রমজান মাসে রোজা রাখার মধ্যে রয়েছে ফজর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খাদ্য, পানীয় এবং অন্যান্য শারীরিক চাহিদা থেকে বিরত থাকা। প্রতিদিনকার রোজার পরিসমাপ্তি ঘটে প্রতিদিন ইফতারে খাবার গ্রহণের মধ্য দিয়ে। পরের দিন ফজর থেকে আবার রোজা শুরু হয়। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত এই ধর্মীয়রীতি পালনে শরীরের উপর বেশ ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। তাই রোজায় খাদ্যাভ্যাস কেমন হওয়া উচিত ও মানবদেহে রোজা রাখার প্রভাব সম্পর্কে জানা অত্যন্ত জরুরি।
রমজান মাসে রোজা রাখার ইবাদত ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকেই পালন হয়ে আসছে। ইসলামিক ঐতিহ্য ও ইতিহাস অনুসারে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) আশুরার দিনে রোজা শুরু করেছিলেন, যা ইসলামিক ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস মহররমের দশ তম দিন। আশুরার রোজা পরে রমজানের রোজা দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়, যা ইসলামিক ক্যালেন্ডারের দ্বিতীয় বছরে সমস্ত মুসলমানদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল।
রমজান মাসে রোজা রাখার অনুশীলনের ইসলামী ঐতিহ্যের একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে এবং এটি মুসলিম সংস্কৃতির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। এই নিদিষ্ট সময়ের জন্য খাদ্যগ্রহণ থেকে বিরত থাকার যে রীতি বা অভ্যাস তা বিভিন্ন ধর্মেও লক্ষ্য করা যায়।
শরীরে রোজা রাখার ইতিবাচক প্রভাব:
রমজান মাসে রোজা রাখার ফলে রক্তে শর্করার নিয়ন্ত্রণ, ওজন কমাতে, এবং প্রদাহ কমাতে কর্যকরী। বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে যে খাদ্যগ্রহণ থেকে বিরত থাকার ফলে শরীরের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, যার মধ্যে রয়েছে উন্নত রক্তে শর্করার নিয়ন্ত্রণ, ওজন হ্রাস এবং প্রদাহ হ্রাস।
বাংলাদেশে, যেখানে জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ রমজান মাসে রোজা পালন করে, সেখানে শরীরের উপর রোজা রাখার ইতিবাচক প্রভাব ও স্বাস্থ্যকর খাদ্য সম্পর্কে সচেতনতা গুরুত্বপূর্ণ। এটি একজন রোজাদারকে এই ধর্মীয় অনুশীলনের সময় একটি স্বাস্থ্যকর জীবনধারা বজায় রাখতে এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্য ও মননকে সমুন্নত রাখতে সহায়তা করে।
রক্তে শর্করার নিয়ন্ত্রণ:
রোজার সময়, শরীর গ্লুকোজের পরিবর্তে শক্তির জন্য সঞ্চিত চর্বি ক্ষয় করে, এটি রক্তে শর্করার মাত্রা হ্রাসের দিকে পরিচালিত করে, যা টাইপ-ডায়াবেটিসের বিকাশকে প্রতিরোধ করতে সাহায্য করতে পারে। রমজানে রোজা রাখার ফলে ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে শর্করার মাত্রা কমে যায় ও অতিরিক্ত চর্বি কমে কর্মক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।
ওজন হ্রাস:
রোজা ওজন কমানোর একটি কার্যকর উপায় হিসাবেও প্রমাণিত, শরীর যখন শক্তির জন্য সঞ্চিত চর্বি ক্ষয় করে, তখন এটি শরীরের চর্বি হ্রাসের দিকে নিয়ে যায়। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে যে যারা রমজান মাসে রোজা রেখেছিলেন তারা মাসে গড়ে কেজি ওজন হ্রাস করেছেন।
প্রদাহ হ্রাস:
রোজা শরীরের প্রদাহ কমাতে দেখানো হয়েছে। প্রদাহ হৃদরোগ এবং ক্যান্সার সহ বেশ কয়েকটি দীর্ঘস্থায়ী রোগের সাথে যুক্ত। সৌদি আরবে পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে রমজান মাসে রোজা রাখার ফলে শরীরে প্রদাহের চিহ্ন কমে যায়।
রোজায় খাদ্যাভ্যাসঃ
রোজার নিয়ম মাফিক খাদ্য গ্রহণের ফলে পাঁচনক্রিয়া সক্রিয় থাকে যা হজমে বেশ উপকারী। রোজায় স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ অতীব জরুরি, তাই রোজার মাসে স্বাস্থ্যকর এবং সুষম খাদ্য বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্যের তালিকায় যা যা রাখা যেতে পারে:
খেজুর:
খেজুর শক্তির একটি উত্তম উৎস যা মুসলিম ধর্ম গ্রন্থে নানা সময়ে উঠে এসেছ। খেজুরে রয়েছে প্রয়োজনীয় পুষ্টি যেমন ফাইবার, পটাসিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম। খেজুর রোজায় ইফতার পণ্য হিসেবেও ঐতিহ্যবাহী খাবার।
আবূ হুরাইরা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন –
‘‘মুমিনের শ্রেষ্ঠ সেহরী হল খেজুর।’’
–আবূ দাঊদ
আনাস (রাঃ) বলেন,
‘আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) নামাযের পূর্বে কিছু আধা-পাকা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। তা না পেলে পূর্ণ পাকা (শুকনা) খেজুর দিয়ে এবং তাও না পেলে কয়েক ঢোক পানি খেয়ে নিতেন।
বিশুদ্ধ পানি:
রোজা রাখার সময় হাইড্রেটেড থাকা জরুরি। পানীয় জল এটি করার সর্বোত্তম উপায়। নানা ধরনের শরবতও বেশ তৃপ্তিদায়ক পানীয়। তবে চিনি গ্রহণের ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে।
আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন –
“যে ব্যক্তি খেজুর পায়, সে যেন তা দিয়ে ইফতার করে। যে ব্যক্তি তা না পায়, সে যেন পানি দিয়ে ইফতার করে। কারণ, তা হল পবিত্র।”
সহীহুল জামেউস সাগীর ৬৫৮৩
আঁশযুক্ত শস্য:
আশযুক্ত শস্য যেমন বাদামী চাল এবং বাদামী গমের রুটি, ফাইবার এবং জটিল কার্বোহাইড্রেটের একটি ভাল উৎস।
চর্বিহীন প্রোটিন:
চর্বিহীন প্রোটিন, যেমন মুরগি, মাছ এবং মটরশুটি, নানা ধরনের ডাল, টক দই শক্তির একটি ভাল উৎস এবং পেশী ভর বজায় রাখতে সাহায্য করে।
শাকসবজি:
মৌসুমী শাকসবজি ফাইবার, ভিটামিন এবং খনিজের একটি ভাল উৎস। এগুলি প্রতিটি খাবারে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
দেশীয় ফল:
ফল শক্তি এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টির একটি ভালো উৎস। যেমন তরমুজ, বড়ই, কলা, বেল, ডাব।
বাদাম এবং বীজ:
বাদাম এবং বীজ স্বাস্থ্যকর চর্বি এবং প্রোটিনের একটি ভাল উৎস।
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখার জন্য জীবনযাপনেও বেশকিছু দিক লক্ষ্যনীয়ঃ
একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখার জন্য শুধুমাত্র সঠিক খাবার খাওয়ার মতো জীবনযাপন নিয়ম মাফিক হওয়াও প্রয়োজন।
- পরিমিত পরিমাণে খান: রোজায় একজন রোজাদারকে পরিমিত খাদ্য গ্রহণ করতে হবে কেননা অতিরিক্ত খাওয়ার ফলে ওজন বৃদ্ধি এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে। পরিমিত পরিমাণে খাওয়া এবং অতিরিক্ত খাওয়া এড়ানো গুরুত্বপূর্ণ।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন,
‘‘উদর অপেক্ষা নিকৃষ্টতর কোন পাত্র মানুষ পূর্ণ করে না। আদম সন্তানের জন্য ততটুকুই খাদ্য যথেষ্ট, যতটুকুতে তার পিঠ সোজা করে রাখে। আর যদি এর চেয়ে বেশী খেতেই হয় তাহলে যেন সে তার পেটের এক তৃতীয়াংশ আহারের জন্য, এক তৃতীয়াংশ পানের জন্য এবং অন্য আর এক তৃতীয়াংশ শ্বাস -প্রশ্বাসের জন্য ব্যবহার করে।
- কায়িকশ্রম ও ব্যায়াম: স্বাস্থ্যকর ওজন এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য নিয়মিত ব্যায়াম গুরুত্বপূর্ণ। রমজান মাসে ব্যায়াম চালিয়ে যাওয়া জরুরি।
- পর্যাপ্ত ও নিয়মিত ঘুম: ঘুম সামগ্রিক স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। রমজান মাসে পর্যাপ্ত ঘুম হওয়া জরুরি, অতিরিক্ত ঘুমও বর্জনীয়।
- চিনিযুক্ত এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলুন: এই খাবারগুলিতে ক্যালোরি বেশি এবং ওজন বৃদ্ধি এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে।
- ক্যাফেইন সীমিত করুন: ক্যাফেইন যেমন – চা কফি সীমিত করতে হবে কেননা রোজায় অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণের ফলে ডিহাইড্রেশন হতে পারে, যা রোজার সময় ঘুম ও পরিপাকে সমস্যা হতে পারে। রমজান মাসে ক্যাফেইন গ্রহণ সীমিত করা গুরুত্বপূর্ণ।
- তৈলাক্ত খাবার বর্জন: বালাদেশের একটা অন্যতম ইফতার খাদ্য সামগ্রী হয়ে উঠেছে, তৈলাক্ত ছোলা ও ভাজাপোড়া যা একেবারেই অস্বাস্থ্যকর, এইসব তৈলাক্ত খাবার বর্জনীয় এবং সকল খাবারেই তেলের ব্যবহারে সতর্ক থাকা এবং ইফতারে ভোজ্য তেল বাতিল করাই শ্রেয়।
মানবদেহে রোজার আধ্যাত্মিক প্রভাব –
প্রার্থনা এবং আত্ম-সংযমের এই সময়ে অন্যতম প্রধান দিক হল ধ্যানের অনুশীলন। ধ্যানের মাধ্যমে, মুসলমানরা অভ্যন্তরীণ প্রশান্তি অর্জন করতে এবং আল্লাহর সাথে তাদের আধ্যাত্মিক সংযোগ, চিন্তা ও ভাবনাকে স্থির করতে সাহায্য করে। বিভ্রান্তি ব্যতিরেকে অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যেতেও সাহায্য করে। আল্লাহ এবং তাঁর শিক্ষার উপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করার মাধ্যমে, মুসলমানরা অভ্যন্তরীণ প্রশান্তি অর্জনে এগিয়ে যায়, তাই শরীরকেও নিয়মতান্ত্রিক ভাবে পরিচালিত করাও আবশ্যিক।
এছাড়াও, রোজা চাপ এবং উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করে। আজকের দ্রুত-গতির বিশ্বে, মানুষ ক্রমাগত বিভ্রান্তি এবং চাপের সাথে বসবাস করে, যা মানসিক এবং শারীরিক ক্লান্তির দিকে পরিচালিত করতে পারে। রোজার মাধ্যমে, মুসলমানরা এই চাপের প্রভাব কমাতে পারে এবং মানসিক প্রশান্তি অর্জন করতে পারে।
পরিশেষে –
রমজানের সময় ধ্যান, সংযম, অভ্যন্তরীণ প্রশান্তি এবং আধ্যাত্মিক বৃদ্ধি অর্জনের জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। আল্লাহ ও তাঁর শিক্ষার উপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করার মাধ্যমে মুসলমানরা প্রাত্যহিক চাপ কমিয়ে, একাগ্রতা চিত্তের উন্মেষ ঘটানোর জন্যে উত্তম সময় এই রমজান মাস। তাই সুস্বাস্থ্য ও মানসিক প্রশান্তির জন্যেই খাবার গ্রহণ ও জীবনযাপনে নিয়ম মাফিকতার অনুশীলন দিতে পারে এক পরিপূর্ণ সংযমী জীবনাচার।
আরও পড়তে পারেন –
ধর্ম ও স্বাস্থ্য ও শারীরতত্ত্ব বিষয়ক চমৎকার একটি পোস্ট।