অলিভ অর্থাৎ জলপাই থেকে যে তেল তৈরি করা হয়, তাকে অলিভ অয়েল বলে। আমাদের সুস্বাস্থ্যের জন্য অলিভ অয়েলের উপকারিতা অনস্বীকার্য । এই তেলে ওমেগা ৬ এবং ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে। একইসঙ্গে এতে এক প্রকারের স্বাস্থ্যকর মনস্যাচুরেটেড ফ্যাট আছে যার নাম এলিক অ্যাসিড। তাই বিশেষজ্ঞরা সাদা তেলের বিকল্প হিসেবে এটি খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
অলিভ অয়েলের উপকারিতা
একটি গবেষণা অনুযায়ী এই তেলে ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি আটকানোর গুণাগুণ রয়েছে। এতে থাকা এলিক অ্যাসিড প্রাকৃতিক প্রদাহনাশক হিসেবে কাজ করে। নীচে অলিভ অয়েল তেলের উপকারিতা সমূহের উপর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলো:
ক) পেটের সমস্যা দূরে রাখে:
বর্তমানে অবৈজ্ঞানিক খাদ্যাভাসের ফলে গ্যাস-অম্বলের বদহজমের মতো সমস্যা আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। অলিভ অয়েলে monosaturated fat থাকে যা পেটের সমস্যা দূরীকরণে সাহায্য করে। সেজন্য চিকিৎসকরা প্রতিদিন এক চামচ অলিভ অয়েলের সাথে সমপরিমাণ লেবুর রস মিশিয়ে খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এতে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যাও দূরে থাকে।
খ) নাক ডাকা বন্ধ করতে সহায়ক:
এটির ঔষধি গুণাবলী নাক ডাকা বন্ধ করতে খুবই উপকারী। এই তেল আপনার কন্ঠনালীকে পিচ্ছিল করে দিয়ে নাক ডাকা প্রতিরোধ করে। তাই নাক ডাকা বন্ধ করতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে এক চুমুক অলিভ অয়েল খেয়ে নিন এতে উপকার পাবেন।
গ) কানের সমস্যা দূর করে:
কানে চুলকানি বা দুর্গন্ধ হওয়ার সাধারণ সমস্যা অনেকেরই হয়ে থাকে। এসব সমস্যা দূর করতে একটি কটন বারে সামান্য অলিভ অয়েল ভিজিয়ে সাবধানে কানের মধ্যে ব্যবহার করতে পারেন।
ঘ) নখের যত্নে:
এটি নখের ভঙ্গুরতা দূর করার পাশাপাশি নখের চামড়ার বাইরের স্তর সুস্থ, সুন্দর এবং কোমল রাখতেও সহায়তা করে। এরজন্য কয়েক ফোঁটা এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল হাতের আঙুলে নিয়ে নখের উপরের দিক এবং চারপাশে ভালোভাবে মালিশ করতে হবে। এতে আস্তে আস্তে নখের ভঙ্গুরতা কমে নখ হয়ে উঠবে আরো শক্ত ও উজ্জ্বল।
ঙ) ব্যথা দূর করে:
শরীরের অযাচিত ব্যাথা দূর করতে এটি অত্যন্ত উপকারী। এরজন্য ২০০ মিঃলিঃ পানির সঙ্গে ২০ চামচ অলিভ অয়েল ভালোভাবে মিশিয়ে নিন। এবার ব্যথার স্থানে বিরতি দিয়ে দিয়ে ১৫ মিনিট ধরে মালিশ করুন।
চ) শরীরের প্রদাহ কমায়:
এটির স্বাস্থ্য উপকারিতাকে মাথায় রেখে আমাদের সকলেরই উচিত আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় এটির ব্যবহার করা। বহুবছর ধরে এটি ভূমধ্যসাগরীয় সংস্কৃতির একটি প্রধান অংশ যা প্রাচীন গ্রীক এবং রোমানদের সাথে সম্পর্কযুক্ত। প্রকৃতপক্ষে পুষ্টি বিশেষজ্ঞদের মতে ভূমধ্যসাগরীয় অববাহিকায় কিছু জনগোষ্ঠীর দীর্ঘস্থায়ী জীবনযাপনের কারণ তাদের খাদ্যাভ্যাসে অলিভ অয়েলের মতো তেলের ব্যবহার।
ছ) ওজন নিয়ন্ত্রণে আনে-
দ্রুত ওজন কমাতে এটির জুড়ি মেলা প্রায় অসম্ভব। এতে থাকা ভিটামিন-ই, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ফ্ল্যাভেন-৩-ওলস, অ্যানথোসায়ানিন ওজন হ্রাস করতে সক্ষম। এছাড়াও এই তেল হজমে সাহায্য করার পাশাপাশি রক্তের শর্করাকে নিয়ন্ত্রণে রাখে।
বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে অলিভ অয়েল
এই তেলে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান। এগুলো খুব সহজেই শরীরের প্রদাহের মাত্রাকে কমিয়ে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারে। এই প্রদাহের মাত্রা বেড়ে গেলে হৃদযন্ত্রের ক্ষতি হওয়ার পাশাপাশি ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, এবং আর্থ্রাইটিস-এর মতো রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
১) রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে-
এটিতে প্রচুর পরিমাণে আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট ও পলিফেনাল মজুদ থাকে যা রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে। তাই বাসায় খাবার তৈরির সময় এই তেলের ব্যবহার করতে পারেন। বেশি উপকার পেতে কাঁচা অলিভ অয়েলও খেয়ে নিতে পারেন।
২) ক্যান্সার দূর করে-
প্রতিদিন এটির সেবন করলে ক্যানসারের ঝুঁকি অনেকটাই হ্রাস পায়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, এর সঠিক ব্যবহারে কলোরেক্টাল ক্যান্সারের সম্ভাবনা কমে। এছাড়াও এতে থাকা অলেরোপিয়ান নামক একটি প্রাকৃতিক উপাদান মহিলাদের স্তন ক্যানসারের সম্ভাবনা কমাতে সাহায্য করে।
৩) ডায়বেটিস রোগীদের জন্য উপকারী-
প্রতিদিন এটি খেলে ডায়বেটিস সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এতে বিদ্যমান পলি ও মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাট গ্লুকোজের মাত্রা কমিয়ে দেয় এবং কার্বোহাইড্রেট শোষণ করে, ফলে ইনসুলিনের কর্মক্ষমতা বেড়ে যায়। এর ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা হ্রাস পায় এবং ডায়বেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে আসে।
৪) হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়-
যাদের হৃদযন্ত্রের সমস্যা রয়েছে তাদের জন্য অলিভ অয়েল খুবই কার্যকরী। এটি দূর্বল হার্টের জন্য প্রয়োজনীয় চর্বির যোগান দেয়। এটির মনোঅনস্যাচুরেটেড নামক ফ্যাটি অ্যাসিড হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট লোহিত রক্তকণিকাগুলিকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে পারে – অন্যথায় যা হৃদরোগ, হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
৫) চোখ ও হাড়ের জন্য উপাদেয়-
একজন মানুষের প্রতিদিন যে পরিমাণ ভিটামিন প্রয়োজন তার প্রায় পুরোটাই অলিভ অয়েলে পাওয়া যায়। এজন্য এটি রাতকানা, গ্লুকোমা ও চোখের অন্যান্য সমস্যা দূরে রাখতে সক্ষম। এই তেলে অস্টিওক্যালসিন নামের একটি হরমোন পাওয়া যায় যা, হাড়ের শক্তি বৃদ্ধিতে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
রূপচর্চায় অলিভ অয়েল
রূপচর্চায় অলিভ অয়েলের বহুল ব্যবহার পরিলক্ষিত। আধুনিক রূপচর্চায় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। নীচে এর কয়েকটি ব্যবহার সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
- চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল বা কালি পড়া রূপ সচেতনদের জন্য একটি বড় সমস্যা। এটি দূর করতে নিয়মমাফিক প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে সামান্য অলিভ অয়েল ম্যাসাজ করে নিন।
- মাঝেমধ্যে দেখা যায় ঠোঁটে মরা চামড়া জমে কালচে হয়ে যায়। এটি দেখতে অনেক খারাপ লাগে। এটি থেকে মুক্তি পেতে কিছু অলিভ অয়েল ও লেবুর রস একসঙ্গে মিশিয়ে ঠোঁটে ঘষে নিন। এরফলে ঠোঁটের মরা চামড়া দূর হবে।
- ঠোঁটের কোমলতা রক্ষা করার জন্য এক চা চামচ অলিভ অয়েল, কয়েক ফোঁটা লেবুর রস ও আধ চামচ চিনি মিশিয়ে ঠোঁটে লাগিয়ে রাখুন যতক্ষণ না চিনি গলে যায়। এটি ঠোঁট ফাটা রুখতেও সমানভাবে কার্যকরী।
- রূপচর্চার বিশেষজ্ঞদের মতে, চোখের মেকআপ তুলতে সবচেয়ে ভালো কাজ করে অলিভ অয়েল। এটি চোখের পাপড়িতে লাগানো মাশকারা ওঠাতে, চোখের নিচের কালো দাগ ও রিঙ্কল দূর করতেও কাজে লাগে। এছাড়াও চোখের চারপাশের কুঁচকে থাকা ত্বককে হাইড্রেট করে আরো নরম করে তোলার ক্ষমতা রাখে অলিভ অয়েল।
চুলের যত্নে অলিভ অয়েল
যখন আমাদের চুলের প্রশ্ন আসে তখন আমরা অনেকেই আমাদের দৈনন্দিন ব্যস্ততার কারণে একে অগ্রাহ্য করি। তবে অলিভ অয়েলে থাকা শক্তিশালী উপাদান আমাদের চুলকে আরো দৃঢ় ও উজ্জ্বল করতে সাহায্য করে। তবে অলিভ অয়েল কি আসলেই মানুষের চুলের জন্য ভালো? একজন ব্যক্তি তাদের স্বাভাবিক চুলের তেলকে অলিভ অয়েল দিয়ে প্রতিস্থাপন করার আগে, তাদের চুলে এটি লাগানোর সম্ভাব্য উপকারিতা সম্পর্কে আরও জানতে হবে।
- এটির ম্যাসাজ চুলের গোড়া মজবুত করার পাশাপাশি চুলের ঔজ্জ্বল্য বাড়াতে সাহায্য করে।
- এতে ভিটামিন-ই থাকে যা চুল পড়ে যাওয়ার প্রবণতা কমায়। আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন আপনার চুল কত দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
- এর সাথে সামান্য কয়েক ফোঁটা লেবুর রস ব্যবহার করলে তা খুশকির সমস্যা দূরে রাখবে।
- শ্যাম্পু করার পূর্বে সামান্য অলিভ অয়েল হালকা গরম করে মাথায় ম্যাসাজ করে নিন। এটি আপনার চুলে ময়েশ্চারাইজারের মতো কাজ করবে।
মুখের যত্নে অলিভ অয়েল
অলিভ অয়েল আমাদের কাছে একটি পরিচিত খাওয়ার তেল, তবে এটি আমাদের মুখের জন্যেও সমান উপকারী প্রমাণ হতে পারে। এই তেলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে যা আমাদের মুখের জন্য একটি ভালো ময়শ্চারাইজেশন ও এ্যান্টি এজিং হিসেবে কাজ করে। প্রায়সই মুখ ধোয়ার বিভিন্ন পণ্যের উপাদান হিসেবে এর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। যেমন:- সাবান, বডি ওয়াশ এবং লোশনেও পাওয়া যায়।
একে সরাসরি আপনার ত্বকে লাগিয়ে কোনো অতিরিক্ত উপাদান ছাড়াই ময়েশ্চারাইজার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। অতিরিক্ত তেলকে মুছে ফেলতে তোয়ালে বা পরিষ্কার কাপড় ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি মুখের ব্রণ প্রতিরোধক হিসেবেও কার্যকরী। এরজন্য ৪ টেবিল চামচ লবণের সাথে ৩ টেবিল চামচ অলিভ অয়েল মিশিয়ে একটি পেস্ট তৈরি করে নিন। এবার এই পেস্ট ২ মিনিট ধরে মুখে ম্যাসাজ করে ধুয়ে ফেলুন।
ত্বকের যত্নে অলিভ অয়েল
পরিমিত পরিমাণ এবং বিশুদ্ধ অলিভ অয়েল ত্বকের জন্য দুর্দান্ত কার্যকর। এতে উপস্থিত ফ্ল্যাভোনয়েডস এবং পলিফেনলসের কারণে কোষের পুনর্জন্মের পরিমাণ বাড়ে। এটি ত্বকের প্রাকৃতিক স্তিতিস্থাপক বজায় রাখতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তবে সবধরনের ত্বকের ক্ষেত্রে এটি সমান উপকারী নাও হয়ে উঠতে পারে, তাই একজন বিশেষজ্ঞ চর্ম চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। নীচে এর ব্যবহার সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেওয়া হলো:
- প্রথমে হাতে কয়েক ফোঁটা নিয়ে সেগুলি একসাথে ঘষে নিন।
- এবার সামান্য ভেজা ত্বকে এটি আপনার মুখে আলতো করে ম্যাসাজ করুন।
- যেহেতু এই তেলটি সামান্য ভারী তাই এটি আপনার লোমকূপ আটকে দিতে পারে এবং তেলের দাগ রেখে দিবে।
- তাই জমে থাকা তেল পরিষ্কার করতে এবং ত্বকে থাকা তেলের দাগ দূর করতে আপনাকে অবশ্যই অলিভ অয়েল ব্যবহার করার পরে ফেসওয়াশ ব্যবহার করতে হবে।
- যাদের ত্বক একটু তৈলাক্ত তাদের এই পদ্ধতি ব্যবহার না করাই ভালো।
আসল অলিভ অয়েল চেনার উপায়
আসল অলিভ অয়েল চিনতে আপনি “ফ্রিজ টেস্ট” করে দেখতে পারেন। এজন্য আপনি একটি পাত্রে অলিভ অয়েল নিয়ে ২ ঘন্টার জন্যে ডিপ ফ্রিজে রেখে দিন। এবার বের করে যদি দেখতে পান এটি জমে শক্ত হয়ে গেছে অথবা তরলই আছে, তাহলে আপনার তেলটি খাঁটি নয়। কিন্তু যদি দেখেন এটি হালকা জমে গেছে বা হালকা ঘন হয়ে গেছে তাহলে বুঝবেন এটি খাঁটি অলিভ অয়েল।
অন্য আরেকটি পরীক্ষায়, কোনো পাত্রে অলিভ অয়েল নিয়ে তার উপর আগুন ধরিয়ে দিতে হবে। যদি এটি কোনো ধোঁয়া ছাড়াই পুড়তে শুরু করে তবে বুঝতে হবে এই তেলটি খাঁটি। এই দুটি পরীক্ষা ব্যবহার করে যেকেউ খাঁটি অলিভ অয়েল তেল খুঁজে বের করতে পারে।
পরিশেষে
অলিভ অয়েল স্বাস্থ্যকর তেলের মধ্যে জন্যপ্রিয় ও উপকারি। বেশকিছু গবেষণা ও বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী এটিতে অবিশ্বাস্য পরিমাণ স্বাস্থ্য সুবিধা রয়েছে। অলিভ অয়েলের উপকারিতা সমূহের মধ্যে রোগ ও অসুস্থতা প্রতিরোধ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, ত্বকের উন্নতি এবং এমনকি শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি অন্যতম।