একজন সাধারণ মানুষের জীবনে ভাত, চিনি ও লবণ এই তিনটিই তার নিত্যদিনের খাবারের অংশ। তবে এই তিনটির অতিরিক্ত ব্যবহার বয়ে নিয়ে আসতে পারে ভয়াবহ পরিণতি। তাই একত্রে এই তিনটিকে “সাদা বিষ” নামে ডাকা হয়। যারা স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন তারা এই তিনটিকে সর্বদা নিয়ম মাফিক গ্রহণ করে চলেন।
ভাত, চিনি ও লবণ – দৈনন্দিন ব্যবহার
এশীয় দেশগুলোতে প্রতিদিনকার খাদ্যতালিকার অধিকাংশ জায়গা জুড়েই থাকে ভাত, চিনি ও লবণের ব্যবহার। নীচে এদের ব্যবহার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
ক) সাদা ভাত:
বাঙালিদের ৯৯.৯৯% বাসায় প্রতিদিন ৩ বেলা সাদা ভাত খায় বললে ভুল হবেনা। কিন্তু অনেকেই এর সঠিক পরিমাণ সম্পর্কে জানেন না। অনেকেই শুধু পেট ভরার জন্য ইচ্ছামত এটি গ্রহণ করেন। তবে এটির ব্যবহার করা উচিত শরীরে প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদানের যোগান দেওয়ার জন্য।
খ) সাদা চিনি:
মূলত খাবারে মিষ্টি স্বাদ বৃদ্ধি করার জন্যই খাবারে চিনির ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এর অতিরিক্ত ব্যবহার অনেক ক্ষেত্রেই জীবনকে কষ্টদায়ক করে তুলতে পারে। তবে স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে অনেকেই এর ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে জানতে শুরু করেছে। চিনি আসলে বিভিন্ন উপায়ে খাদ্য প্রযুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। যেমন: সুইটেনার, প্রিজারভেটিভ, টেক্সচার মডিফায়ার, ফারমেন্টেশন সাবস্ট্রেট, ফ্লেভারিং এবং কালারিং এজেন্ট, বাল্কিং এজেন্ট।
গ) লবণ:
লবণ খাবারের স্বাদবর্ধক হিসেবে কাজ করে। এটি আসলে খাদ্যের স্বাদকে বের করে আনতে সহায়তা করে। তবে বর্তমানে ফাস্টফুড থেকে শুরু করে বাসায় প্রতিদিনের খাবারে উচ্চ মাত্রার লবণ বা সোডিয়াম লুকিয়ে থাকে। কেননা কেউ এর সঠিক পরিমাণ সম্পর্কে অনেকে জানেন না, কেবল স্বাদের ভিত্তিতে নির্ধারণ হয় এর ব্যবহার মাত্রা। তাছাড়া আমাদের দেশে প্রচলিত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের লবণে যে পরিমাণ খনিজ উপাদান ও আয়োডিন থাকা দরকার তার চেয়ে অনেক কম বা কোন কোন ক্ষেত্রে থাকে না বললেই চলে।
সাদা ভাত সাদা চিনি ও লবণঃ কেন এদেরকে সাদা বিষ বলা হয়
অনেকে না বুঝে অথবা না জেনে নিয়মিতই এই তিন ধরনের সাদা বিষ গ্রহণ করে চলেছেন। এদের মধ্যে রিফাইন্ড লবণ ও রিফাইন্ড চিনির অতিরিক্ত ব্যবহার বাড়িয়ে দিচ্ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি। কারণ এদের মধ্যে সঠিক পরিমাণে প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেল নেই। এছাড়াও এগুলোতে অনেক ক্ষেত্রে শরীরের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিকের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। নীচে এদের শরীরের উপর খারাপ প্রভাব সর্ম্পকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলো:
১) দ্রুত বার্ধক্য:
সাদা চিনির শর্করা আপনার শারীরিক গঠনকে প্রভাবিত করে। কিন্তু এর অতিরিক্ত পরিমাণ আপনার ত্বক কুঁচকে যাওয়া এবং ঝুলে যাওয়ার পরিণতি ডেকে আনতে পারে। চিনিতে থাকা রাসায়নিক উপাদান রক্তের প্রোটিনের সাথে বিক্রিয়া করে ত্বকের স্থিতিস্থাপকতাকে নষ্ট করে দিতে পারে। এর ফলে অকাল বার্ধক্য দেখা যায়।
২) হজমে সমস্যা:
লাল চালের ভাত কিন্তু আসলে অত্যন্ত উপকারী। তবে আধুনিক হতে গিয়ে আমরা সাদা চালের প্রতি এতটাই আসক্ত হয়ে পড়েছি যে আজকাল কেউ লাল চালের ব্যবহার করতে চান না। সাদা চালে উপস্থিত হাই কার্বোহাইড্রেট আমাদের মেটাবোলিজম হার অর্থাৎ হজমের ক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়। উপরন্তু পেটপুরে ভাত খাবার পর ঘুমিয়ে গেলে শরীরের আরো ক্ষতি হয়।
৩) পেটের ক্যান্সার:
২০১৪ সালে প্রকাশিত ব্রিটিশ জার্নাল অফ ক্যান্সারের একটি সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী লবণের অতিরিক্ত ব্যবহার পাকস্থলীর ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই যতটুকু কম পারা যায় ততটুকু লবণ খাওয়া উচিত। কেননা প্রাকৃতিকভাবেই খাবারের মধ্যে প্রয়োজনীয় লবণ থাকে।
লবণের ফলে পেটের ক্যান্সার হওয়ার প্রকৃত কারণ সম্পর্কে এখনো ধারণা পাওয়া যায় না। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী, অতিরিক্ত লবণের ব্যবহার পেটের আলসার বা পেটের আস্তরণের প্রদাহ সৃষ্টি করে ক্যান্সারের ঝুঁকিকে বাড়িয়ে তোলে।
৪) হাড় দূর্বল করে:
আপনি যতবেশি লবণ খাবেন আপনি প্রস্রাবের মাধ্যমে তত বেশি শরীর থেকে ক্যালসিয়াম হারাবেন। পরবর্তীতে এই ঘাটতি পূরণ না হলে আপনার শরীরের অস্টিওপরোসিসের মতো সমস্যা দানা বাঁধতে পারে। এর থেকে সামান্য আঘাতেই হাড় ভেঙে যেতে পারে।
৫) ওজন বৃদ্ধি:
বেশকিছু গবেষণায় দেখা গেছে, অত্যধিক ভাত খাওয়ার ফলে ওজন বৃদ্ধি এবং স্থূলতার কারণ দেখা পারে। কেননা সাদা ভাতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার ও কার্বোহাইড্রেট থাকে যা এটিকে ত্বরান্বিত করে। কিন্তু ঐতিহ্যগতভাবে ভাতের প্রতি আকৃষ্ট থাকার ফলে আমরা এর থেকে দূরে থাকতে পারি না।
৬) রক্তচাপ বাড়িয়ে তোলে:
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, অতিরিক্ত লবণ-সমৃদ্ধ খাবার মানুষের রক্তচাপকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে তুলতে পারে। তাই ব্লাড প্রেসারে আক্রান্ত ব্যক্তিদের এটি থেকে দূরে থাকা উচিত।
৭) স্ট্রোক হওয়ার প্রবণতা:
আমরা বাইরে যেসকল খাবার খাই তার বেশিরভাগেই স্বাদ বাড়ানোর জন্য অতিরিক্ত লবণ দেওয়া হয়। এথেকে স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। এদের মধ্যে “সোডিয়াম গ্লুটামেট” যাকে আমরা টেস্টিং সল্ট হিসেবেও চিনি তা অন্যতম। একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, সারাবিশ্বে স্ট্রোকে আক্রান্ত মৃত্যুর সংখ্যা ৭০ শতাংশ এবং তা দিনদিন বেড়েই চলেছে।
৮) হৃদযন্ত্রের সমস্যা:
বেশি চিনি ব্যবহারের ফলে হার্টের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। রক্তে চিনির পরিমাণ বেড়ে গেলে হার্টের পরিস্থিতি খুব খারাপ হয়ে যায়। আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশনের রিপোর্ট অনুযায়ী, অতিরিক্ত চিনি খাওয়ার ফলে কেউ যদি একবার ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে, তাহলেও হার্টের কর্মক্ষমতা তো কমেই, সেই সঙ্গে স্ট্রোক এবং হার্ট ফেইলিওরের সম্ভাবনাও প্রায় ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়। প্রতিদিন ৬ চামচের বেশি চিনি খাওয়া ঠিক নয়।
৯) মানসিক চাপ বাড়ে:
পাবলিক হেলথ জার্নালের করা একটি গবেষণা অনুযায়ী অতিরিক্ত পরিমাণে চিনি খেলে কিছু সময় পর মানসিক অবসাদে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৪০ শতাংশ বেড়ে যায়। রক্তে মাত্রাতিরিক্ত চিনি বেড়ে গেলে মস্তিষ্কের অন্দরে ডোপামাইন নামক ফিল গুড হরমোনের ক্ষরণ কমে যেতে শুরু করে। ফলশ্রুতিতে স্বাভাবিকভাবেই মন খারাপের পরিস্থিতি দেখা দেয়।
১০) প্রয়োজনীয় উপাদানের অভাব:
মাত্রারিক্ত ভাত শরীরের ভিটামিন, আয়রনের বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করে। অধিক পরিমাণে ভাত শরীরে ভিটামিন বি হ্রাস করে। শরীর থেকে জিঙ্ক বেড়িয়ে গেলে তা শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তাই আমাদের পরিমিত পরিমাণে ভাত গ্রহণ করা প্রয়োজন।
১১) কোলেস্টেরল বৃদ্ধি পায়:
জার্নাল অব দা আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের প্রকাশ করা রিপোর্ট অনুসারে চিনির ব্যবহার বাড়তে থাকলে রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায়। একইসঙ্গে ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রাও স্বাভাবিক সীমা অতিক্রম করে। এর ফলে হার্টের উপর মারাত্মক চাপ পড়ে।
১২) আর্সেনিক আক্রান্ত:
অন্যান্য খাদ্যশস্য অপেক্ষা ধানে অত্যধিক আর্সেনিক জমা হয়। প্রকৃতপক্ষে, এটি অজৈব আর্সেনিকের একক বৃহত্তম খাদ্য উৎস, যা আরও বিষাক্ত রূপ। যদিও এর বিষক্রিয়ার তাৎক্ষণিক কোনো সমস্যার সৃষ্টি হয় না, কিন্তু অজৈব আর্সেনিকের দীর্ঘমেয়াদি গ্রহণ শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের বিভিন্ন স্নায়ুর সমস্যা(যেমন: প্রতিবন্ধীতা, শেখার এবং স্মৃতিশক্তি হ্রাস, বুদ্ধিমত্তা হ্রাস) মধ্য দিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
১৩) সুষম খাদ্যের অভাব:
শুধুমাত্র এক ধরনের খাবার খাওয়া মানবদেহের জন্য স্বাস্থ্যকর নয়। একটি সুষম খাদ্যতালিকায় সবধরণের খাবার থাকে এবং নিয়মিত ভাত খাওয়া কখনো শরীরকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে না। একইসাথে অতিরিক্ত ভাত খাওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে ভিটামিন এ, জিঙ্ক, আয়রনের অভাব দেখা দেয়।
কিছু প্রশ্নঃ
ক) সাদা ভাতের বিকল্প হিসেবে কি খাওয়া যায়?
উত্তর: সর্বোপরি নিয়মিত ভাত খাওয়া যতটুকু সম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। এরপরও যেহেতু ভারতীয় উপমহাদেশে ৮৫% বাসায় নিয়মিত ভাত তৈরি করা হয়, তাই সাদা ভাতের বিকল্প হিসেবে লাল চালের ভাত খাওয়া যেতে পারে। সাদা ভাত অপেক্ষা লাল চালের ভাত সর্বোপরি উত্তম এবং অধিক পুষ্টিসমৃদ্ধ। খাদ্য তালিকায় আলুর পাশাপাশি অনান্য সবজি গ্রহনে অভ্যস্ত তৈরী করা।
খ) লবণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা?
উত্তর: প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত সকল খাদ্যদ্রব্যেই তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী লবণের উপস্থিতি রয়েছে। তবে লবণকে যেহেতু একবারে ছেড়ে দেওয়া সম্ভব নয় তাই আমাদের এটির ব্যবহার পরিমিত পর্যায়ে করা উচিত। কাঁচা লবণের বিকল্প হিসেবে লবণ ভেজে ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়াও বিট লবণ, সৈন্ধক লবণ উপযুক্ত বিকল্প হয়ে উঠতে পারে এদের মধ্যে থাকা অধিক পুষ্টিগুণ ও প্রাকৃতিক হওয়ার কারণে।
গ) মিষ্টি বাড়াতে সাদা চিনির বিকল্প?
উত্তর: বর্তমানে মানুষের সতর্ক অবস্থানের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় এখন তারা চিনিকে এড়িয়ে চলেন। কিন্তু এর বিকল্প সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা নেই। এটির আদর্শ বিকল্প হিসেবে গুড় ও মধু ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এদুটি সম্পূর্নভাবে প্রাকৃতিক এবং চিনি অপেক্ষা বেশি মিষ্টত্ব ও পুষ্টি সরবরাহ করে।
পরিশেষে –
আপনি হয়তোবা সহজেই ভাত, চিনি ও লবণকে আপনার খাদ্যতালিকা থেকে সরিয়ে ফেলতে পারবেন না। তবে একবার শুরু করার পর পিছনে ফিরে তাকাবেন না বা আপনার সিদ্ধান্তের জন্য অনুশোচনা করবেন না। সবসময় মনে রাখবেন আপনি একটি নতুন জীবন শুরু করতে চলেছেন। সর্বোপরি একজন পুষ্টিবিদ বা ডায়েটিশিয়ানদের সাথে পরামর্শ নিয়ে দেখতে পারেন।
তথ্যসূত্রঃ
https://www.bumrungrad.com/en/health-blog/november-2015/dangers-consuming-too-much-salt-effect
আরও পড়তে পারেন –