বাঙালির খাবারের পাতে এক টুকরা লেবু থাকবে না, এমনটা যেন হওয়ার নয়। লেবু যেমন সহজলভ্য, তেমনি এর গুণেরও শেষ নেই। প্রতিদিন লেবুর রস খাওয়ার উপকারিতা অনেক। লেবু ভিটামিন সি এর একটি সমৃদ্ধ উৎস। আবার গৃহস্থালি বিভিন্ন সমস্যার দ্রুত সমাধানেও ব্যবহৃত হয় লেবু। সাধারণ সর্দি–কাশি থেকে শুরু করে ক্যানসার পর্যন্ত প্রতিরোধ করে লেবু।
লেবুর উপকারিতা
- লেবুর ভিটামিন সি এন্টিসেপটিক এর কাজ করে ও ঠাণ্ডা লাগা প্রতিরোধ করে।
- সামান্য গরম পানিতে লেবুর রস পরিপাক প্রক্রিয়াকে কার্যকর করে এবং লিভারকে রাখে সুস্থ।
- লেবুর খোসা শুকিয়ে গুড়ো করে ব্যবহার করা যায় গোসলের সময়। গরমে শরীরকে ঠাণ্ডা করবে । এছাড়া এ গুড়ো মাথা ব্যথা দূর করবে।
- ব্রণে লেবুর রস দিলে ব্রণ দূর হবে আর নতুন ব্রণ উঠতেও বাঁধা প্রদান করবে।
- লেবুর ভিটামিন সি ক্যান্সার কোষ গঠন প্রতিরোধ করে।
- লেবু বুক জ্বালা প্রতিরোধ করতে ও আলসার সারাতে সাহায্য করে।
- লেবু ওজন কমাতে সাহায্য করে।
- শরীরের ভেতরের টক্সিন দূর করে, অন্ত্রনালী, যকৃত ও পুরো শরীরকে পরিষ্কার রাখে।
- রক্ত পরিশোধন করে।
- শ্বাসনালীর ও গলার প্রদাহ সারাতে সাহায্য করে।
- লেবু আর্থাইটিসের রোগীদের জন্য ভালো ।
লেবুর খোসার উপকারিতা
- লেবুর খোসায় রয়েছে পেকটিন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন সি, ফাইবার এবং খনিজ।
- বাজে কোলেস্টেরলের মাত্রাকে কমায়। এর মধ্যে পটাশিয়াম থাকার কারণে রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতেও সাহায্য করে।
- লেবুর খোসায় থাকা ভিটামিন সি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
- ফাইবার বা আঁশ অন্ত্রকে পরিষ্কার রাখে। এটি হজমে সাহায্য করে এবং পেট ফোলাভাব রোধে সহায়তা করে।
- লেবুর খোসা ওজন কমাতে সাহায্য করে।
- ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্যও লেবুর খোসা বেশ কার্যকর। এটি রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
- এটি হাড়ের স্বাস্থ্যকে ভালো রাখে।
- লেবুর খোসা মুখের বা কনুইয়ের কালো দাগ, বলি রেখা, বার্ধক্যের ছাপ দূর করতে সাহায্য করে।
লেবু ও গরম পানির উপকারিতা
- ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে গরম পানিতে লেবুর রস মিশিয়ে খেলে দেহের পিএইচ এর ভারসাম্য ঠিক থাকে। ফলে দেহের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
- প্রতিদিন সকালে হালকা গরম পানিতে লেবুর রস মিশিয়ে খেলে সারা দিনের হজমশক্তি ভালো থাকে।
- দেহের হরমোনকে সক্রিয় রাখে ও উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে।
লেবুর শরবতের উপকারিতা
১. ওজন কমায়:
লেবু ওজন কমাতে ঔষধের চেয়েও বেশী কার্যকরী। বাড়তি ওজন কমাতে ঔষধের চেয়ে লেবুকে বেশী প্রাধান্য দিতে হবে। লেবু শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমতে দেয় না।
২. ক্যান্সার প্রতিরোধ করে:
লেবুর ভিটামিন এ, সি, ই, বিটা ক্যারোটিন পাকস্থলি, মলদ্বার, স্তন, প্রোস্টেট, জরায়ু, লিভার, ফুসফুস ও অগ্নাশয়ের ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে।
৩. পিত্তথলির পাথর দূর করে:
পিত্তরস চর্বি জাতীয় খাবার হজমে সাহায্য করে। লেবুর রসে রয়েছে চর্বি বিরোধী উপাদান, যা চর্বিকে গলাতে সাহায্য করে। তাছাড়া পিত্তথলির পাথর দূর করতে দরকার উচ্চ ফাইবার বা আঁশযুক্ত খাবার। যা লেবুর মধ্যে প্রচুর পরিমানে রয়েছে।
৪. ঠান্ডাজনিত রোগ উপশম করে:
কুসুম গরম পানির সাথে লেবুর রস ও মধু মিশিয়ে চায়ের মত খেতে পারেন। অল্পতেই সর্দি কাশি ও গলাব্যাথা দূর হয়ে যাবে। তাছাড়া লেবু স্নায়ু ও মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ায়। এছাড়াও ফুসফুস পরিস্কার করে এ্যাজমা সমস্যার উপশম করে।
৫. ক্লান্তি দূর করে:
একগ্লাস লেবুর শরবত নিমিষেই ক্লান্তি দূর করে। তাছাড়া মানসিক চাপ ও দুশ্চিতা দূর করে লেবু। আরও পড়তে পারেনঃ মানসিক স্বাস্থ্য কেন গুরুত্বপূর্ণ ও ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির উপায়
লেবু দিয়ে রূপচর্চা
ক) মুখে ব্যবহার:
লেবুর ভিটামিন সি ত্বক ভালো রাখতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। ত্বকের ক্ষয় দূর করে এবং বয়সের ছাপ পড়া থেকে রক্ষা করে। এবং ত্বক মসৃণ রাখে, গরম ও ঘামের কারণে হওয়া তৈলাক্ত ভাব কমায়। ত্বকের মৃতকোষ এবং টক ফাটা দূর করে। ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে লেবু ব্যবহার করুন। ডাবের পানির সঙ্গে লেবুর রস মিশিয়ে ত্বকে ব্যবহার করে পনের মিনিট অপেক্ষা করুন। তারপর পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এটা তৈলাক্ত ত্বকে খুব ভালো কাজ করে।
খ) মাথার ত্বকে ব্যবহার:
লেবুর অ্যান্টিসেপ্টিক ও প্রদাহরোধী উপাদান মাথার ত্বক পরিষ্কার করে। খুশকি ও রুক্ষতার বিরুদ্ধে কাজ করে। চিটচিটে ভাব কমায় ফলে খুশকি দূর হয়। মাথার ত্বক পরিষ্কার করতে অ্যালো ভেরা জেলের সঙ্গে লেবুর রস মিশিয়ে চুলের গোড়ায় ব্যবহার করুন। বিশ মিনিট অপেক্ষা করে শ্যাম্পু করে নিন ও কন্ডিশনার ব্যবহার করুন। এতে খুশকি দূর হবে পাশাপাশি চুলের গোড়া শক্ত হবে ও চুল পড়া কমবে।
গ) কালচে ভাব দূর করতে:
অনেকেরই কালচে কনুই ও হাঁটুর সমস্যা আছে। এই দাগ দূর করতে এসব জায়গায় লেবু ও লবণের মিশ্রণ ঘষে নিন। ভালো ফলাফলের জন্য সপ্তাহে দুই-তিনবার লেবু ও লবণের মিশ্রণ আক্রান্ত স্থানে ব্যবহার করুন।
ঘ) ঠোঁটে ব্যবহার:
গরমকালেও ঠোঁট হতে পারে শুষ্ক ও মলিন। এই সমস্যা দূর করতে লেবুর রস ও লাল চিনি মিশিয়ে স্ক্রাব তৈরি করে ঠোঁটে লাগিয়ে নিন। লেবু ও চিনির সংমিশ্রণ ত্বকের মৃত কোষ দূর করতেও কার্যকর। লেবু ও চিনির মিশ্রণ আলতোভাবে ঠোঁটে মালিশ করে পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
ঙ) দাঁতে ব্যবহার:
ঝলমলে হাসির জন্য চাই ঝকঝকে সাদা দাঁত। দাঁত সাদা করতে লেবুর তৈরি ‘হোয়াইটেনিং প্যাক’ বেশ কার্যকর। বেকিং সোডা ও লেবুর রস একসঙ্গে মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করে নিন এবং তা দাঁতের ওপরে পাতলা করে প্রলেপ দিয়ে রাখুন। এরপর টুথব্রাশ দিয়ে দাঁত মেজে নিন এবং পানি দিয়ে কুলকুচি করুন । দাঁত ঝকঝক করবে।
লেবু দিয়ে ওজন কমানোর উপায়
লেবুতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা ক্যালোরি ক্ষয় করতে সাহায্য করে। প্রতিদিন সকালে লেবু মিশ্রিত বিভিন্ন পানীয় পান করলে অতিরিক্ত মেদ দূর হবে। জেনে নিন মেদ কমাতে লেবু কীভাবে খাবেন-
লেবুপানি-
একটি লেবু অর্ধেক করে কাটুন। এক গ্লাস পানিতে লেবুর রস মিশিয়ে প্রতিদিন সকালে পান করুন। এটি দিনের যেকোনও সময়ই পান করতে পারেন।।
মধু ও লেবু –
এক গ্লাস কুসুম গরম পানিতে ২ চা চামচ লেবুর রস ও ১ চা চামচ মধু মেশান। সকালে খালি পেটে পান করুন এতে দ্রুত ওজন কমবে। আরও পড়তে পারেনঃ মধুর উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম
পুদিনা পাতা ও লেবু –
এক গ্লাস কুসুম গরম পানিতে ২ চা চামচ লেবুর রস ও কয়েকটি পুদিনা কুচি মেশান। পানীয়টি প্রতিদিন পান করুন। স্বাদ বাড়াতে মধু যোগ করুন।
শসা ও লেবু –
লেবু ও শসা স্লাইস করে এক গ্লাস পানিতে ভিজিয়ে রাখুন সারারাত। পরদিন সকালে পান করুন পানীয়। শসায় থাকা পটাসিয়াম হজমের গণ্ডগোল দূর করে।
আদা ও লেবু-
আদা ও লেবুমিশ্রিত পানীয় নিয়মিত পান করলে বাড়তি মেদ দূর হবে।
লেবু চা–
দিনে দুইবার লেবু চা পান করতে পারেন। এক কাপ গ্রিন টিতে ২ চা চামচ লেবুর রস ও সামান্য আদা মিশিয়ে পান করুন। চাইলে মধু যোগ করতে পারেন।
লেবুমিশ্রিত সালাদ–
ভেজিটেবল সালাদ খাওয়ার আগে একটি পুরো লেবুর রস দিয়ে নিন। আরও পুষ্টিকর হবে সালাদ।
লেবুর ক্ষতিকর দিক
- যাদের অ্যাসিডিটির সমস্যা আছে তাদের অতিরিক্ত লেবু খেলে বুক জ্বালা করে।
- ওজন কমানোর জন্য খাদ্যাভ্যাসে লাগাম টানা হলে কার্বোহাইড্রেট ও অন্যান্য পুষ্টিগুণের অভাব দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে লেবুপানি পানের পরিমাণ বাড়িয়ে দিলে শরীরে ক্লান্তি ভর করতে পারে।
- অতিরিক্ত সেবনে গ্যাসের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এতে পেট ফাঁপাসহ নানান ধরনের সমস্যা ও অস্বস্তি অনুভূত হতে পারে।
- অতিরিক্ত লেবু ও লেবুর শরবত পানের ফলে পেটে ও তলপেটে ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
- লেবুর শরবত বেশি পান করলে কিছুটা দুর্বলতা অনুভূত হতে পারে।
খালি পেটে লেবু খেলে কি হয়?
সকালে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে লেবু খেলে অ্যাসিড হতে পারে। খালি পেটে লেবু খেলে আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় উৎসেচক পেপসিন ভেঙে যায়। পেপসিন আমাদের হজমে সাহায্য করে। এদিকে লেবুর মধ্যে থাকা সাইট্রিক অ্যাসিড পেপসিনকে ভেঙে ক্ষতিকর এনজাইম তৈরি করে। ফলে খাবার ঠিকমতো হজম হয় না।
কিডনির সমস্যা থাকলে কি লেবু খাওয়া যাবে।
জ্বী খাওয়া যাবে।