আপেল সিডার ভিনেগার হচ্ছে এক ধরনের ভিনেগার যা ভেজানো আপেলের রস থেকে তৈরি করা হয়। এটি একাধারে সালাদের ড্রেসিংস, ফুড প্রিজারভেটিভস এবং চাটনি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। স্বাস্থ্যগত দিক থেকে এটির প্রচুর উপকারিতা রয়েছে। তবে এটিকে পরিমিত পর্যায়েই সেবন করা উচিত।
আপেল সিডার ভিনেগার কি?
ভিনেগার শব্দটি ফরাসি ভাষা থেকে উৎপত্তি হয়েছে যার অর্থ ‘সাওয়ার ওয়াইন’ বা টক স্বাদযুক্ত ওয়াইন। সহজ কথায় বলতে গেলে আপেল সিডার ভিনেগার হচ্ছে একটি ফার্মেন্টেড জুস। আপেল পিষে যে রস বের করা হয় তা থেকে এটি তৈরি করা হয়।
একে তৈরি করতে অ্যালকোহলীয় গাঁজন প্রক্রিয়ার ব্যবহার করা হয়। আপেলের শর্করাগুলো ভেঙ্গে অ্যালকোহলে রূপান্তরিত হয়। এরপর অ্যালকোহল ভিনেগারকে এসিটিক এসিড – (Acetobacter প্রজাতি ব্যাকটেরিয়া) এ রূপান্তর করে। এসিটিক এসিড এবং ম্যালিক এসিড একত্রিত হয়ে ভিনেগারকে এর চেনা পরিচিত স্বাদ দেয়।
আপেল সিডার ভিনেগার এর উপকারিতা
আপেল সিডার ভিনেগার আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। প্রাচীন গ্রিক সভ্যতাতেও এর বর্ণনা পাওয়া যায়। প্রাচীন ভারতীয় আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় ক্ষতস্থান নিরাময়ে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। এটির উপকারিতা সম্পর্কে নীচে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো।
ক) ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ:
টাইপ-2 ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে এটির রয়েছে অসাধারণ সক্ষমতা। কিছু গবেষণার ফল থেকে পাওয়া যায়, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীরা প্রতিদিন ঘুমানোর আগে ২ চামচ আপেল সিডার ভিনেগার খেলে তা ৪% পর্যন্ত শর্করার মাত্রাকে কমিয়ে আনতে পারে। টাইপ-২ তে আক্রান্তদের রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে দেহে নানান ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। একটি গবেষণা অনুযায়ী ভিনেগার টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের রক্তে শর্করা এবং ইনসুলিনের মাত্রাকে উন্নত করতে সাহায্য করে। তবে যেকোনো শর্করা নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত ওষুধের পাশাপাশি ভিনেগার সেবনের আগে একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।
খ) ওজন নিয়ন্ত্রণ:
আপেল সিডার ভিনেগার এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটির মেটাবলিজম বুস্ট করার ক্ষমতা। ফলে এটি খেলে দীর্ঘসময় ধরে আমাদের পেট ভর্তি থাকে। ফলশ্রুতিতে মানুষ দৈনিক মাত্রাতিরিক্ত ক্যালোরি গ্রহণ থেকে বিরত থাকে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে। তবে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পেতে অবশ্যই ৩ মাস পর্যন্ত নিয়মিত এটিকে গ্রহণ করতে থাকা প্রয়োজন। কিছু গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল মতে আপেল সিডার ভিনেগার তল পেটের চর্বি কমাতেও সহায়ক।
গ) হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা:
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, আপেল সিডার ভিনেগার শরীরের হরমোনের ভারসাম্য রক্ষায় কাজ করে। বেশ কয়েকটি গবেষণায়ও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। একইসাথে এটি মেয়েদের নিয়মিত পিরিয়ড ঠিক রাখতেও সহায়তা করে।
ঘ) হৃৎপিন্ড সুস্থ রাখা:
এটি রক্তের খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে আনতে পারে। একইভাবে রক্তচাপ এবং ট্রাইগ্লিসারাইডও নিয়ন্ত্রণে আনে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই হৃদপিণ্ডের ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি কমে আসে। তাই সুস্থ হৃদযন্ত্রের জন্য প্রতিদিন আপেল সিডার ভিনেগার গ্রহণ করা উচিত। নিয়মিত পরিমিত পরিমাণে এটি খেলে হৃৎপিন্ড সুস্থ ও কর্মক্ষম থাকে এবং হৃদরোগের ঝুঁকিও হ্রাস হয়।
ঙ) হজমশক্তি বাড়াতে:
এটিতে পাকস্থলীর এসিডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের গুণাগুণ আছে। এটি আমাদের পাকস্থলীতে ‘পেপসিন’ নামক এনজাইম তৈরির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। প্রোটিন জাতীয় খাদ্য হজমে পেপসিন দ্রুত কাজ করে, ফলে দ্রুত খাবার পরিপাক হয়।
চ) ক্যান্সার প্রতিরোধ:
অন্য সকল ভিনেগারের মতো আপেল সিডার ভিনেগারও ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে। একটি গবেষণায় দাবি করা হয়, ভিনেগার ক্যানসার কোষ হত্যায় কাজ করে। তাই ক্যানসারের মতো মরণঘাতী রোগ প্রতিরোধে আমাদের রোজকার ডায়েটে এই ভিনেগারটি যুক্ত করে নেওয়া উচিৎ। এটি খাদ্যনালীর ক্যানসার প্রতিরোধেও সমান কার্যকরি।
ছ) রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ:
আমাদের কিডনি নিজে থেকেই রেনিন নামক একটি হরমোন উৎপন্ন করে। এটি মাঝেমাঝেই আমাদের রক্তনালীকে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত সংকুচিত বা প্রসারিত করে ফেলে। আপেল সিডার ভিনেগার এই রেনিনকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে রক্তনালীসমূহকে স্বাভাবিক রাখে। ফলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে।
জ) ঠান্ডা ও সর্দি-কাশিতে:
আপেল সিডার ভিনেগার মৌসুমী ঠান্ডাজনিত রােগ যেমন হাঁচি-কাশি কিংবা গলা ব্যথা দূর করতে অত্যন্ত উপকারি। ঠান্ডাজনিত সমস্যা হলে সামান্য কুসুম গরম পানির সাথে নির্দিষ্ট পরিমাণে আপেল সিডার ভিনেগার মিশিয়ে গার্গল করলে ভালো উপকার পাওয়া যায়।
ঝ) ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস:
আপেল সিডার ভিনেগার (Apple Cider Vinegar) ব্যাকটেরিয়া এবং ফাঙ্গাস সংক্রমণের বিরুদ্ধে বহুবছর আগে থেকেই ব্যবহার হয়ে আসছে। এটি E.coli এর মতো ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধেও প্রতিরোধের দেয়াল গড়ে তোলে। প্রাচীনকালে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য এটির মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হতো।
আপেল সিডার ভিনেগারের নানাবিধ ব্যবহার:
শুধুমাত্র স্বাস্থ্য উপকারিতা ছাড়াও এটিকে নানাবিধ কাজে ব্যবহৃত হয়। রূপচর্চা ও গৃহস্থালির কাজেও এর জুড়ি খুঁজে পাওয়া যাবে না। নীচে এটির কিছু ব্যবহার তুলে ধরা হলো:
১) ত্বকের সুরক্ষা প্রদান করে:
ত্বককে সুরক্ষা প্রদান করতে প্রাচীনকাল হতেই এটির ব্যবহার হয়ে আসছে। এটিতে থাকা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল উপাদান আছে যা ত্বকের pH এর মান স্বাভাবিক রাখে। অনেকে গোসলের পানিতে এটিকে মিশিয়ে থাকেন।
অনেকে ত্বকের ব্রণ বা অ্যাকনে দূর করতেও এটিকে ব্যবহার করে থাকেন। তবে সরাসরি প্রয়োগের পূর্বে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন কেননা অনেকের ত্বক এটির প্রতি সংবেদনশীল হয়ে থাকে।
২) চুলের খুশকি দূর করে:
বিশেষজ্ঞ ডার্মাটোলজিস্টদের মতে, এই ভিনেগার Malassezia ফাঙ্গাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ করে খুশকি কমাতে সহায়ক। একইসাথে এটি পানিতে মিশিয়ে মাথায় দিলে সুন্দর ঝলমলে উজ্জ্বল চুল পাওয়া যায়। এছাড়াও এটি সুন্দর ও সুগঠিত চুল পেতে সহায়তা করে।
৩) মুখের দুর্গন্ধ করে:
মুখের দুর্গন্ধ আমাদের অনেকের কাছেই একটি মারাত্মক সমস্যা। কারোর সাথে কথা বলার সময় এটি আমাদের অনেক বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে। এই ভিনেগারকে মাউথওয়াশ হিসেবেও কাজে লাগানো যায়।
এটির অ্যান্টিব্যাকটেরয়াল উপাদান মুখের দুর্গন্ধ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়াসমূহকে ধ্বংস করে। এটি মুখের দুর্গন্ধ দূর করার পাশাপাশি দাঁত ও মাড়িও মজবুত রাখে।
আপেল সিডার ভিনেগার খাওয়ার নিয়ম
এটিকে ভিনেগারের মতোই ব্যবহার করা যায়। তবে প্রতিটি মানুষের আলাদা আলাদা প্রয়োজন অনুযায়ী এটিকে খাওয়ার পরিমাণ ও ব্যবহার বিধিতেও পরিবর্তন আসতে পারে। তবে সামান্য গরম পানিতে ২-৩ চামচ আপেল সিডার ভিনেগার মিশিয়ে খেলে বেশি উপকার পাওয়া যায়।
অন্যান্য ভিনেগারের মতো এটিও খাদ্য সংরক্ষণ করে রাখতে পারে। এছাড়াও রান্নার কাজে, সালাদের সাথে এবং অন্য কোনো খাবারের সাথে এটিকে মিশিয়েও খাওয়া যায়।
আপেল সিডার ভিনেগার এর অপকারিতা
অপকারিতা না বলে এই সকল সমস্যাকে পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া বলাই হয়তো ভালো হবে। তবে এই সকল পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া আমদের শরীরের জন্য কোনো জটিল সমস্যা সৃষ্টি করে না। তবে আমাদের এই বিষয়সমূহে সতর্ক থাকায় ভালো। নীচে এই নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলো:
- দীর্ঘমেয়াদে এটি খেলে শরীরে পটাশিয়ামের ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে শরীরের ইলেকট্রোলাইটসের মাত্রায় তারতম্য দেখা যায়।
- এর অতিরিক্ত ব্যবহার হাড়ের ক্ষয় করে অস্টিওপোরেসিসের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।
- অতিরিক্ত পরিমাণে এই ভিনেগার ব্যবহার করলে দাঁতের এনামেলের ক্ষতি হতে পারে।
- এটি হজমশক্তি বৃদ্ধিতে উপকারী হলেও আলসার বা এসিডিটির রোগীদের এই ভিনেগার থেকে দূরে থাকাই ভালো।
- কারো কারো ত্বক ভিনেগারের সাথে সংবেদনশীল আচরণ করতে পারে। তাদের এটির সাথে সামান্য পানি মিশিয়ে ব্যবহার করা উচিত।
প্রত্যেকের প্রয়োজন অনুযায়ী আপেল সিডার ভিনেগারের পরিমাণ ও ব্যবহারে পার্থক্য হতে পারে। তাই সতর্কতার এটিকে সেবন করা জরুরি। সর্বোপরি একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।
পরিশেষে–
কিছু পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া থাকলেও আপেল সিডার ভিনেগার অত্যন্ত উপকারী একটি পানীয়। আমাদের উচিত নিজেদের খাদ্যতালিকায় এটিকে সংযুক্ত করা। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী এটি খেলে বা ব্যবহার করলে এর ক্ষতিকর দিক অথবা পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।
তথ্যসূত্রঃ
- https://www.osuvinegar.co.uk/blogs/acv/the-different-types-of-apple-cider-vinegar
- https://www.healthline.com/nutrition/apple-cider-vinegar-side-effects#TOC_TITLE_HDR_4
- https://www.webmd.com/vitamins/ai/ingredientmono-816/apple-cider-vinegar#:~:text=Apple%20cider%20vinegar%20is%20the,been%20used%20traditionally%20as%20medicine
আরও পড়তে পারেন –