কিডনির রোগ খুবই মারাত্মক। এটি মানুষকে মৃত্যু পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। এই রোগ থেকে দূরে থাকা উচিৎ। তবে যদি এই রোগ একবার হয়ে যায় তখন দূরে থাকা প্রায় অসম্ভব। তবে যদি এ রোগটি প্রাথমিক পর্যায়েই শনাক্ত করা যায় তাহলে অনেক সময়ই প্রতিকার সম্ভব। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করতে গেলে আপনাকে অবশ্যই এর লক্ষণ ও প্রতিকার সম্বন্ধে জানা আবশ্যক। আসুন জেনে নিই কিভাবে এটির লক্ষণ বুঝবেন ও এর প্রতিকার করবেন।
কিডনি
আমাদের দেহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ হল কিডনি। প্রত্যেক মানুষের দেহে দুইটি কিডনি রয়েছে। দেখতে সাধারণত কলাই আকৃতির হয় এটি। কিডনি দুটি দৈর্ঘ্যে সাধারণত ৯ থেকে১২ সেন্টিমিটার হয় এবং প্রস্থে ৫ থেকে ৬ সেন্টিমিটার হয়। এছাড়া এরা ৩ থেকে ৪ সেন্টিমিটার মোটা হয়। এটি মেরুদন্ডের দুই পাশে অবস্থান করে। কোমড় থেকে একটু উপরেই এদের অবস্থান।
কিডনি রোগের লক্ষণ
কিডনি গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ দেহের। এটি সুস্থ না থাকলে মানুষ মারা যেতে পারে। কিডনির হতে পারে রোগ। এ রোগ শুরুতেই চিহ্নিত না করা গেলে বড় ধরনের বিপদ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই শুরুতেই এ রোগ শনাক্ত করা খুবই জরুরী। এ রোগ হলে যে সকল লক্ষণ দেখা দেয়:
- প্রস্রাবের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যায়।
- রোগীর সারা শরীর ও মুখমন্ডল ফুলে যায়।
- প্রস্রাব লাল হয় এবং প্রস্রাবের সাথে রক্ত যায়।
- উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা দেখা দেয়।
- কোমড়ের দুই পাশে ব্যথা হয়। এই ব্যথা তলপেট পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।
- ঘুম থেকে উঠলে চোখ মুখ অস্বাভাবিকভাবে ফুলে যায়।
- বমি বমি ভাব দেখা দেয় এবং খাবারে অরুচি দেখা দেয়।
- দেহে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়।
- ঝুঁকি বেড়ে গেলে শরীর ফ্যাকাসে হয় ও শরীরের রঙ পরিবর্তন হতে শুরু করে।
এছাড়াও এসব লক্ষণ ছাড়াও যাদের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি সমস্যা আছে তাদের নিয়মিত কিডনি পরীক্ষা করানো উচিৎ।
কিডনি রোগের কারণ
বিভিন্ন কারণে কিডনির রোগ হতে পারে, এমনকি কিডনি বিকলও হতে পারে। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা বা গবেষণার তথ্য মতে, ৪৬ শতাংশ মানুষই নেফ্রাইটিসের কারণে কিডনির রোগে আক্রান্ত হয়। এছাড়া ৩৬ শতাংশ মানুষ ডায়াবেটিসের কারণে এবং ১১ শতাংশ মানুষের উচ্চ রক্তচাপের কারণে কিডনির রোগ বা কিডনি বিকলের সমস্যা হয়। তাছাড়া বংশগত কারণ কিংবা বিভিন্ন ওষুধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার কারণেও কিডনির সমস্যা দেখা দিতে পারে। আসুন জেনে নিই এ সকল কারণ গুলো সম্পর্কে একটু বিস্তারিত।
ক) নেফ্রাইটিস
কিডনির প্রধান একটি রোগ হল নেফ্রাইটিস। যেকোনো বয়সের মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। শিশুদের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই এটি নিরাময়যোগ্য হলেও বড়দের ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হয়। সংক্রামক ও অসংক্রামক উভয় কারণেই এ রোগ হতে পারে। তবে সংক্রামক রোগের পরিমাণই বেশি। প্রায় ৮০ ভাগ মানুষই সংক্রামক নেফ্রাইটিসে আক্রান্ত হয়। সংক্রামক কারণগুলো প্রতিরোধ যোগ্য হলেও সমস্যা বাঁধে অসংক্রামক কারণের বেলায়। অসংক্রামক কারণগুলো সম্পূর্ণ অজানা হওয়ায় এর চিকিৎসাও বেশ কঠিন ও জটিল হয়।
নেফ্রাইটিস হলে শরীর ফুলে যায়, প্রস্রাবের সাথে আমিষ বের হয়, রক্তে চর্বির পরিমাণ বাড়তে থাকে, রক্তে ক্রিয়েটিনিন নামক যৌগ বেড়ে যায়, রক্তচাপ বেড়ে যায়। কিডনি থেকে টিস্যু বা কোষ নিয়ে এই রোগ শনাক্ত করা সম্ভব। প্রাথমিক পর্যায়ে ৩০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে এই রোগ চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময় সম্ভব হলেও এই রোগ হলে ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ রোগীর কিডনি বিকল ও অকেজো হয়ে যায়।
খ) ডায়াবেটিস
ডায়াবেটিস হলে নিয়ম মেনে চলা জরুরী। নিয়ম মেনে চললে ডায়াবেটিস তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারে না। কিন্তু নিয়ম না মানলেই ডায়াবেটিসের আক্রমণ শুরু হয়। এটি এমনকি কিডনিকেও আক্রমণ করতে ছাড়ে না। তবে বিভিন্ন কারণে অনেক সময় নিয়ম মানা সম্ভব হয়ে উঠে না। এতেই বিপত্তি বাঁধে।
প্রায় ৪০ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগীই কিডনির রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। ডায়াবেটিস রোগ শনাক্ত হওয়ার পর থেকে যেকোনো সময় এটি হতে পারে। তাই এক্ষেত্রে ডায়াবেটিস রোগীদের সতর্ক হওয়া জরুরী। ডায়াবেটিস রোগীদের কিছুদিন পরপর কিডনির পরীক্ষা করা অত্যাবশ্যক।
গ) উচ্চ রক্তচাপ
কিডনির রোগ হওয়ার অন্যতম প্রধান একটি কারণ হল উচ্চ রক্তচাপ। স্ট্রোক, হৃদরোগের পাশাপাশি কিডনির রোগও হতে উচ্চ রক্তচাপের কারণে। তাই উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা খুবই জরুরী।
উচ্চ রক্তচাপকে অনেকে গুরুত্ব দেন না। অনেকে বিভিন্ন দ্বিধায় পড়ে নিয়মিত উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ খেতে চান না। এ সকল কারণে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং কিডনির ক্ষতি করে।
ঘ) বংশগত
কিডনির রোগ অনেক সময় বংশগত কারণেও হতে পারে। পরিবারের কেউ অতীতে বা বর্তমান অবস্থায় কিডনি রোগে আক্রান্ত থাকলে তার কারণে বংশের অন্য কেউ আক্রান্ত হতে পারেন। এটিই বংশগত কারণ।
বংশগত কারণে কিডনির রোগের প্রধান কারণ পলিসিস্টিক কিডনি ডিজিজ। এই রোগের কারণে জন্মগত ভাবেই কিডনির কার্যকারিতা কম থাকে বা কিডনির রোগ থাকে। এই রোগ নিয়মিত ওষুধ সেবনের মাধ্যমে নিরাময় করা সম্ভব।
কিডনি রোগ প্রতিরোধের/প্রতিকারের উপায়
কিডনির রোগ বর্তমানে মারাত্মক আকার ধারণ করছে সারা বিশ্বে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশেও এই রোগ প্রকট হয়ে উঠছে। কিন্তু আমাদের দেশে দারিদ্র্যতা ও নানা কারণে এ রোগের যথাযথ চিকিৎসা সম্ভব না। তাই এ রোগের চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধের দিকেই আমাদের নজর দেওয়া উচিৎ। কিডনি রোগ প্রতিরোধের কিছু উপায় হল:
- নিয়মিত ব্যায়াম ও দৈহিক পরিশ্রম করা।
- নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করা এবং উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা।
- ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা।
- ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা।
- নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার খাওয়া।
- পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা।
- ধূমপান থেকে বিরত থাকা।
- চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো রোগের ওষুধ সেবন না করা।
এ সকল নিয়ম মেনে চললে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কিডনির রোগ হওয়ার ঝুঁকি অনেক কমে যায়।
কিডনি রোগীর খাদ্য তালিকা
কিডনি রোগ হলে পুষ্টিকর খাবার খাওয়া অত্যন্ত জরুরী। রোগীর খাদ্য তালিকা বিভিন্ন বিষয় মাথায় রেখে সাজাতে হয়। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এ সকল কিছু নিয়ন্ত্রণে রেখে খাদ্য তালিকা সাজানো উচিৎ।
খাদ্য তালিকায় টক জাতীয় ফল যেমন: লেবু, কমলা, আমলকি, মাল্টা, আম ইত্যাদি বাদ দিতে হবে। এছাড়া বেশি পরিমাণে পটাশিয়ামযুক্ত কলা, ড্রাইফ্রুট বা শুকনা ফল, টমেটো এগুলোও বাদ দিতে হবে বা খেলেও একদম অল্প পরিমাণে খাওয়া যাবে। এছাড়া আনারস, আপেল, বেদানা, নাশপাতি, পেয়ারা, কাঠাল, বড়ই ইত্যাদি খেলেও সীমিত পরিমাণে খাওয়া যাবে।
সবজির ক্ষেত্রে সবুজ শাক ও পাতা জাতীয় সবজি বাদ দিতে হবে খাদ্য তালিকা থেকে কিংবা অল্প পরিমাণে খেতে হবে। আলু, মিষ্টি আলু, কচু ইত্যাদি বাদ দিতে হবে এবং পেয়াঁজ, মুলা, গাজর সীমিত পরিমাণে খাওয়া যাবে। পিউরিন যুক্ত ডাল, শিমের বীজ, বরবটি ইত্যাদি খাওয়া যাবে না। এছাড়া বেগুন, কাকরোল, মটরশুঁটি, করলা, মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়া, ফুলকপি, ঢেঁড়স ইত্যাদি সবজি খাওয়া যাবে।
দুধ বা দুধজাতীয় খাবারে বেশি পরিমাণে ক্যালসিয়াম থাকায় এ সকল খাবার খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। কারণ কিডনির রোগে বেশি পরিমাণ ক্যালসিয়াম গ্রহণ করলে কিডনির উপর চাপ পড়ে যা ক্ষতির কারণ।
এছাড়া গরুর মাংস, খাসির মাংস খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। মুরগির মাংস, কবুতরের মাংস, ডিম, পনির ইত্যাদি খাওয়া যাবে। ডায়াবেটিস না থাকলে শর্করা জাতীয় খাবার খাওয়া যাবে। এছাড়াও প্যাকেটজাত খাবার, সফট ড্রিংকস বা কোমল পানীয়, ডাবের পানি, ফাস্ট ফুড বা জাংক ফুড, অতিরিক্ত তেলে ভাজা খাবার এবং রিফাইন্ড চিনি ইত্যাদি সম্পূর্ণ ভাবে বাদ দিতে হবে। পাশাপাশি ধূমপান বাদ দিতে হবে।
কিডনি ভালো রাখার উপায়
কিডনি ভালো রাখতে শরীরে তরলের ভারসাম্য ঠিক রাখা জরুরী। কিডনি ভালো রাখতে নিয়মিত কায়িক পরিশ্রম করতে হবে। এছাড়া কিডনি ভালো রাখার একটি অন্যতম উপায় হল বেশি পরিমাণে পানি পান করা। প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে।
নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করলে কিডনি সুস্থ থাকে। কিডনিকে ভালো রাখতে নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার খেতে হবে। পাশাপাশি ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। সকল প্রকার শারীরিক নিয়ম মেনে চললে খুব সহজেই কিডনি ভালো রাখা সম্ভব। পাশাপাশি কোনো রোগ হলে সে রোগের ঔষধ গ্রহণের পূর্বে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিৎ। কারণ বিভিন্ন ওষুধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া থেকেও কিডনির রোগ হয়।
পরিশেষে-
কিডনির রোগ হলে তার চিকিৎসা করানো আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে প্রায় অসম্ভব। তাই কিডনির রোগের চিকিৎসা করানোর চেয়ে এই রোগ প্রতিরোধে আগে থেকেই নিয়ম মেনে চলা ও সতর্ক থাকাই উত্তম। তাই কিডনির রোগ এড়াতে নিয়ম মেনে চলা ও চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চলা অত্যাবশ্যক। নিয়ম মেনে চললে শুধু কিডনির রোগই নয়, অন্য রোগ থেকেও সুস্থ থাকা সম্ভব।
সূত্রসমূহঃ
- https://www.mayoclinic.org/diseases-conditions/chronic-kidney-disease/symptoms-causes/syc-20354521
- https://www.nhs.uk/conditions/kidney-disease/symptoms/
- https://www.kidneyfund.org/kidney-disease/chronic-kidney-disease-ckd/
আরও পড়তে পারেনঃ