প্রতিমাসে মেয়েদের জরায়ু থেকে যোনিপথে যে রক্ত বের হয় তাকে মাসিক বা পিরিয়ড বলে। এটি মেয়েদের জন্য একটি সাধারণ, নিয়মিত ব্যাপার। একেক দেশের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী মেয়েদের মাসিক আলাদা আলাদা সময়ে শুরু হয়ে থাকে। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি সাধারণত ১০ থেকে শুরু করে ১৪ বছরের মধ্যে আরম্ভ হয়।
শারীরিক বৈশিষ্ট্য ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিচারে এটি ৪৫ থেকে ৫০ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে প্রতিমাসে ৩ – ৭ দিন পর্যন্ত পিরিয়ড ব্লাড বা রক্তস্রাব হতে পারে। এতে প্রথম ২/৩ দিন বেশি রক্ত বের হয় এবং পরবর্তী দিনগুলোতে কম রক্ত বের হয়।
মাসিক হওয়ার অর্থ হচ্ছে মেয়েটি তার বয়ঃসন্ধিকালে প্রবেশ করেছে।
মাসিক বা পিরিয়ড কেন হয়?
মেয়েদের দেহে থাকা হরমোনের পরিবর্তন জনিত কারণে পিরিয়ড বা মাসিক হয়ে থাকে। মেয়েদের ডিম্বাশয় থেকে ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন হরমোন নিঃসরণ করে। এই হরমোন সমূহ মেয়েদের জরায়ু (গর্ভাশয়ে) একটি আস্তরণ তৈরি করে।
এই আস্তরণ সন্তান জন্মদানের সময় ছেলেদের শুক্রাণু ও মেয়েদের ডিম্বানুর মিলনের ফলে যে নিষিক্ত ডিমের সৃষ্টি হয় তার সাথে সাথে সংযুক্ত হয়ে এর বিকাশ শুরু করতে সহায়তা করে।
মাসিকের সময় যেসব কাজ এড়িয়ে চলবেন
- স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করলে, একটি প্যাড ৪ থেকে ৫ ঘন্টার বেশি সময় ব্যবহার করা উচিৎ নয়। একটি প্যাড বেশি ভেজা অনুভব করলে সঙ্গে সঙ্গে তা পরিবর্তন করে নিতে হবে।
- মাসিকের সময় অনেকেরই তলপেটে তীব্র ব্যথা হয়। তাই অনেকে পেটে চাপ দিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকেন। যা একদমই করা উচিত নয়। এছাড়াও উপুড় হয়ে শুয়ে থাকলে হার্ট রেটের তারতম্য ঘটে, রক্ত সঞ্চালন বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং সঠিক পরিমাণে অক্সিজেন সরবরাহ হয় না ফলশ্রুতিতে শরীর আরো খারাপ লাগে।
- পিরিয়ডের সময় ভারী জিনিসপত্র তোলা থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন। কেননা এসময় ভারী কাজ তলপেটে তীব্র ব্যথার উদ্রেক করতে পারে।
- মাসের এই সময়টায় ভারী ব্যয়াম করা থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়। এই ধরনের ব্যয়াম শরীরকে আরো দুর্বল করে তুলবে এই সময়।
- মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তাকে দূরে রাখতে চেষ্টা করুন। কেননা মাসিকের সময় হরমোনের পরিবর্তনের কারণে রাগ, বিরক্তিভাব বেড়ে যেতে পারে যা আপনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে।
মেয়েদের মাসিক হলে কি কি সমস্যা হয়
মাসিকের সময় যে সকল সমস্যা হয় তা ব্যক্তিবিশেষে আলাদা হতে পারে। আবার অনেকের ক্ষেত্রে এই ধরনের সমস্যা দেখা নাও যেতে পারে। তবে যেসব সমস্যা দেখা যেতে পারে তা নিম্নরূপঃ
- স্ট্রেস বা দুশ্চিন্তা
- ক্ষুধামন্দা
- মাথায় মাইগ্রেনের সমস্যার উদ্ভব
- মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া
- প্রস্রাবের পরিমাণে পরিবর্তন ইত্যাদি
- স্তনে ব্যথা হওয়া
- তলপেটে প্রচন্ড ব্যাথা
- বমি বমি ভাব
- অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়া
পিরিয়ড হলে কি খাওয়া উচিৎ
পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত লক্ষ্য রাখতে হবে। এই সময়টায় খাদ্য তালিকায় বেশি করে প্রোটিন, ক্যালসিয়াম ও প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার চেষ্টা করুন। এসময় শরীরের বেশি পুষ্টিকর খাবারের প্রয়োজন পড়ে। এসকল খাবার শরীরে প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও মিনারেল সরবরাহ করতে সহায়তা করে। যেমন:-
(ক) প্রচুর পানি পান করুন:
এসময় অনেকে বারবার টয়লেটে যাওয়া এড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় পানি পান করেন না। তবে এসময় অন্য সময়ের তুলনায় বেশি পরিমাণে পানি পান করা প্রয়োজন। কেননা মাসিকের সময় যে রক্তপাত হয় তার সাথে সাথে শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে পানি বের হয়ে যায়। তাই যথাসম্ভব চেষ্টা করুন শরীরকে হাইড্রেটেড রাখতে।
(খ) আদা:
কয়েক টুকরো আদা দিয়ে তৈরি চা মাসিকের খারাপ প্রতিক্রিয়া কমাতে সাহায্য করে। আদায় এন্টিইনফ্লেমটরি উপাদান থাকে যা বমি বমি ভাব রোধ করে। তবে এর অত্যধিক সেবন করা উচিত নয়, বেশি খেলে বদহজম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
(গ) চকোলেট:
মাসিকের সময় মনকে শান্ত করতে ও আয়রনের ঘাটতি পূরণ করার জন্য চকোলেট অত্যন্ত ভালো ভূমিকা পালন করে। তবে সবথেকে ভালো হয় ডার্ক চকোলেট খেলে। এতে বিপুল পরিমাণে আয়রন এবং ম্যাগনেশিয়াম থাকে।
(ঘ) সবুজ শাকসবজি:
সবুজ শাকসবজিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি এর পাশাপাশি অধিক মাত্রায় আঁশ থাকে। এগুলো হজমশক্তি বাড়াতে সহায়তা করে। এছাড়াও অন্ত্রের ভেতরে খাবারের নিয়মিত চলাচল নিশ্চিত করতেও সবুজ শাকসবজি বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
(ঙ) আয়রন রয়েছে এমন খাবার:
মাসিকের সময় রক্তশূন্যতা রোধ করতে এটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।পিরিয়ডের সময় যে রক্ত বের হয় তার ফলে শরীরে আয়রনের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। ফলে শরীরে ক্লান্তিভাব, মাথাব্যথা ও দুর্বলতা বেড়ে যেতে পারে। এই ঘাটতি পূরণের জন্য অবশ্যই প্রচুর আয়রন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করতে হবে।
(চ) ফল:
বেশি করে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার চেষ্টা করুন। ভিটামিন সি শরীরে আয়রনের কার্যকারিতার জন্য প্রয়োজনীয়। শরীরে পানির ভারসাম্য ঠিক রাখতে পানি সমৃদ্ধ ফল খেতে পারেন। যেমন: আম, তরমুজ, আপেল, কমলা ইত্যাদি।
পিরিয়ডের সময় অনেকে মিষ্টি খেতে পছন্দ করেন। তাদের জন্য মিষ্টি জাতীয় ফল ভালো বিকল্প হয়ে উঠতে পারে।
মাসিকের সময় যে জিনিসগুলো আপনি ব্যবহার করবেন
প্রত্যেক মেয়ের জীবনে মাসিক একটি বিশেষ সময়। পুরাতন সময়ে নারীরা অস্বাস্থ্যকর কাপড় ব্যবহার করতো নিজেদের মাসিকের সময়। তবে বর্তমানে এর অনেক বিকল্প তৈরি হয়ে গেছে। যেমন:
(১) স্যানিটারি প্যাড:
এটিই মেয়েদের মাসিকের সময় ব্যবহার হওয়া সবচেয়ে পুরোনো ও বহুল ব্যবহৃত বস্তু। দশম শতকের শেষ দিকে স্যানিটারি প্যাডের আবিষ্কার হয় বলে ধারণা করা হয়। এটি এতো বহুল ব্যবহারের পেছনে কারণ হচ্ছে এর সহজলভ্যতা ও সহজ ব্যবস্থাপনা।
তবে এতে প্রচুর পরিমাণে পরিমাণে প্লাষ্টিকের ব্যবহার হয়ে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর ৯০ শতাংশ প্লাস্টিক ব্যবহার করে তৈরি হতে পারে।
(২) মেনস্ট্রুয়াল কাপ:
গত কয়েক বছরে এর জনপ্রিয়তা বহুগুণে বেড়ে গেছে। এই কাপ দেখতে কিছুটা ইংরেজি সি অক্ষরের মতো। সিলিকনের তৈরি এই কাপ ভাঁজ করে মেয়েদের জনন অঙ্গে প্রবেশ করাতে হয়। সেখানে এটির ভাঁজ খুলে যায় এবং পিরিয়ডের রক্ত জমা হতে থাকে।
একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর এই কাপ বের করে রক্ত ফেলে দিয়ে ভালো করে পরিষ্কার করে নিলে তা আবার ব্যবহার করা যায়। বারবার ব্যবহার করা যায় বিধায় এটিতে খরচ কম হয়। ফলে অনেকেই এটি বর্তমানে পছন্দ করছেন। একটি কাপ কয়েক বছর পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়।
(৩) ট্যাম্পন:
পশ্চিমা বিশ্বে ট্যাম্পনের প্রচুর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। মেনস্ট্রুয়াল কাপের মত এটিকেও মেয়েদের প্রজনন অঙ্গে প্রবেশ করাতে হয়। তবে এটিও প্যাডের মতো একবারই ব্যবহার করা যায়।
ট্যাম্পন তুলা দিয়ে তৈরি করা হয় এবং এর মাথায় সুতার মতো থাকে। নির্দিষ্ট সময় পর এই সুতা ধরে টান দিয়ে ট্যাম্পন ফেলে দিতে হয়।
(৪) একাধিক ব্যবহারযোগ্য প্যাড:
পরিবেশের কথা মাথায় রেখে এমন স্যানিটারি প্যাড তৈরি করা হচ্ছে যা একাধিকবার ব্যবহার করা যায়। এসব প্যাড কাপড়ের তৈরি হয় এবং নিচের দিকে প্লাস্টিকের লেয়ার থাকে যা মাসিকের রক্ত প্যাডের বাইরে বের হতে দেয় না।
একবার ব্যবহার করা শেষে এটি ধুয়ে পুনরায় ব্যবহার করা যায়। এই ধরনের প্যাড একবার কিনে এক বছর পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়।
(৫) পিরিয়ড অন্তর্বাস:
যাদের মাসিকের সময় খুব অল্প মাত্রায় রক্ত বের হয় তবে তারা পিরিয়ড অন্তর্বাস বা প্যান্টি ব্যবহার করতে পারেন। এটি সাধারণ প্যান্টির কাপড়ের সাথে বাড়তি মোটা কাপড়ের স্তর ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। ফলে এটিকে বার বার পরিষ্কার করে ব্যবহার করা যায়।
মাসিকের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা
মাসিকের সময় অন্যান্য সময়ের তুলনায় বেশি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার উপর নজর দিতে হয়। অপরিষ্কার থাকলে এ থেকে সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। তাই নিচের বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতে হবেঃ
- প্রতিদিন স্নান করা;
- স্যাঁতস্যাঁতে প্যাড ব্যবহার না করা;
- প্রজনন অঙ্গে সাবান বা অন্য কোনো ইন্টিমেট হাইজিন প্রোডাক্ট ব্যবহার করা যাবে না;
- একটি সময়ে শুধুমাত্র একটি পদ্ধতি ব্যবহার করা। যেমন:- স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করলে তার সাথে ট্যাম্পন বা মেনস্ট্রুয়াল কাপ ব্যবহার না করা;
- নির্দিষ্ট সময় পরপর পদ্ধতি পরিবর্তন করা।
মাসিকের সময় বাইরে বের হওয়া
আপনি যখন মনে করবেন আপনার মাসিকের সময় শুরু হবে তখন আপনার উচিত হবে বাইরে বের হওয়ার সময় প্রস্তুতি নিয়ে তারপর বের হওয়া। কেননা পিরিয়ডের রক্তপাত যেকোনো সময় শুরু হতে পারে। একটি ভালো পলিথিন বা কাগজের প্যাকেটে আপনার ব্যবহার করা পদ্ধতিটি রেখে দিন, একই সাথে একটি পাতলা তোয়ালেও রেখে দিতে পারেন।
আপনার ব্যাগে কিছু পেপার টিস্যু এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার রেখে দিন যা প্রয়োজনের মুহূর্তে কাজে আসবে। আপনার সাথে সবসময় কিছু নাস্তা ও এক বোতল পানি রাখবেন। ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে একটি ব্যথার ওষুধ রেখে দিন হাতের নাগালের মধ্যে।
পরিশেষেঃ
এটা মনে রাখা দরকার যে প্রত্যেকের পিরিয়ড সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা আলাদা হতে পারে। তাই আপনার যদি কোনো বিষয় নিয়ে সমস্যা মনে হয় তবে অতিশীঘ্র একজন প্রশিক্ষিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
পিরিয়ডের মতো একটি স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক বিষয় নিয়ে ভয় বা লজ্জা থাকা উচিত নয়। এবিষয়ে সবার জানা থাকা দরকার। কেননা প্রতিটি নারীর জীবনেই পিরিয়ডের সময় আসে।