আমাদের ত্বকে সেবাসিয়াস নামে একটি গ্রন্থি থাকে। এই গ্রন্থি থেকে সেবাম নামক একধরনের তৈলাক্ত পদার্থ বের হয়। মাঝে মাঝে এই গ্রন্থির নালির মুখ বন্ধ হয়ে গিয়ে এই সেবাম (Sebum) বের হওয়া বাধাগ্রস্ত হয় এবং তা জমে গিয়ে ফুলে ওঠে। একেই আমরা ব্রণ নামে চিনি। এর চারপাশে প্রদাহের সৃষ্টি হয় এবং লাল হয়ে যায়। এতে যদি জীবাণুর সংক্রমণ দেখা দিলে পুঁজ দেখা দিতে পারে। সংক্রমণ কমে এলেও মুখে দাগ রয়ে যায়।
ব্রণ কেন হয়?
ব্রণ কেন হয় তার সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ এখনো খুঁজে পাওয়া যায় নি। তবে বয়ঃসন্ধিকালের সময় ব্রণ না হওয়া মানুষ খুঁজে বের করা দুষ্কর। শরীরে উপস্থিত হরমোনের প্রভাবেও ব্রণ হতে পারে। তবে ময়লা, ঘাম, দূষণে সেবাসিয়াস গ্রন্থির মুখ আটকে গিয়ে সিস্ট জমে এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। এছাড়াও অন্যান্য যেসকল কারণে ব্রণের সমস্যা হতে পারে, তা নিচে উল্লেখ করা হলোঃ
(ক) ত্বকের অযত্ন হলে:
ত্বক আমাদের সবচেয়ে সংবেদনশীল অঙ্গের মধ্যে একটি। তাই এর সঠিক যত্ন নেওয়া অতীব জরুরী। দূষণ, ময়লা, মেকআপ এবং অন্যান্য দূষিত দ্রব্যাদি থেকে নিয়মিত ত্বক পরিষ্কার না করলে সহজেই সেবাসিয়াস গ্রন্থির নালি সহজেই আটকে যেতে পারে। সুতরাং, প্রতিনিয়ত সময় বের করে ফেশওয়াশ বা স্ক্রাবার দিয়ে মুখমন্ডল পরিষ্কার করার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
(খ) অতিরিক্ত ঘামের সমস্যা:
আমাদের অনেকেরই অতিরিক্ত ঘামের সমস্যা হয়ে থাকে। তাই যারা নিয়মিত ভাবে ব্যয়াম করেন বা রোদে ঘোরাঘুরি করেন তারা মাঝেমাঝেই ত্বক ধুয়ে নেওয়ার চেষ্টা করুন। অতিরিক্ত ঘাম মুছে নেওয়ার চেষ্টা করুন কারণ অতিরিক্ত ঘামের মাধ্যমে জীবাণু, ময়লা, দূষণ একত্রিত হয়ে ত্বকের ছিদ্র বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এর ফলে ব্রণ ছাড়াও ত্বকের অন্যান্য সমস্যা দেখা দিতে পারে।
(গ) অনিদ্রা:
বিশেষজ্ঞদের মতে একজন ব্যক্তিকে প্রতিদিন কমপক্ষে ৬ থেকে ৮ ঘন্টা ঘুমানো প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় নিদ্রা রক্ত সঞ্চালন ভালো রাখতে সহায়তা করে। ফলে ব্রণের সমস্যা দূরীকরণে সহায়তা করে।
(ঘ) মানসিক চাপ:
মানসিক চাপ খুবই ভয়ানক একটি বিষয়। এটির ফলেও ত্বকে ব্রণ দেখা যেতে পারে। অতিরিক্ত মানসিক চাপের ফলে ব্রণ ছাড়াও কম বয়সে ত্বকে বলিরেখা, বয়সের ছাপ ইত্যাদি দেখা দিতে পারে।
(ঙ) ময়লা চাদর ও বালিশের কভার:
দিনভর পরিশ্রমের পর আমরা অনেকেই বিছানার ময়লা চাদর বা বালিশের কভারের দিকে নজর দিতে ভুলে যাই। এগুলোতে আমাদের শরীর থেকে নিঃসৃত ময়লা, ত্বকের তেল ও সিবাম মিলেমিশে যায়। যা আবার আমাদের ত্বকে লেগে ব্রণ তৈরি করতে পারে। তাই নিয়মিতভাবে এগুলো পরিষ্কার রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
(চ) অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাত তৈলাক্ত খাবার:
বর্তমান সময়ে বাহিরের তৈলাক্ত প্রক্রিয়াজাত খাবার আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকার একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এই ধরনের পিজ্জা, বার্গার, সিঙ্গাড়া, অতিরিক্ত মিষ্টি জাতীয় খাবার, পাকোড়া এবং কোল্ড ড্রিংকস এ অতিরিক্ত মসলা ও তেল ব্যবহার করা হয়। এগুলো ব্রণের উৎপাত বৃদ্ধি করতে পারে। এইসব খাদ্যদ্রব্য আপনার শরীরকে আরো স্থুলকার করে তুলতে পারে।
(ছ) হরমোনজনিত সমস্যা:
শরীরে হরমোনের তারতম্যের ফলেও ত্বকে ব্রণ দেখা দিতে পারে। আমাদের সবার শরীরে কিছু হরমোন থাকে। এগুলো নিঃসরণের পরিমাণ তারতম্যের ফলে মুখমন্ডলের আশেপাশে বেশকিছু ব্রণ দেখা যায়। এমন সমস্যা থাকলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
(জ) জীবাণুর সংক্রমণ:
আমাদের ত্বক খুবই সংবেদনশীল হয়ে থাকে। নিয়মিতভাবে ত্বক পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করতে হবে। মুখমন্ডলে সাবান ব্যবহার না করাই ভালো। তবে শুধুমাত্র ফেসওয়াশ বা শাওয়ার জেল ব্যবহার করাই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে ত্বকে ব্যবহার করার উপযোগী মেডিকেটেড বা হারবাল পণ্য ব্যবহার করা যায়।
(ঝ) বংশগত বৈশিষ্ট্য:
রক্ত সম্পর্কে কারো যদি ব্রণের সমস্যা থেকে থাকে। তবে তাদের সন্তানসন্ততিদের মধ্যেও এই ধরনের সমস্যা দেখা যায়। যদিও এর স্থায়ী কোনো সমাধান নেই তবে ত্বকের যত্ন নেওয়ার সাপেক্ষে ব্রণ থেকে সাময়িক প্রশান্তি পাওয়া সম্ভব।
(ঞ) ভিটামিনের অভাব:
ব্রণ বের হওয়ার অনেকগুলো কারণের মধ্যে ভিটামিনের অভাব একটি। তবে সব ভিটামিনের অভাবেই ব্রণ হয় না। যেসকল ভিটামিনের অভাবে এটি দেখা দিতে পারে তা নিম্নরূপঃ
> ভিটামিন বি ৩ (Vitamin B3)
> ভিটামিন এ (Vitamin A)
> ভিটামিন ডি (Vitamin D)
> ভিটামিন ই (Vitamin E)
দ্রুত ব্রণ দূর করার উপায়ঃ
আমরা অনেকেই ব্রণ নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তায় থাকি। কেননা এটি চলে গেলেও এর দাগ একটি লম্বা সময় পর্যন্ত আমাদের চেহারায় দাগ রেখে যায়। যা দেখতেও খারাপ লাগে। তবে কিছু ঘরোয়া চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করে খুব সহজেই দ্রুত ব্রণের সমস্যা থেকে মুক্তি যায়।
- স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ করা;
- প্রয়োজনীয় পরিমাণ ঘুম;
- শরীরের প্রয়োজনীয় পানির চাহিদা পূরণ করুন;
- সর্বদা ত্বক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে;
- সঠিক প্রসাধনী ব্যবহার সম্পর্কে জানতে হবে;
- যাদের অতিরিক্ত ঘামের সমস্যা রয়েছে, তাদের গরমে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।
ব্রণ হলে মুখে কি লাগানো উচিতঃ
মুখমন্ডলে ব্রণ হলে ওষুধ ব্যবহার করা সাপেক্ষে তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যায়। তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ না নিয়ে কোনো প্রকার ওষুধ ত্বকে প্রয়োগ করা ঠিক নয়। তবে জেনে রাখার স্বার্থে স্যালিসাইলিক অ্যাসিড, বেনজয়েল পারঅক্সাইড, রেটিনল বিশিষ্ট অয়েনমেন্ট ব্রণ ভালো করতে সহায়তা করে।
মুখমন্ডলে ব্রণ হওয়া খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়। এটি কোনো বড় সমস্যা বলেও বিবেচিত হয় না। কিছু সময় থেকে ব্রণ নিজে থেকেই ভালো হয়ে যায়। তবে বারবার ব্রণ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতেই হবে।
ব্রণ দূর করার ঘরোয়া কিছু উপায়ঃ
এমন মানুষ খুঁজে বের করা খুব কঠিন হবে যার কিনা কখনোই ব্রণের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়নি। অতিরিক্ত গরম, মানসিক চাপ, অনিদ্রাসহ একাধিক কারণে এটির প্রকাশ ঘটে। এছাড়াও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণেও এটি হতে পারে। এর থেকে মুক্তি পাওয়ার কিছু ঘরোয়া চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে নীচে আলোচনা করা হলোঃ
(১) শসার রস:
শসার রস মুখমন্ডলের তৈলাক্ত ভাব দূরে রাখে। যেহেতু তৈলাক্ত ত্বকে ব্রণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাই ব্রণ দূরীকরণে শসার রস মুখে লাগাতে পারেন।
(২) ঘরোয়া পেস্ট:
চালের মিহি গুঁড়া, শসার রস এবং মধু একত্রে মিশিয়ে একটি পেস্ট তৈরি করুন। এই পেস্ট একটি প্রসাধনী সামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। নিয়মিতভাবে সকাল বিকাল এই পেস্ট ব্যবহার করলে ব্রণ দূর হয়ে যায়।
(৩) টুথপেস্ট:
টুথপেস্টে ত্বকে ঠান্ডার অনুভূতি দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে। যেসকল স্থানে ব্রণ দেখা দিবে সেসকল জায়গায় টুথপেস্ট ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যাবে।
(৪) লেবুর রস:
লেবুর রসে ভিটামিন সি থাকে, যা ব্রণকে দ্রুততার সাথে শুকিয়ে ফেলতে সাহায্য করে। এছাড়াও এতে আরো অনেক উপকারী ঔষধি গুণাগুণ রয়েছে যা ত্বকের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দূর করতে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
(৫) তুলসি:
তুলসিতে থাকা উপাদানসমূহ ত্বকে ব্যবহার করা গেলে ত্বকের রোগপ্রতিরোধ করার সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
(৬) ডিম:
ডিমের সাদা অংশের ব্যবহার ব্রণের জন্য অনেক উপকারী। ঘুমানোর পূর্বে এই অংশটিকে ব্রণের স্থানে ভালো করে মেসেজ করে লাগাতে হবে। সকালে উঠে ভালোভাবে মুখ ধুয়ে ফেলুন। ডিম ব্রণ ছাড়াও ত্বকের অন্যান্য সমস্যা দূরে রাখতেও সহায়ক ভূমিকা রাখে।
তৈলাক্ত ত্বকে ব্রণ সমস্যা দূর করার উপায়ঃ
তৈলাক্ত ত্বকের ব্যক্তিদের এমনিতেই কিছু ত্বকের সমস্যায় ভুগতে হয়। তবে এদের মধ্যে ব্রণের সমস্যাই অন্যতম। এই ধরনের ত্বকে এমনিতে ধুলোবালি খুব সহজেই আটকে যায়। ফলে লোমকূপ বন্ধ হয়ে ব্রণের সমস্যা দেখা দেয়। এই ধরনের সমস্যা থেকে বাঁচতে যা করা যেতে পারে তা নিম্নরূপ:
# সময় করে প্রতিদিন ত্বক পরিষ্কার করুন;
# সমপরিমাণ মধু ও লেবুর রস মিশিয়ে ত্বকে প্রয়োগ করুন। ১০ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন। এটি ত্বক পরিষ্কার করে।
# তৈলাক্ত ভাব দূরীকরণে সকাল বিকাল লেবুর রস দিয়ে ত্বক পরিষ্কার করুন।
# মধুতে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান থাকে। এগুলো ব্রণ দূরে রাখে।
উপসংহারঃ
ব্রণকে যদিও এতো ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তবে যদি বারবার এই সমস্যা দেখা দেয় তবে একজন চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিন। কেননা এটি ক্যান্সারের সাথে সংযুক্ত হতে পারে। তবে এই বিষয়ে আপনার ডাক্তারের পরামর্শই সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাবে।
তথ্যসূত্রঃ
- https://www.healthline.com/health/skin/acne
- https://www.cosmopolitan.com/style-beauty/beauty/a32686/surprising-things-that-cause-acne/