হাজার বছর ধরে ভারতবর্ষে আম একটি গুরুত্বপূর্ণ ফল। বর্তমানে এই রঙিন, মিষ্টি ফলটি শুধু ভারতবর্ষ কিংবা বাংলাদেশেই নয় বরং সারা বিশ্বেই জনপ্রিয়। বিভিন্ন ধরণের উপর নির্ভর করে আমের ওজন কয়েক আউন্স থেকে পাঁচ পাউন্ডেরও বেশি হতে পারে। আমের রয়েছে বিভিন্ন জাত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি আমের জাত হলো- ফজলি, ল্যাংড়া, হিম সাগর, নাগ ফজলি, আলতাপেটি, বউ পছন্দ ইত্যাদি। এই সকল আম বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয় ও খেতেও অত্যন্ত সুস্বাদু। শুধু যে খেতে সুস্বাদু তা কিন্তু নয়, আমের পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা রয়েছে অনেক।
বাংলাদেশের রাজশাহী জেলা মূলত আমের জন্য বিখ্যাত। তবে বাংলাদেশের পাশাপাশি পুরো ভারতবর্ষেই আমের চাষাবাদ ও ফলন হয়। এছাড়া রাজশাহী ছাড়াও বাংলাদেশের চাপাইনবাবগঞ্জ, সাতক্ষিরা জেলাও আমের জন্য বেশ বিখ্যাত। এর পাশাপাশি বান্দরবান জেলায় রয়েছে থাইল্যান্ডের একটি আমের প্রজাতি যা মূলত পাহাড়ি আম নামে পরিচিত। কেবলমাত্র বান্দরবান জেলাতেই এটি পাওয়া যায়। এই ফলটি শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। আজকে আমরা এই অত্যন্ত জনপ্রিয় ফলটির নানাবিধ পুষ্টি গুণ ও উপকারিতা সম্পর্কে জানবো। তো আসুন আজ জেনে নিই কেন আম খাবো? আর এর পুষ্টিগুণ বা উপকারিতাই বা কি?
আম কেন খাবো?
আম একাধারে যেমন অত্যন্ত সুস্বাদু একটি ফল তেমনই এটি খুবই পুষ্টি সমৃদ্ধ একটি ফল। এতে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি ও দেহের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন খনিজ উপাদান ও ভিটামিন রয়েছে। এ সকল খনিজ উপাদান ও ভিটামিন আমাদের দেহের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এবার আসুন জেনে নেওয়া যাক এর উপকারিতা গুলো:
আমের স্বাস্থ্য উপকারিতা
আমে রয়েছে ভিটামিন, খনিজ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সুবিধা প্রদান করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ভিটামিন-K দেহের রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে এবং রক্তাল্পতা প্রতিরোধেও সাহায্য করে। এটি হাড়কে শক্তিশালী করতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এছাড়াও এই ফলটি ভিটামিন সি সমৃদ্ধ, যা রক্তনালী গঠন এবং স্বাস্থ্যকর কোলাজেন গঠনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং একই সাথে রোগ নিরাময়েও সাহায্য করে। পাশাপাশি দেহের ভিটামিন-সি এর ঘাটতিও পূরণ করে। এসবের পাশাপাশি আম আরও যে সকল স্বাস্থ্য উপকারিতা দেয় তা হলো:
হার্টের উপকারিতায়
আম হৃদপিন্ডের কার্ডিওভাসকুলার সিস্টেমকে সাহায্য করার জন্যও সহায়ক। এই ফলটি ম্যাগনেসিয়াম এবং পটাশিয়ামের একটি দারুণ উৎস। আর এই ম্যাগনেসিয়াম আর পটাশিয়াম উভয়ই রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং নাড়ির স্পন্দনকে ঠিক রাখতে সাহায্য করে। উপরন্তু, আম হল ম্যাঙ্গিফেরিন নামে পরিচিত একটি যৌগের উৎস, যা গবেষণায় দেখা গেছে হৃদপিন্ডের প্রদাহ কমাতে সক্ষম হতে পারে।
চোখের উপকারে
আমের মধ্যে রয়েছে এমন সব পুষ্টিগুণ যা চোখকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। তাদের মধ্যে থাকা দুটি মূল পুষ্টি উপাদান হল অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট লুটেইন এবং জেক্সানথিন।
এই পুষ্টি উপাদানগুলি বিশেষত রেটিনার কেন্দ্রে ঘনীভূত হয়, যাকে রেটিনার ভিতরে ম্যাকুলা বলা হয়। লুটেইন এবং জেক্সানথিন প্রাকৃতিক সানব্লক হিসাবে কাজ করে যা অতিরিক্ত আলো শোষণ করে। এছাড়াও এগুলো ক্ষতিকারক নীল আলো থেকে চোখকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। আম ভিটামিন-এ এর একটি ভাল উৎস, যা চোখের স্বাস্থ্যকে ভালো রাখতে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
এছাড়াও এই ফল খাওয়ার ফলে ভিটামিন-এ এর অভাব পূরণ হওয়ার ফলে রাতকানা রোগের ঝুঁকি কমে যায় এবং পাশাপাশি এটি চোখের নিচে কালো দাগ জমা প্রতিরোধ করতেও সাহায্য করে।
হজমের ক্ষেত্রে আমের উপকারিতা
আম পরিপাকতন্ত্রকে স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে। এই ফলটি অ্যামাইলেজ যৌগ এবং খাদ্যতালিকায় থাকা প্রয়োজনীয় ফাইবার উভয়ই বহন করে, যা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য পারে। এতে থাকা অ্যামাইলেজ যৌগগুলি পেটের অন্যান্য খাবারগুলিকে দ্রবীভূত করতে সাহায্য করে এবং কঠিন স্টার্চগুলি ভেঙে দেয়। এর ফলে সহজেই খাদ্য পরিপাক হয়। এছাড়া আমের মধ্যে থাকা ফাইবার কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে বেশ কার্যকরী ভূমিকা রাখে।
ডায়বেটিস প্রতিরোধে
অন্যান্য ফলের তুলনায় তাজা আমে অধিক পরিমাণে প্রাকৃতিক ভাবেই সুগার বা চিনি থাকে৷ এতে মনে হতে পারে যে এটি ডায়াবেটিসের মতো রোগে আক্রান্ত রোগীদের জন্য উদ্বেগজনক হতে পারে। কিন্তু বাস্তবিক তা নয়। কোনো গবেষণায় এটি প্রমাণ হয় নি যে, এই ফল ডায়াবেটিস বাড়ায়।
বরং, একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে যারা ১২ সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন তাদের খাদ্যতালিকায় ১০ গ্রাম সংরক্ষিত শুকনো আম রেখেছেন তাদের রক্তে শর্করার মাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে উন্নতি হয়। এছাড়াও আরেকটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায় যে, ভিটামিন সি এবং ক্যারোটিনয়েড সমৃদ্ধ ফল এবং শাকসবজি ডায়াবেটিসের শুরু হওয়া প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে। আর আম এই উভয় পুষ্টিতেই উচ্চমানের, তাই এটিও একই রকম উপকার দিতে পারে, যদিও এক্ষেত্রে আরও গবেষণা প্রয়োজন।
তবে যেহেতু আমে প্রাকৃতিকভাবেই চিনির পরিমাণ বেশি তাই একসাথে একইসময়ে বেশি পরিমাণে এটি খেলে ডায়াবেটিস রোগীরা উপকারের পরিবর্তে ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন। তাই এক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন জরুরী।
ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে আম
আম বিটা-ক্যারোটিন সমৃদ্ধ, বিটা-ক্যারোটিন হল একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা আমের মধ্যে পাওয়া যায় এমন অনেকগুলির মধ্যে অন্যতম একটি। এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্টটি কোষের ক্ষতি করতে পারে এমন ক্ষতিকর জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং সম্ভাব্য ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
আম হলো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর একটি অন্যতম উৎস। ১৬৫ গ্রামের একটি আমে প্রতিদিনের ১০% ভিটামিনের চাহিদা পূরণ হয় যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
পাশাপাশি আমে রয়েছে ভিটামিন-সি যা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে অন্যতম কার্যকর একটি ভিটামিন। এই ভিটামিনটি দেহের রোগ প্রতিরোধকারী শ্বেত রক্তকণিকা বাড়ায় এবং ত্বকের জীবাণু প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে। এছাড়াও আম রোগ প্রতিরোধকারী ভিটামিন-ই, কপার, ফোলেট ইত্যাদিও বহন করে।
আম এর পুষ্টি উপাদান
আমে প্রচুর পরিমাণে ফোলেট রয়েছে, যা খুবই স্বাস্থ্যকর এবং এটি কোষ বিভাজন ও ডিএনএ ডুপ্লিকেশনের জন্য ব্যবহৃত হয়। চিকিৎসকরা পরামর্শ দিয়ে থাকেন যে গর্ভবতী মায়েরা প্রতিদিন কমপক্ষে ০.০৪ মি.গ্রা. ফোলেট খেলে শিশুর জন্মগত ত্রুটিগুলি এড়ানোতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এছাড়াও আমে আরও যেসকল পুষ্টি উপাদান রয়েছে:
- ভিটামিন এ
- ভিটামিন সি
- ভিটামিন কে
- পটাসিয়াম
- বিটা-ক্যারোটিন
- কোলিন
- ম্যাগনেসিয়াম
একটি মাঝারী সাইজের আমে থাকে:
- ক্যালোরিঃ ২০২
- প্রোটিনঃ ৩ গ্রাম
- চর্বিঃ ১ গ্রাম
- কার্বোহাইড্রেটঃ ৫০ গ্রাম
- ফাইবারঃ ৫ গ্রাম
- সুগারঃ ৪৫ গ্রাম
আম খাওয়ার আগে যে বিষয়ে লক্ষ্য রাখা উচিৎ
আমের ত্বকে ইউরোশিওল নামক একটি যৌগ রয়েছে, যা বিষাক্ত। ইউরোশিওল হল বিষ আইভি, উদ্ভিদ স্পর্শ করার পর যেটির কারণে চুলকানি ও লাল ফুসকুড়ি হয়। যদিও আমের ত্বকে বিষ আইভির তুলনায় কম ইউরোশিওল থাকে, তবুও এটি ফুসকুড়ি এবং অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়াও এই ফলের খোসাতে থাকা এই বিষ এলার্জির কারণ হতে পারে। তাই যাদের এলার্জির সমস্যা আছে তাদের পাশাপাশি সকলেরই উচিৎ এই ফলের খোসা ভালো করে ফেলে দিয়ে খাওয়া উচিৎ। অন্যথায় নানাবিধ সমস্যা দেখা দেওয়া অস্বাভাবিক নয়।
আম কীভাবে খাবো?
বাংলাদেশে মূলত গ্রীষ্মকালেই আম পাওয়া যায়। এ সময় প্রচুর পরিমাণে এই ফল পাওয়া যায়। বাজারে তখন এর অনেক চাহিদা থাকে। বিভিন্ন ভাবে এই সুস্বাদু ও পুষ্টিকর ফলটি খাওয়া যায়। ভালো করে খোসা ছাড়িয়ে টুকরো করে খাওয়াই মূলত জনপ্রিয় একটি পদ্ধতি। এছাড়াও অনেকে টুকরো করা ছাড়াও খোসা ছাড়িয়ে খেতে বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তবে এর পাশাপাশি এই ফলের শরবত গরমের দিনে বেশ আরামদায়ক পানীয়। প্রচন্ড গরম ও তাপদাহের সময় আমের এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত দেহে স্বস্তি এনে দেয়।
এছাড়াও আমের চাটনি করে খাওয়া যায় যা খুবই মুখরোচক। কাঁচা আমের শরবতও গরমের দিনে একটি জনপ্রিয় পানীয়। এর পাশাপাশি গ্রাম-বাংলায় কাঁচা আম দিয়ে ডাল রান্না করে খাওয়া খুবই পরিচিত। গরমের দিনে কাঁচা আমের টক ডাল খুবই জনপ্রিয় একটি খাবার বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এছাড়াও বিভিন্ন তরকারিতে কাঁচা আম দিয়ে রান্না করা যায় যা খাবারের স্বাদ বাড়িয়ে দিতে সক্ষম এবং একইসাথে এটি বেশ মুখরোচকও। মূলত এই পদ্ধতিগুলোই এই ফল খাওয়ার জনপ্রিয় কিছু পদ্ধতি।
পরিশেষে –
আম খুবই পরিচিত একটি ফল। বাংলাদেশের মানুষের কাছে গ্রীষ্মকাল আসা মানেই এই ফল খাওয়ার এক উৎসব। তবে এর পুষ্টি গুণ সম্পর্কে অনেকেই অবগত নন। এতে থাকা নানাবিধ পুষ্টি উপাদান আমাদের দেহের জন্য খুবই জরুরি। তাই এই ফলটি খেতে পারলে শিশু কিংবা বয়স্ক সকলেরই পুষ্টির চাহিদার একটি বড় অংশ সহজেই মিটানো সম্ভব।
তথ্যসূত্র –