁচা ডিম সহজে হজম হয় না। কাঁচা খেলে বরং শরীরে বায়োটিনের অভাব হয়। এতে ওজন কমা, জিহ্বার রুক্ষতা, ত্বকের প্রদাহ ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে।

খ) কলা এবং ডিম একসঙ্গে খাওয়া কি বিপজ্জনক?

উত্তরঃ না। ডিম-কলা একসাথে খেলে আপনার কোনারকম সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার কথা নয়। বরং এতে আপনার স্বাস্থ্যের উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে ।

গ) ডিম খেলে কি ওজন বাড়ে?

উত্তরঃ ডিম খেলে দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা থাকে, ফলে অতিরিক্ত খাওয়ার চাহিদা কমে, তাই যাদের ওজন বেশি তাদের ওজন কমে। আবার যারা স্বাস্থ্যহীনতায় ভুগছেন, মোটা হতে চান, তাদের সুসাস্থ্যের জন্য এটি খুবই কার্যকর।

ঘ) প্রতিদিন কয়টা ডিম খাওয়া যাবে?

উত্তরঃ প্রতিদিন একটি খাওয়া স্বাস্থ্যসম্মত।

আধুনিক গবেষণা ডিম খাওয়া নিয়ে অনেক বিতর্কের অবসান করে দিয়েছে। তাই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বিবেচনায় নিয়ে, প্রয়োজনে পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিয়ে, প্রতিদিন একটি করে খাওয়া শুরু করে দিন।

আরও পড়তে পারেনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.