আমরা বলে থাকি, “স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল”। পরিচিত কারোর সাথে দেখা হলে প্রথমত তার স্বাস্থ্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে থাকি। তবে স্বাস্থ্য বলতে অসুখবিসুখ না হওয়া কিংবা শরীর ভালো থাকাকে বুঝায় না। স্বাস্থের মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে, ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক অবস্থার সামগ্রিক কল্যাণকর অবস্থা।
স্বাস্থ্য কি?
বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা কর্তৃক দেওয়া সংজ্ঞা অনুযায়ী,
“স্বাস্থ্য বলতে সম্পূর্ণ শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক মঙ্গল বা কল্যাণবোধকে বোঝায়। শুধু রোগ বা দুর্বলতার অনুপস্থিতিকেই স্বাস্থ্য বলেনা”।
who.int
এর থেকে বলা সম্ভব, শারীরিক+মানসিক+সামাজিক এই তিন অবস্থার সুষম অবস্থানকে স্বাস্থ্য বলে।
মানসিক স্বাস্থ্য কি?
বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা (ডব্লিউএইচও) এর মতে মানসিক স্বাস্থ্য বলতে,
“একটি সুস্থতার অবস্থাকে বুঝায় যেখানে ব্যক্তি তার নিজের যোগ্যতা উপলব্ধি করতে পারে, জীবনের স্বাভাবিক চাপ মোকাবেলা করতে পারে, ফলপ্রসূ এবং ফলপ্রসূভাবে কাজ করতে পারে এবং তার অবদান রাখতে সক্ষম হয়”।
who.int
মানসিক স্বাস্থ্যের দরুন একজন ব্যক্তি এমন ক্ষমতা অর্জন করতে পারে, যা তাকে নিজের সঙ্গে এবং তার চারপাশে থাকা অন্যান্যদের সঙ্গে যুক্ত হতে বা একত্রিত হতে সাহায্য করে।
ডিপ্রেশন কি?
খারাপ মানসিক অবস্থা এবং এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মন-মেজাজ বা মানসিক অবস্থানের মারাত্মক অবনতি ঘটে।
ডিপ্রেশন এর লক্ষন:
- আবেগের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না।
- আগে যে সকল কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতেন, সেগুলি আর আপনাকে আকর্ষণ করতে পারবে না।
- সবসময় নিরাশ অনুভব হবে।
- শরীরে অস্বস্তি বা ব্যথা-বেদনা বেড়ে যাবে।
- নিজেকে ভালো লাগবে না।
- খাওয়াদাওয়ার সময়সূচিতে ফারাক।
- ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাবে।
- মনঃসংযোগে সমস্যা হবে।
- অহেতুক ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ করা।
- অল্পতেই রেগে যাওয়া।
- ইচ্ছে করেই প্রচন্ড ব্যস্ত একটি জীবন বেছে নেয়া।
- ভালো বা খারাপ- এমন অনুভূতি কোনোটাই না থাকা।
- অনুভূতিগুলো বেশিরভাগ লুকিয়ে রাখা।
ডিপ্রেশন কেন হয়?
গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যেকোনো দেশের জনসংখ্যার প্রায় ১০-২০ শতাংশ লোক ডিপ্রেশনে ভুগে থাকে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৮-৪৪ বছরের মধ্যে সাধারণত এ মানসিক সমস্যা বেশি হয়। আধুনিক নাগরিক জীবনের চাপে এই রোগটি যে কারো হতে পারে। ডিপ্রেশনের আরো কিছু কারণ নীচে তুলে ধরা হলো:
- জেনেটিক কারণ: পরিবারের রক্তসম্পর্কে আত্মীয়স্বজনের মধ্যে ডিপ্রেশনের সমস্যা থাকলে এই রোগ হতে পারে।
- বায়োকেমিক্যাল কারণ: মস্তিস্কের সেরাটোনিন ও নরএড্রানালিন এর ঘাটতি এবং অনিয়ন্ত্রিত কর্টিসল হরমোন বৃদ্ধিকে ডিপ্রেশন সৃষ্টির কারণ হিসেবে মনে করা হয়।
- ব্যক্তিত্ব: উদ্বেগপ্রবণ (কোনো কিছুকে অত্যন্ত বড় মনে করা), দুশ্চিন্তাগ্রস্থতা, নেশাগ্রস্ততা হয়ে পড়া-এসব সমস্যা ডিপ্রেশনকে বাড়িয়ে দেয়।
- স্নেহবঞ্চিত ও অবহেলা: পারিবারিক কোন্দলের মধ্যে বড় হয়ে ওঠা, দুঃখ-বঞ্ছনার শিকার হয়েও অনেকে ডিপ্রেশনে ভুগতে পারে।
ডিপ্রেশন দূর করার উপায়:
ডিপ্রেশন দেখা দিলে সর্বোপরি একজন অভিজ্ঞ মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিৎ। পারিবারিক বা সামাজিক কারণে ডিপ্রেশন দেখা দিলে সেগুলোকে চিহ্নিত করা। এবং দূর করার ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করতে হবে। ডিপ্রেশন হলে করনীয় সম্পর্কে নীচে তুলে ধরা হলো:
ক) ডায়েরি লিখুন:
আপনি যা ভাবছেন আর যেকারনে ভাবছেন তা নিয়ে লেখালেখি শুরু করুন। নিজের মনের ভেতর মা কিছু চলছে তা নিজের কাছেই শেয়ার করা শুরু করুন।
খ) বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ বাড়ান:
আমরা নিজেদের ইচ্ছেই মে সম্পর্কগুলো তৈরি করি তার মধ্যে বন্ধুত্ব অন্যতম। যদিও আপনার ঘরে একা থাকতেই বেশি ভালো লাগবে, ঘর থেকে বেরিয়ে কারো সাথে মেশার ইচ্ছেটা পর্যন্ত আপনার থাকবে না।
তবুও আপনার উচিত নিজের বন্ধুবান্ধবদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা, তাদের সাথে কথোপকথন আপনার পুরোনো আনন্দের সময়গুলোকে ফিরিয়ে আনবে ৷ নিজের প্রতি পূণরায় কিছুটা ভালো লাগা তৈরি করবে।
গ) কায়িক পরিশ্রম করা শুরু করুন:
খুব সাধারণ শারীরিক ব্যায়াম আপনার শারীরিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার পাশাপাশি ডিপ্রেশনের বিরুদ্ধেও করবে। ব্যায়াম আপনার মধ্যে কর্মদ্দীপনা বাড়ায় । কঠোর ব্যায়াম করে যে শারীরিক পরিবর্তন আপনি নিজের মধ্যে দেখবেন সেটা আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেবে আর ডিপ্রেশনকে দূরে রাখবে। পড়ুন – অতিরিক্ত ওজন কমানোর উপায়
ঘ) আপনার যা ভালো তা করুন:
ডিপ্রেশন তৈরির আরেকটি কারণ হচ্ছে নিজের মনের মতো কাজ না করতে পারা। নিজের মনের মতো কাজ করতে না পারলে হীনমন্যতার সৃষ্টি হয়। সেকারনে ডিপ্রেশন থেকে দূরে থাকার আরেকটি উপায় হচ্ছে নিজের ইচ্ছানুযায়ী কাজ করা।
ঙ) বই পড়া শুরু করুন:
বই পড়া আপনার জীবন থেকে একাকিত্বকে দূর করতে সহায়তা করবে। বলা হয়ে থাকে বই জীবনের সবচেয়ে উপকারী সঙ্গী। আপনার জীবনে বই হয়ে উঠতে পারে আপনার সবচেয়ে কাছের বন্ধু।
চ) মেডিটেশন বা ধ্যান:
ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে মেডিটেশন বা ধ্যান একটি অসাধারণ ওষুধ হিসেবে কাজে লাগতে পারে।
সাধারণত ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ব্যক্তির মনে স্থিরতার অভাব দেখা দেয়। মেডিটেশন মনের অস্থিরতা ভাব দূর করে একগ্রচিত্তে কাজ করতে সহায়তা করে।
ছ) Binaural Beats এর ব্যবহার:
Binaural Beats এক ধরনের সংগীত/মিউজিক যা আমাদের মস্তিষ্কের স্থিরতা আনতে সাহায্য করে। এটির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এটি আমাদের নিদ্রাজনিত সমস্যা দূর করে ভালো ঘুমে সাহায্য করে।
জ) হাসুন:
হাসতে হবে! যে ব্যক্তি যত হাসিখুশিতে থাকবে তার ডিপ্রেশনের সমস্যা তত কম হবে। বিভিন্ন স্থানে ‘লাফিং ক্লাবে’ যুক্ত হওয়া যেতে পারে। লাফিং থেরাপি আমাদের মনে খুশির উদ্রেগ ঘটাবে।
মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় করনীয় কি কি?
সুস্বাস্থ্যের একটি অন্যতম ও অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্য। আমাদের সকলের উচিত এটিকে গুরুত্ব সহকারে সুরক্ষা প্রদান করা। মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় করনীয়সমূহ নিম্নরূপ:নিজেকে মূল্য দেওয়া শুরু করুন।
- আপনার শরীরের যত্ন নিন।
- নিজেকে ভালো মানুষদের মধ্যে রাখুন।
- নিজেকে নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করে দিন।
- মানসিক চাপ মোকাবেলা করতে শিখুন।
- আপনার মনকে শান্ত রাখুন।
- বাস্তবসম্মত লক্ষ্য নির্ধারণ করে চলুন।
- একঘেয়েমি দূরে রেখে চলুন।
- মদ্যপান এবং অন্যান্য নেশাদ্রব্য এড়িয়ে চলুন।
যখনই আপনার প্রয়োজন হবে, তখনই সাহায্যের জন্য আপনার কাছের মানুষদের বলুন। আমাদের সকলেরই উচিত নিজের ও নিজের পরিবারের সকলের সুস্বাস্থ্যের উপর খেয়াল রাখা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী একজন মানুষের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সুষম অবস্থান বিরাজ করলেই তাকে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী বলা সম্ভব।
Thank you so much. Jajakallah to you🥰
আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ