ওটস কি ও কেন খাবেন? পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা


ওটস কি?

ওটস হল এক প্রকার খাদ্যশস্য। এটি প্রচুর পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ একটি খাদ্যশস্য। মূলত ঠান্ডা আবহাওয়ায় এটি জন্মায়। পশুখাদ্য হিসেবে বেশি ব্যবহৃত হলেও মানুষের স্বাস্থ্যের উপকারিতায়ও রয়েছে এর অনেক অবদান। এটি থেকে বিস্কুট, কেক, রুটি ইত্যাদির মতো খাবারও তৈরি হয়। চলুন জেনে নেয়া যাক ওটস কি এবং ওটসের পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা সম্পর্কে।

প্রায় ৪০০০ বছর আগে থেকেই মানুষ এটি চাষ করে আসছে। ধান, গমের মতো এরও চাষাবাদ মানুষ করে থাকে। ইংরেজিতে এটি Avena Sativa নামে পরিচিত। এই খাদ্যশস্যে রয়েছে অন্য খাদ্যশস্যের তুলনায় উচ্চ মানের পুষ্টি গুণ। কতিপয় গবেষণা থেকে জানা যায় যে, এতে আছে অতি উচ্চ মাত্রায় সহজে দ্রবণীয় বেটা-গ্লুকন। এই বেটা-গ্লুকন দেহের ক্ষতিকর কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে দারুণ ভূমিকা রাখে।

ওট বা ওটসের পুষ্টি উপাদান

বর্তমান বিশ্বের একটি অন্যতম জনপ্রিয় সকালের নাস্তা হলো ওটস। পুষ্টিবিদদের মতে এটি দুনিয়ার সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর শস্যের একটি। পূর্বে গবাদিপশুর ও ঘোড়ার খাবার হিসেবেই বেশি ব্যবহৃত হতো এটি তবে বর্তমানে মানুষের খাদ্য হিসেবে অনেক বেশি জনপ্রিয়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে পোল্যান্ড ও রাশিয়া ওটস চাষের জন্য বেশ সমৃদ্ধ। এর পাশাপাশি কানাডাতেও প্রচুর পরিমাণে এটি চাষ হয়।

ওটস একটি দারুণ পুষ্টিসম্পন্ন খাবার। কার্বোহাইড্রেট ও ফাইবারের দারুণ একটি উৎস হলো এই খাবার। অন্য যেকোনো খাদ্যের চেয়ে বেশি প্রোটিন ও ফ্যাট রয়েছে এই খাদ্যশস্যে।

আধা কাপ বা ৭৮ গ্রাম ওটস থেকে যে পুষ্টি উপাদান পাবেন:

ফসফরাস- ৪১ শতাংশ

ম্যাঙ্গানিজ- ১৯১ শতাংশ

কপার- ২৪ শতাংশ

ম্যাগনেসিয়াম- ৩৪ শতাংশ

আয়রন- ২০ শতাংশ

ফোলেট- ১১ শতাংশ

জিংক- ২০ শতাংশ

ভিটামিন বি১ বা থায়ামিন- ৩৯ শতাংশ

ভিটামিন বি৫ বা প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড- ১০ শতাংশ

কার্বোহাইড্রেট- ৫১ গ্রাম

প্রোটিন- ১৩ গ্রাম

ফ্যাট- ৫ গ্রাম

ফাইবার- ৮ গ্রাম

এছাড়াও আরও রয়েছে সামান্য পরিমাণে ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ভিটামিন বি৬ বা পিরিডক্সিন, ভিটামিন বি৩ বা নায়াসিন ইত্যাদি। এবং ক্যালরির পরিমাণ হল ৩০৩।

ওটস এর উপকারিতা

ওটস একটি উচ্চ পুষ্টিমান সমৃদ্ধ খাদ্যশস্য। এতে রয়েছে দেহের জন্য প্রয়োজনীয় নানাবিধ পুষ্টি উপাদান। এতে রয়েছে আলফা-টোকোটেরিওনল এবং আলফা-টোকোফেরলের মতো উপকারী উপাদান যারা দেহে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। এছাড়াও আরও নানা উপাদান রয়েছে যারা দেহের নানা উপকার করে থাকে। আসুন জেনে নিই ওটসের উপকারিতা।

  • আলফা-টোকোটেরিওনল এবং আলফা-টোকোফেরল দেহে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি মানুষের হৃদযন্ত্রকেও সুস্থ রাখে।
  • এই খাদ্যশস্য প্রোটেস্ট ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে।
  • ওটসে রয়েছে ফাইবার যা দেহের অতিরিক্ত চর্বি কমায়। এতে দেহের ওজন কমে।
  • এতে থাকা বেটা-গ্লুকন দেহের ক্ষতিকর কোলেস্টেরল কমায় এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।
  • ওটসে থাকা ফাইবার পেট পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে এবং ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে রাখে। ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে থাকায় বাড়তি খাবার খেতে ইচ্ছা হয় না। ফলে দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে। তাই ওজন কমাতে চাইলে প্রতিদিন খেতে পারেন ওটস।
  • দেহের প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে সক্ষম এই খাদ্যশস্য। পাশাপাশি এই প্রোটিন ও এতে থাকা ফাইবার দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা রাখতে সাহায্য করে।
  • এই খাদ্যশস্য হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। হৃদরোগের জন্য দায়ী বা হৃদযন্ত্রের জন্য হুমকিদায়ক ক্লোটস যা রক্তে থাকে তা নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। এটি খেলে হৃদরোগের ঝুঁকি অনেক কমে যায়।
  • রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখতে এই খাদ্যশস্যের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এছাড়া এক বাটি ওট বা ওটস লো ফ্যাট জাতীয় খাবার কিংবা টক দইয়ের সঙ্গে কয়েক ধরনের ফল ও মধু মিশিয়ে খেয়ে দেখতে পারেন। এটি ওজন কমাতে বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
  • এই খাদ্যশস্যে রয়েছে রয়েছে উচ্চমাত্রার শর্করা যা দেহের জন্য খুবই উপকারী।
  • টাইপ-২ ডায়াবেটিস এর ঝুঁকি কমাতে এই শস্য থেকে তৈরি ওটমিল বা ওটস খুবই কার্যকরী।
  • এই খাদ্যশস্যে থাকা ম্যাগনেসিয়াম রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও এর শক্তিশালী ফাইবার দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে। ফলে দেহ নানাবিধ রোগ থেকে মুক্ত থাকে সহজেই। তাই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে নিয়মিত এই খাবার গ্রহণ করতে পারেন।
  • ওটমিলে থাকা হোল গ্রেইন্স পোস্ট-মেনোপজাল নারীদের ব্রেস্ট বা স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। প্রতিদিন এক বাটি করে ওটমিল বা ওট খেলে প্রায় ৪১ শতাংশ পর্যন্ত স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে, যা একটি দারুণ উপকারী দিক।
  • এটি কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকিও কমায়। পাশাপাশি এতে থাকা সেরোটোনিন হরমোনকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। ফলে শরীরের অবসাদ, মন খারাপ ইত্যাদি দূর হয় এবং এতে থাকা ম্যাগনেসিয়াম ভালো ঘুম হতে সাহায্য করে। তাই ঘুমের সমস্যা দূর করতে চাইলে নিয়মিত এটি খেতেই পারেন।

বাচ্চাদের জন্য ওটস

ফাইবার বা আঁশযুক্ত একটি খাবার হওয়ায় বাচ্চাদেরও ওটস খাওয়াতে পারেন। এটি বাচ্চাদের নানা উপকার করে থাকে। বাচ্চাদের যেসব উপকার করে থাকে এই খাদ্যশস্য:

বাচ্চাদের মস্তিষ্কের দ্রুত বিকাশে এই খাদ্য সাহায্য করে। বাচ্চাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে এই খাদ্যে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ছোট বাচ্চাদের হাড় শক্ত করতে ও হাড়ের গঠনে এই খাদ্য খাওয়াতে পারেন। পাশাপাশি বাচ্চাদের এটি খাওয়ালে তাদের মেধা বিকাশেও এটি দারুণ ভূমিকা রাখবে।

ওটমিল কি?

আমাদের দেশে ওটস সরাসরি অত জনপ্রিয় না হলেও ওটমিল কিন্তু আস্তে আস্তে জনপ্রিয় হচ্ছে। তা এই ওটমিল কি? ওটমিল আর ওটস কি এক? ওটমিল হল ওটসের থেকে প্রক্রিয়াজাত হওয়া একটি খাদ্য। এটিও ওটসের মতোই উপকারিতা দেয়। তাই চাইলে ওটমিলও খেতে পারেন।

ওটস কখন খাবো? কিভাবে খাবো?

কখন খাবো?

মূলত এই খাবারটি বেশিরভাগ দেশের বেশিরভাগ মানুষই ব্রেকফাস্ট বা সকালের নাস্তায় এটি খেতে পছন্দ করেন। তবে আপনি চাইলে সকালের নাস্তার পাশাপাশি রাতেও খাবার খাওয়ার পর এটি খেতে পারেন। এছাড়া সন্ধ্যার হালকা নাস্তা হিসেবেও এটি খাওয়া যায়। এছাড়াও দুপুরে লাঞ্চ বা দুপুরের খাবার হিসেবেও এটি খাওয়া যায়

সকালে ওটস খেলে এটি সারাদিনের ক্যালরি জোগায় দেহে পাশাপাশি কাজ করার শক্তিও দেয়। এই খাবার খেতে পারেন বিভিন্ন উপায়ে। এবার কিছু উপায় জেনে নেওয়া যাক।

কিভাবে খাবো?

সকালের নাস্তায় দুধের সাথে এটি খেতে পারেন। সাথে ড্রাই ফ্রুটস বা শুকনো ফলও খেতে পারেন। এছাড়া আপেল, খেজুর বা অন্য ড্রাই ফ্রুটসের সাথে টক দই আর ওটস মিশিয়ে খেতে পারেন।

পাশাপাশি দুপুরের খাবারে চাইলে ভাতের মতোই সেদ্ধ করে বিভিন্ন তরকারি দিয়ে এই খাদ্যশস্য খাওয়া যায়। চা কিংবা কফির সাথে বিস্কুট বা অন্য খাবারের বদলে এই খাদ্যশস্য খেতে পারেন। এছাড়াও চালের বদলে ওটসের তৈরি খিচুড়ি খেতে পারেন।

এছাড়াও আরও নানাবিধ উপায়ে এটি খাওয়া যায়। এই খাদ্যশস্য দিয়ে চাইলে বিভিন্ন স্বাস্থ্যসম্মত বিস্কুট, কেক, স্যুপ এমনকি ফ্রাইড রাইসও বানিয়ে খাওয়া যায়।

ওটস এর অপকারিতা

ওটস উপকারী খাদ্য তা আমরা ইতোমধ্যেই জেনে গেছি। তবে এরও রয়েছে কিছু অপকারিতা বা ক্ষতিকর দিক। এবার এগুলো জানা যাক।

অতিরিক্ত পরিমাণে এটি খেলে দেহের হাঁড়ে ব্যথা হতে পারে। এছাড়া অতিরিক্ত ঘুম, ক্লান্তি, পেশি ব্যথা সহ নানারকম সমস্যা হতে পারে। সরাসরি কাঁচা ওটস খেলে পেটে সমস্যা কিংবা কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে।

এই খাদ্য শস্যে ফ্যাটি এসিড থাকায় বেশি খেলে নানা শারীরিক সমস্যা হতে পারে। চিনি মিশ্রিত ওটসও বাজারে পাওয়া যায়। এই চিনি মিশ্রিত ওটস ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ক্ষতিকর।

পরিশেষে

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসচেতন অনেক মানুষ বর্তমানে সকালের নাশতা হিসেবে ওটস গ্রহণ করে। আগে আমাদের দেশে এটি অনেক ব্যয়বহুল খাদ্য ছিলো তবে বর্তমানে অনেক সুলভ মূল্যেই পাওয়া যায় এটি। গ্লুটেন ফ্রি ওট বা ওটস নানা রকমের পুষ্টিকর উপাদানে ভরা থাকে। এ সকল পুষ্টি উপাদান আমাদের দেহের জন্য খুবই উপকারী।

ওটস একটি উপকারী খাদ্য। সকালে নাস্তায় এটি খাওয়ার প্রচলন আমাদের দেশেও আস্তে আস্তে শুরু হচ্ছে। নানা শারীরিক উপকারিতা থাকায় এটি খেতে পারেন নিয়মিত। তবে এর অপকারিতার দিকগুলো এড়িয়ে চলতে হলে অবশ্যই সীমিত পরিমাণে ও পরিমিত পরিমাণে এটি খাওয়া উচিৎ। তবেই এর সঠিক উপকার পাওয়া সম্ভব।

আরও পড়তে পারেন –

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.