বর্তমান সময়ে অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটির অন্যতম কারণ হচ্ছে অনিয়মিত জীবনযাপন ও কায়িক পরিশ্রমের প্রতি অনীহা। এটি কমানোর জন্য যে বিষয়টির দিকে খেয়াল রাখা উচিত সেটি হচ্ছে আপনি যে পরিমাণ ক্যালরি খরচ করেছেন তার থেকে কম ক্যালরি গ্রহণ করুন, এর ফলে আপনার অতিরিক্ত ওজন কমে যাবে। আপনার অতিরিক্ত স্থূলতা কমাবার ক্ষেত্রে সর্বদা একজন চিকিৎসক বা পুষ্টিবিদ আপনাকে গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ দিয়ে সাহায্য করতে পারেন।
অতিরিক্ত ওজন কমানোর সহজ উপায়:
অতিরিক্ত ওজন আমাদের দৈহিক সৌন্দর্যকে নষ্ট করে দেয়। অনেকেই ভেবে থাকেন মাসে ১০/২০ কেজি ওজন কমিয়ে ফেলবেন, তবে এটি করা কখনোই উচিত নয় এর ফলে আপনার শরীরের উপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। সেকারণে ধীরে স ওজন কমানোর চেষ্টা করুন। এটি করার কয়েকটি সহজ উপায় নীচে তুলে ধরা হলো:
ক) মসলা বিশিষ্ট খাবার খান:
কথাটি হাস্যকর মনে হতে পারে তবে হলুদ, ধনে, জিরে গুঁড়া ইত্যাদি মসলা আপনার ওজন কমাতে সাহায্য করবে। অনেকে বলে থাকেন সেদ্ধ খাবার খেলে দ্রুত ওজন কমে তবে এই ধারণাটি ভুল।
খ) চিনিকে বিদায় বলুন:
বেশি চিনি খাওয়া থেকে বিরত থাকাই ভালো। প্রতি ১ চা চামচ চিনিতে মোট ১৬ শতাংশ ক্যালরি থাকে। আপনারা যে ফল খান সেগুলোতে প্রাকৃতিকভাবেই কিছুটা চিনি থাকে যাকে ফ্রুকটোজ বলা হয়। তাই এগুলো খাওয়ার সময় আলাদা চিনি খাওয়া উচিত নয়। তবে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই চিনি খাওয়া দরকার। অতিরিক্ত ক্যালােরি আপনার দেহে জমা হয়ে স্থূলতাকে বাড়িয়ে দিবে।
গ) পানি পান করুন:
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, নিয়ম মেনে পানি পান আপনার অতিরিক্ত ওজন কমাতে সাহায্য করবে। পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি আপনার দেহ থেকে অতিরিক্ত টক্সিন পদার্থকে বের করে দেবে। একটি গবেষণা অনুযায়ী, ৫০০ মিঃলিঃ পানি ১ ঘন্টার মধ্যে আপনার ২৪-৩০% ক্যালােরি খরচ করাতে পারে। বিশেষ করে মধ্য বয়সী বা বয়স্ক তাদের জন্য এটি অত্যন্ত ফলপ্রসূ।
ঘ) ছোট প্লেটে খাবার খান:
নিজের খাবার প্লেট বদলে দিন। বিশিষ্ট পুষ্টিবিদদের মতে, ছোট থালায় খাবার রাখলে আসলে খাবার বেশি মনে হবে কিন্তু সত্যিকার অর্থে এর ফলে কম খাওয়া হয়। কম কনট্রাস্ট রঙের থালা ব্যবহার করুন। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১২ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্লেটের রঙ যদি খাবারের রঙের কাছাকাছি হয় তাহলে বুফেতে মানুষ ২২ শতাংশ খাবার কম খায়।
ঙ) বেশি করে সবজি খান:
খাবার খাওয়ার আগেই ভালো করে সবজি খান। এই পদ্ধতিতে আপনি ক্যালোরি জাতীয় খাবারকে এড়িয়ে যেতে পারবেন। বেশি শর্করা বিশিষ্ট খাদ্য যেমন মাছ-মাংস খাওয়ার আগে সবজির তরকারি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
ব্যায়াম ছাড়া ওজন কমানোর উপায়
পুষ্টিবিদ এবং অভিজ্ঞ ডায়েটিশিয়ানরা সবসময় পরামর্শ দিয়ে থাকেন, ওজন কমানোর জন্য তাড়াহুড়ো না করে বরং ধীরে ধীরে চেষ্টা করলেই তা বেশি কাজে আসে। তাই হুটহাট ব্যায়াম করে ঘাম না ঝড়িয়ে অল্প অল্প করে খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপনে পরিবর্তন নিয়ে আসায় শ্রেয়। নীচে ব্যায়াম ছাড়া ওজন কমানোর কিছু উপায় সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
ক) নাচ:
নাচ একটি ভালো শারীরিক কসরত। আপনি যদি নাচ নাও জানেন তারপরও গানের তালে হালকা হালকা পা দোলাতে থাকুন। আরো ভালো ফলাফল পেতে ‘জুম্বা নাচ’ অনুশীলন করতে পারেন। তারুণ্য ধরে রাখতেও এটি অত্যন্ত উপকারী।
খ) ধীরে ধীরে খাবার খান:
বেশি দ্রুত খাবার খেলে আমরা প্রয়োজনের অধিক খাবার খেয়ে ফেলতে পারি। সেজন্য আস্তে আস্তে খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন ফলে আপনার পেট ঠিকঠাকভাবে ভরবে। জাপানের কিউসু বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, যেসকল ব্যাক্তিরা ধীরে খাবার খান তাদের ওজন দ্রুত খাবার খাওয়া ব্যাক্তিদের থেকে কম হয়। তাই অতিরিক্ত ওজন কমাতে আমাদের এই অভ্যাসটি অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে।
গ) জগিং:
জগিং একটি হালকা শারীরিক ব্যায়াম। ৮-৮০ শারীরিক ভাবে সুস্থ যে কেউ এই ধরনের ছোটোখাটো ব্যয়াম অনুশীলন করতে পারে। সকালে হালকা হালকা জগিং করলে শারীরিক গঠনও ঠিক থাকবে এবং অতিরিক্ত চর্বিও ঝড়ে পড়বে।
ঘ) ঘর পরিষ্কার করুন:
পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ। এই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার অভ্যাসই আপনার অতিরিক্ত ওজনকে কমিয়ে আনতে পারবে। আপনার বাড়িঘরে ছোটোখাটো কাজ করুন এতে আপনার শরীরের মেদ কমবে।
ঙ) দ্রুত রাতের খাবার খান:
রাতে যত দ্রুত সম্ভব রাতের খাবার খেয়ে নিন। খাবার খেয়েই শুয়ে পড়া স্থূলতার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। বিশেষজ্ঞদের ধারণা অনুযায়ী, সন্ধ্যা ৬ থেকে ৭টার মধ্যে খাবার খাওয়া হলে দেহে কম ক্যালোরি গ্রহণ করা হয় এবং শরীর তা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে। রাতে খাবার খাওয়ার পরপরই ঘুমিয়ে পড়লে ক্যালোরি জমতে জমতে ওজন বেড়ে যায়।
শীতে ওজন কমানোর সহজ উপায়
শীতকাল হচ্ছে ওজন কমানোর সবচেয়ে ভালো সময়। এই সময়ে সঠিক ও কম ক্যালোরিযুক্ত খাবার গ্রহণ করলে খুব সহজেই অতিরিক্ত ওজন কমিয়ে আনা সম্ভব। শীতে প্রচুর শাকসবজি পাওয়া যায়। এসব খাবারে প্রচুর পরিমাণে শর্করা, আমিষ, ভিটামিন এবং প্রচুর পরিমাণে পানি থাকে। এসব খাদ্য উপাদানে শারীরিক গঠন ঠিক রাখার পাশাপাশি ওজন কমাতেও সমান পারদর্শী।
শীতের প্রায় প্রতিটি খাবারেই আঁশ ও প্রচুর পরিমাণে এন্টি অক্সিডেন্ট উপাদান থাকে যেগুলো অতিরিক্ত ওজন কমিয়ে আনতে সক্ষম।
ক) টক দই দিয়ে ওজন কমানোর উপায়
অতিরিক্ত ওজন কমাতে টকদই অনেক উপকারে আসে। এতে থাকা উপকারী ব্যাকটেরিয়া সমূহ শরীর থেকে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া গুলোকে দূর করে। এতে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম থাকে যা অতিরিক্ত মেদ জমতে প্রতিরোধ করে। দুধ থেকে তৈরি হলেও এতে খুব কম পরিমাণে ফ্যাট থাকে।
চর্বিতে থাকা কর্টিসল নামক হরমােনটি স্থূলতা বাড়াতে কাজ করে কিন্তু ক্যালসিয়াম কর্টিসল এই হরমােন তৈরিতে বাধা দেয় ফলে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে। আবার একইসঙ্গে অতিরিক্ত টকদইও আমাদের শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর। তাই আমাদের সকলের উচিত ওজন কমাতে সঠিক পরিমাণে নিয়মিত টকদই সেবন করা।
খ) লেবু দিয়ে ওজন কমানোর উপায়
অতিরিক্ত ওজন কমানোর জন্য লেবু অত্যন্ত উপাদেয়। এটিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে যা স্থূলতা কমাতে সাহায্য করে। তাই দ্রুত ওজন কমাতে লেবুকে প্রতিদিনকার খাদ্য তালিকায় রাখা যেতেই পারে। পড়তে পারেন – লেবুর উপকারিতা
মেয়েদের ওজন কমানোর উপায়
মেয়েরা ওজন নিয়ে ছেলেদের চেয়ে একটু বেশিই দুশ্চিন্তায় ভোগেন। চেহারা সামান্য ভারি হয়ে গেলেই মেয়েদের সমস্যার শেষ থাকে না। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, শারীরিকভাবে সুস্থ মেয়েদের তুলনায় মোটা মেয়েদের অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা ৬৬ ভাগ বেশি থাকে। নীচে সহজ উপায়ে মেয়েদের ওজন কমানোর উপায় সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো:
ক) কখনোই না খেয়ে থাকবেন না:
অনেকেই মনে করে না খেলেই ওজন কমে আসবে। তবে এটি সম্পূর্ণ একটি ভুল ধারণা। না খেয়ে ওজন না কমলেও আপনি অসুস্থ নিশ্চয়ই হয়ে পড়বেন। সময়মতো নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী খাবার গ্রহণ করুন। তবে সম্পুর্ণ পেট ভরে খেলে চলবে না। পরিমাণমতো পানিও পান করতে হবে।
খ) মিষ্টি থেকে দূরে থাকুন:
মিষ্টি জাতীয় খাবার শরীরে ইনসুলিনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। ইনসুলিন হচ্ছে একটি হরমোনের নাম। এই হরমোন দেহে চর্বি সংরক্ষণ করে রাখতে পারে। দেহে এটির মাত্রা বেড়ে গেলে খাবার হজম হতে অধিক সময় লাগে। ফলশ্রুতিতে প্রতিদিনের খাবারগুলো দেহে থেকে যায় ও স্থূলতা বাড়িয়ে দেয়।
গ) পর্যাপ্ত ঘুম:
সারাদিনের পরিশ্রান্ত শরীরে সামান্য কয়েক ঘণ্টা ঘুম আমাদের পরম শান্তি এনে দেয়। একজন পূর্ণবয়স্ক নারীর অবশ্যই নিয়মমাফিক ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো উচিৎ। ঘুম কম হলে শরীর ও মন দুটোই খারাপ থাকে, যা ওজন কমানোর চেষ্টায় মনস্তাত্ত্বিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
আরও জানতে চাইঃ
ক) ওজন কমাতে সকালে কি খাবার খাওয়া দরকার?
উত্তর: দিনের শুরু করতেই পারেন দুই গ্লাস পানি দিয়ে। পানি ক্যালোরি বার্ন করতে খুবই উপকারী। এছাড়াও, প্রতিদিন নিয়মিত ২-৩ লিটার পানি পান করুন। নাশতায় বেশি প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার রাখতে পারেন। প্রোটিন আপনার পেট ভর্তি রাখবে এবং বারবার খাওয়া থেকে আপনাকে বিরত রাখবে। এছাড়াও, চিয়া সিড মেশানো শরবত, পুডিং, বা স্মুদি খেতে পারেন। চিয়া সিড ওজন কমাতে দারুন ভূমিকা রাখে।
খ) ওজন কমানোর জন্য দুপুরে কি খাবার খাওয়া উচিত?
উত্তর: রাতে কখনোই পেট ভরে খাবেন না। রাতে হালকা পাতলা খাদ্য গ্রহণ করুন। ফলে খাবার দ্রুত হজম হবে এবং দেহে চর্বি জমতে বাধা দেয়।
গ) কত দ্রুত ওজন কমানো সম্ভব?
উত্তর: কখনোই এটা ভাববেন না যে ২০ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে আপনি ১০ থেকে ১৫ কেজি ওজন কমিয়ে ফেলবেন। এটা কিছুটা জেগে থেকে স্বপ্ন দেখার মতো। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে আপনি শুধু নিজের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করবেন।
সবার প্রয়োজন আলাদা আলাদা হয়ে থাকে। নিজের প্রয়োজন বুঝে সঠিকভাবে ওজন কমানোর চেষ্টা করুন। সফলতা একদিন ধরা দেবেই। প্রয়োজন বিবেচনায় আপনি কোনো বিশিষ্ট পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিতেই পারেন। তিনি আপনাকে সঠিক রাস্তা দেখিয়ে দেবেন।
অতিরিক্ত ওজন অনেকের কাছেই একটি অস্বস্তির নাম। এটি শুধু আমাদের বাহ্যিক সৌন্দর্যকেই নষ্ট করে না বরং আমাদের শরীরেরও উল্লেখযোগ্য ক্ষতিসাধন করে। আমাদের উচিত হবে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় এটিকে কমিয়ে আনা।
তথ্যসূত্র:
- https://vitagene.com/blog/lemon-for-weight-loss/
- https://www.eatthis.com/best-yogurts-for-weight-loss/
- https://www.who.int/news-room/fact-sheets/detail/obesity-and-overweight