ত্বক মানবদেহের সবচেয়ে বড় অঙ্গ। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা – সব ঋতুতেই ত্বকের যত্ন নিতে হবে। কেননা নিয়মিত যত্নের মাধ্যমেই পাওয়া যেতে পারে সুন্দর, কোমল ত্বক। চলুন জেনে নেই মেয়েরা ত্বকের যত্ন নেবেন যেভাবে।
ত্বকের যত্নে প্রাকৃতিক উপাদান-
প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহারে ত্বক থাকবে যে কোনো ঋতুতেই সুস্থ আর প্রাণবন্ত।
ক) পেঁপে:
প্রাকৃতিক স্ক্রাব হিসেবে পেঁপে খুব ভালো কাজ করে। ২ চামচ পেঁপের পেস্ট ও ২ চামচ মধু একসাথে মিশিয়ে নিন। এটি ত্বকে লাগিয়ে রাখুন ১৫ মিনিট। শুকিয়ে গেলে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
খ) শসা:
শসায় রয়েছে প্রায় ৯০ শতাংশ পানি, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-কে ও ক্যাফিক এসিড, যা ত্বককে নরম, মসৃণ ও উজ্জ্বল করে।
গ) মুলতানি মাটি:
মুলতানি মাটি শুধু ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতেই নয়, ত্বকে জীবাণুনাশক হিসেবেও কাজ করে । এজন্য ১ চামচ মুলতানি মাটি, সঙ্গে ৩-৪ ফোঁটা লেবুর রস, ১ চামচ কাঁচা হলুদের রস, ১ চামচ দুধ মিশিয়ে মুখের ত্বকে ব্যবহার করতে পারেন।
ঘ) কাঁচা হলুদ:
কাঁচা হলুদে আছে কারকিউমিন, যা জীবাণুনাশক হিসেবে কাজ করে। এছাড়াও আছে এসেনশিয়াল অয়েল, যা ত্বকে আনে উজ্জ্বলতা।
রাতে ত্বকের যত্ন-
ত্বকের যত্ন নেওয়ার সেরা সময় হলো রাত। যদি চান ত্বকে তারুণ্যের দীপ্তি ঝলমল করুক, তবে কিছু পদক্ষেপ অনুসরণ করুন-
ক) মেক-আপ পরিষ্কার:
রাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপগুলোর মধ্যে একটি হলো, দিনের বেলায় ব্যবহৃত যেকোনো মেক-আপ পরিষ্কার করে ফেলা। মেক-আপ পরিষ্কার করার জন্য মাইসেলার ওয়াটার ব্যবহার করুন, যা মেক-আপ পরিষ্কার করার পাশাপাশি আপনার ত্বককে হাইড্রেটেড রাখবে।
খ) ক্লিনজিং:
ত্বকের ক্লিনজিংয়ের বেলায় এক কাপ ছোলার ডাল, এক কাপ বেসন সঙ্গে আধা কাপ চালের গুঁড়া, এক চা চামচ কর্পূর আর আধা কাপ কফি ভালো করে মিশিয়ে মিশ্রণটি প্রতিদিন মুখে ব্যবহার করতে হবে। এতে ত্বক যেমন উজ্জ্বল হবে, তেমনি ত্বকে থাকা ময়লা দূর হবে খুব সহজে।
গ) টোনার:
ত্বকের যত্নে টোনার ব্যবহার করলে ত্বকের পিএইচ ভারসাম্য বজায় থাকবে। মুখ ভালভাবে ফেইসওয়াশ দিয়ে ধোয়ার পর হালকা ভেজা মুখে টোনার ব্যবহার করা ভাল। ঘরে গোলাপের পাপড়ি, আপেল সিডার ভিনেগার দিয়েও সহজ উপায়ে টোনার বানানো যায়।
ঘ) ক্রিম আর সিরাম:
ত্বক পরিষ্কারের পর ক্রিম এবং সিরাম ব্যবহার করতে পারেন। কোনো উপাদানকে ত্বকের গভীরে সহজেই পৌঁছে দিতে ব্যবহার করা হয় সিরাম। ত্বক পরিষ্কার করার পর এবং ময়েশ্চারাইজ়ার ব্যাহারের আগে সিরাম ব্যবহার করা উচিত। সিরাম লাগিয়ে হালকা হাতে ম্যাসাজ করুন। তাহলে ত্বক তাড়াতাড়ি তা শুষে নেবে।
ঙ) ময়েশ্চারাইজার:
রাতে ত্বকের যত্নে অবশ্যই ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করবেন। যা ত্বককে আর্দ্র ও নরম রাখবে। এক্ষেত্রে ২ চামচ গ্লিসারিনের সঙ্গে ৮ চামচ গোলাপ জল, ১-১০ ফোঁটা অলিভ ওয়েল অথবা নারিকেল তেল মিশিয়ে একটি মিশ্রণ তৈরি করে বোতলে রেখে ময়েশ্চারাইজার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।
বর্ষায় ত্বকের যত্ন-
বর্ষায় একটু সচেতন হলেই নিজেকে স্নিগ্ধ, সতেজ ও আরো সুন্দর রাখা যায়। কিন্তু কীভাবে?
- নিয়মিত ত্বক পরিস্কার রাখতে হবে।
- দিনের বেলায় সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে হবে।
- সপ্তাহে দুইবার যবের গুড়ো ও পাকা পেঁপে ব্যবহার করলে ত্বক পরিস্কার ও উজ্জ্বল হবে ।
- ত্বকে গোলাপ জলের সঙ্গে গ্লিসারিন মিশিয়ে ব্যবহার করলে ত্বক নরম হবে।
- মেীসুমী ফল এবং শাকসবজি বেশি খাবেন। এছাড়া খালি পেটে ভেজানো ছোলা বা ভেজানো মুগডাল খেলে ত্বক জীবাণুমুক্ত থাকবে।
সেনসিটিভ ত্বকের যত্ন-
স্পর্শকাতর ত্বকে সাধারণত অ্যালোভেরা, নারকেল তেল বা দই ব্যবহার করতে পারেন। এছাড়া কিছু ঘরোয়া প্যাক ব্যবহার করতে পারেন –
- চন্দন বেটে তার সঙ্গে শসার রস ও সামান্য পরিমাণ দুধের সর মেশান- এই প্যাক মুখে লাগিয়ে ১০ মিনিট অপেক্ষা করুন। শুকিয়ে গেলে মুখ ধুয়ে নিন।
- টক দই আর অ্যালোভেরা জেল ভালো করে মিশিয়ে চোখের চারপাশ বাদে পুরো মুখে লাগাতে পারেন।
- গাজরের রস, কাঁচা এবং মাঠাযুক্ত দুধ একসাথে মিশিয়ে মুখে লাগান।
- কাঁচা হলুদের রসের সাথে দুধের সর মিশিয়ে আধ ঘণ্টা ফ্রিজে রাখুন। বের করে মুখে মেখে ১০ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন।
শীতে ত্বকের যত্ন-
শীতের শুরু থেকেই নিয়মিত ত্বকের পরিচর্যা করলে ত্বক থাকবে সতেজ, তরতাজা। তাহলে জানুন কিভাবে পরিচর্যা করবেন-
- গোসলের পর এবং প্রতিবার মুখ ধোয়ার পর ত্বক ভেজা থাকতেই ময়েশ্চারাইজার বা লোশন ব্যবহার করা উচিত।
- মাঝেমধ্যে মুখে পানির ঝাপটা দিন।
- কখনোই ঠোঁট শুকনা অনুভব করলে জিব দিয়ে ভেজানো উচিত নয়। ঠোঁট নরম রাখতে গ্লিসারিন ব্যবহার করা যেতে পারে।
- কয়েক ফোঁটা অলিভ অয়েল মধুর সঙ্গে মিশিয়ে ঠোঁটে লাগালে শীতে আর ঠোঁট কখনোই ফেটে যাবে না। ঘুমের সময় লিপজেল অথবা পেট্রোলিয়াম জেলি লাগালেও নরম থাকবে ঠোঁট।
- অতিরিক্ত গরম পানি ত্বকের কোষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এর ফলে ত্বকের আর্দ্রতা নষ্ট হয়। গোসলের সময় আরাম অনুভব হলেও অতিরিক্ত গরম পানি দিয়ে মুখ, মাথা ধোয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
- অলিভ অয়েল বা ময়েশ্চারাইজার পুরো মুখে ভালো করে মালিশ করে ঘুমিয়ে পড়বেন, এতে ত্বক পরিষ্কার ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে।
তৈলাক্ত ত্বকের যত্ন:
আপনি যদি তৈলাক্ত ত্বকের অধিকারী হন তবে বাড়িতেই যত্ন নিতে পারেন। প্রতিদিন মুখ পরিষ্কার করুন শসার রস দিয়ে। এতে ত্বকের তৈলাক্তভাব দূর হবে। চাইলে শসার রসের সঙ্গে চালের গুঁড়া মিশিয়ে স্ক্রাব হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন।
- তৈলাক্ত ত্বকে নিয়মিত গোলাপ জল ও লেবুর রস মিশিয়ে ব্যবহার করতে পারেন। এই দুই উপাদান মিশিয়ে মুখে লাগিয়ে মিনিট ত্রিশেক পর আলতোভাবে মুখ পরিষ্কার করে নেবেন। এতে ব্রণ ও ফুসকুড়ির সমস্যা থাকলে তা দূর হবে।
- মুলতানি মাটি, চন্দন পাউডার, কাগজি লেবুর রস, টক দই অথবা দুধের সর একসঙ্গে মিশিয়ে ১০ – ১৫ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন ত্বকের অতিরিক্ত তেল কেটে যাবে।
- ছোট মাছ, শাকসবজি ও মৌসুমি ফলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন ও মিনারেল যা ত্বকের জন্য ভালো।
- সকালে ঘুম থেকে উঠে উষ্ণ পানির সাথে মধু মিশিয়ে সেবন করা যায়।
রুক্ষ ত্বকের যত্ন:
রুক্ষ ত্বকের প্রয়োজন নিয়মিত যত্ন। ঘরোয়া উপাদানের সাহায্যে নিয়মিত যত্ন নিতে পারেন ত্বকের। জেনে নিন
- একটি কলা চটকে ২ চা চামচ লাল চিনি ও আধা চা চামচ আমন্ড অয়েল মেশান। মিশ্রণটি ত্বকে লাগিয়ে রাখুন। শুকিয়ে গেলে ধুয়ে ফেলুন।
- রাতে ঘুমানোর আগে অ্যালোভেরা জেল ম্যাসাজ করুন ত্বকে। পরদিন সকালে ধুয়ে ফেলুন।
- ডিমের কুসুম, অলিভ অয়েল ও লেবুর রস মিশিয়ে ফেস প্যাক বানান। চাইলে ডিমের কুসুমের সঙ্গে অ্যাভোকাডো মিশিয়েও বানিয়ে ফেলতে পারেন শুষ্ক ত্বকের প্যাক। মিশ্রণটি মুখ ও গলার ত্বকে লাগিয়ে রাখুন না শুকানো পর্যন্ত।
- ওটমিল গুঁড়া করে মধু ও দুধ মিশিয়ে পেস্ট বানিয়ে নিন। ফেস প্যাকটি ত্বকে ২০ মিনিট লাগিয়ে রেখে ধুয়ে ফেলুন।
- গোলাপের পাপড়ি শুকিয়ে গুঁড়া করে নিন। নারিকেল তেল, লাল চিনি ও আমন্ড তেল মিশিয়ে নিন এই গুঁড়ার সঙ্গে। ত্বকে লাগিয়ে কিছুক্ষণ রেখে ধুয়ে ফেলুন।
- শসা ও টমেটো একসঙ্গে পেস্ট বানিয়ে ২০ মিনিট ত্বকে লাগিয়ে রাখুন। পরে ধুয়ে নিন ত্বক।
- পাকা পেঁপে চটকে ত্বকে লাগিয়ে রাখুন ২০ মিনিট। দূর হবে রুক্ষতা।
গরমে ত্বকের যত্ন:
সূর্যের তাপ এবং ধুলাবালুর কারণে গরমে ত্বকের প্রয়োজন বাড়তি যত্ন। জেনে নিন সেই বিষয়ে-
- প্রচুর পানি পান, পুষ্টিকর খাবার, ব্যায়াম ও পর্যাপ্ত ঘুম ত্বক ভালো রাখবে।
- ঘরোয়া টোনার হিসেবে গোলাপজল ব্যবহার করতে পারেন।
- ত্বকে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করুন।
- বেসনের সাথে টক দই ও কয়েক ফোঁটা লেবুর রস মিশিয়ে মুখে লাগিয়ে রাখুন। শুকিয়ে গেলে ধুয়ে ফেলুন।
গর্ভাবস্থায় ত্বকের যত্ন:
গর্ভাবস্থায় থাকতে হবে সব সময় পরিপাটি, একটু গোছালোভাবে এবং অবশ্যই পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। আরও যা করতে হবে:
- ত্বক পরিস্কার রাখতে প্রতিদিন ক্লিনজার ব্যবহার করুন।
- স্ক্রাবার দিয়েও নিয়মিতভাবে ত্বক পরিস্কার করুন।
- ত্বক মসৃণ রাখতে ময়শ্চারাইজার ক্রিম লাগান।
- পানি শরীরের দূষিত পদার্থকে বাইরে বের করে দেয়, ত্বককে পরিস্কার রাখতে প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি পান করুন।
- এ সময় ত্বক খুব সংবেদনশীল হয়, তাই বাইরে গেলে অথবা রান্না করার সময় সানস্কিন লোশন ব্যবহার করুন।
- গর্ভধারণের প্রথম থেকেই নিয়মিত অলিভ ওয়েল ব্যবহার করুন।
- শরীর এবং মন ভাল রাখতে বাইরে ঘুরতে যান।
- হালকা কিছু ব্যায়াম করুন।
- নিয়মিত বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মত চলতে হবে।
মনে রাখতে হবে, সব সময় হাসিখুশি থাকুন। পরিবারের সবার সঙ্গে ভাল সময় কাটান। কেননা, ত্বকের যত্ন নেবেন যেভাবে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল মানসিক ভাবে সুস্থ থাকা যায় তা জানা। কারন, সুস্থ মানসিক স্বাস্থ্য সুন্দর ত্বকের পূর্বশর্ত।