বিভিন্ন প্রকার চাল ও লাল চাল খাওয়ার উপকারিতা


চাল হল আমাদের দেশের প্রধান খাদ্যশস্য। এই ধান বা চাল উৎপাদনের উপরই আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের জীবিকা নির্ভর করে। এই খাদ্যশস্য থেকে ভাতের পাশাপাশি মুড়িও পাওয়া যায়। কিন্তু চালের বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে। এখানে আমরা প্রচলিত কিছু চাল সম্পর্কে ও লাল চাল খাওয়ার উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ সম্পর্কে জানবো।

প্রচলিত কিছু চাল সম্পর্কে জেনে নেই

নাজিরশাইল চাল

নাজিরশাইল চালও মিনিকেটের মতোই। এটিও কোনো বিশেষ প্রকার ধান থেকে উৎপন্ন হয় না। এটি ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ জাতের ধান থেকে উৎপাদিত চালকে পলিশ করে ও ছেঁটে বাজারজাত করা হয়। এটিও মিনিকেটের মতোই দেখতে সাদা ও সুন্দর হওয়ায় মানুষ এটি বেশি কিনে। কিন্তু এরও মিনিকেটের মতো তেমন কোনো উপকারিতা নেই।

বাসমতি চাল

স্বাদ কিংবা গন্ধ যাই হোক সেরা চালের নাম বললে বাসমতি চালের নামই সবার প্রথমে আসে। শরীরের জন্যও এই চাল কোনোভাবেই ক্ষতিকর নয়। বরং যেকোনো সাধারণ চালের চেয়ে অনেক বেশি পুষ্টিকর হল বাসমতি।

পুষ্টিগুণে এই চাল অনন্য। এই চালে আছে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, অল্প পরিমাণে ফ্যাট, ভিটামিন, ফাইবার এবং মিনারেলের মতো নানা পুষ্টি উপাদান যা শরীরের জন্য খুবই উপকারী। এই চালের যেসব উপকারিতা রয়েছে তা জেনে নিই।

  • হরমোন নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে মেজাজ ও মন ঠিক থাকে। রাগ উঠার প্রবণতা কমে।
  • এতে থাকা থায়ামিন ও নায়াসিন ভিটামিন হজমশক্তি বাড়ায়।
  • এটি হার্ট ভালো রাখতে সাহায্য করে।
  • এতে থাকা ফাইবার পেটের বিভিন্ন রোগে উপকার করে এবং হজম ক্ষমতা বাড়ায়।
  • এটি কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
  • শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে বলে ডায়াবেটিস রোগীরাও এটি খেতে পারেন।
  • এতে থাকা ফাইবার অনেকক্ষণ পেট ভরা রাখতে সাহায্য করে। ফলে অন্য খাবার খেতে ইচ্ছা করে না, যা ওজন কমাতে ভূমিকা রাখে।

পাইজাম চাল

চালের আরেকটি প্রকার হল পাইজাম চাল। এটি আমন ধান থেকে উৎপাদিত হয়। এরও রয়েছে বেশ কিছু শারীরিক উপকারিতা। আসুন জেনে নিই এর উপকারিতা গুলো।

  • ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।
  • দেহের অতিরিক্ত ওজন বা চর্বি কমাতে সাহায্য করে।
  • দেহের অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের অভাব পূরণ করে।
  • হজম ক্ষমতা বাড়ায়।
  • হৃৎপিণ্ডের কর্মক্ষমতা বাড়ায়।
  • ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।

আমন চাল

আমন ধান থেকে উৎপাদিত চালই হল আমন চাল। দ্রুত সিদ্ধ হওয়া এই চালের চারপাশে রয়েছে বাদামী একধরণের আস্তরণ। আমন চাল একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর। এতে রয়েছে শর্করা, ফাইবার, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, জিংক, আয়রন, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, ম্যাংগানিজ ও সেলেনিয়াম ইত্যাদি পুষ্টি উপাদান। এ সকল পুষ্টি উপাদান দেহের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এই খাবারের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স অনেক কম। অর্থাৎ, এতে চিনির পরিমাণ কম। তাই এটি দেহের শর্করার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় না। তাই ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এটি খুবই উপকারী। পাশাপাশি এতে রয়েছে ফাইবার যা ওজন কমাতে সাহায্য করে। একইসাথে পেটের বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধেও এই ফাইবার সুরক্ষা দেয়। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতেও এটি সাহায্য করে। পাশাপাশি ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতেও এই চালের ভূমিকা আছে।

কাউনের চাল

কাউনের চাল খুবই পরিচিত একটি নাম। এ চাল থেকে তৈরিকৃত খিচুড়ি কিংবা পায়েস খেতে খুবই মজার ও সুস্বাদু। মূলত পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষ এই চাল বেশি ব্যবহার করে থাকে। পাহাড়ি কোনো উৎসব কিংবা অতিথি আপ্যায়নে এটি খুবই প্রচলিত।

এটি যেমন সুস্বাদু তেমনি পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধও। ছোট দানার এই খাদ্যশস্যে রয়েছে ফাইবার, অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের মতো উপাদান। এছাড়াও এতে রয়েছে প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, পানি, পটাশিয়াম, ভিটামিন-বি, মিনারেল ইত্যাদি।

এটি দেহের নানা উপকার করে থাকে। এটি হতে প্রস্তুতকৃত খাদ্য পাকস্থলীকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়। কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। পাশাপাশি এতে জিংক, পটাশিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম থাকায় নারীদের জন্যও এটি বিশেষভাবে উপকারী।

মিনিকেট চাল খাওয়ার অপকারিতা

Mini ও Kit নামক দুটি শব্দ থেকেই এই চালের নামের উৎপত্তি। মূলত ভারতে এই চালের উদ্ভব। দেখতে বেশ সুন্দর ও সাদা হওয়ায় এই চাল বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু এটি কতটা উপকারী?

মিনিকেট চাল নিয়ে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার রিপোর্ট

এই চাল আসলে আলাদা কোনো প্রকারের চাল নয়। অন্য মোটা চালকে ঘষেমেজে ছোট করে এর নাম দেওয়া হয় মিনিকেট চাল। এই চালকে ছেঁটে দিয়ে ছোট করার ফলে এটি থেকে ক্ষতিকর ফ্যাটিক এসিড বেরিয়ে যায় ঠিকই কিন্তু অন্যদিকে অন্যান্য উপকারী উপাদানও কিন্তু বেরিয়ে যায়। মোটা চাল থেকে বিভিন্ন অংশ অপসারণ করে মিনিকেট চাল প্রস্তুত করার কারণে এ থেকে ৮০ ভাগ পুষ্টি ও ভিটামিনই বেড়িয়ে যায়।

আর এই ভিটামিন ও পুষ্টি বেরিয়ে যাওয়ার কারণেই এই চাল বেশিদিন টেকে। কারণ তখন এতে পোকামাকড় ও জীবাণুও আক্রমণ করে না। কারণ পুষ্টি না থাকলে জীবাণুর কাছেও এর গ্রহণযোগ্যতা নেই। তাই এক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই সচেতন হওয়া উচিৎ। মিনিকেট চালের চেয়ে লাল চাল কিংবা অন্য মোটা চাল খাওয়া উত্তম।

আরও পড়তে পারেন – ভাত, চিনি ও লবণ – ৩ সাদা বিষ

ঢেঁকি ছাঁটা চাল খাওয়ার উপকারিতা

খানিকটা লালচে ধরনের দেখতে এই ঢেঁকি ছাঁটা চাল ব্রাউন রাইস বা লাল চাল হিসেবেই আজকাল বেশি পরিচিত। পালিশ করা হয় না বলে এই চালের উপরিভাগে ধানের তুষের কিছু অংশ থেকে যায়। আর এই কারণেই এই চালের পুষ্টি অন্য যেকোনো ধরনের চালের চেয়ে অনেক বেশি।

ক) ওজন কমাতে ও রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে

পুষ্টিবিদরা মনে করেন, এই চালে রয়েছে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সহ নানা গুণাগুণ। সাধারণ চালের চেয়ে ব্রাউন রাইসে ফাইবার থাকে বেশি পরিমাণে। এই ফাইবার থাকার কারণে দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা থাকে। ফলে অন্য খাবার খাওয়ার ইচ্ছা তেমন একটা থাকে না। এতে ওজনও কমে। আবার এই চাল দেহের শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণেও ভূমিকা রাখে।

খ) রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে

এই চালের আছে নিউরোট্রান্সমিটার নিউট্রিয়েন্ট যা বিভিন্ন রোগের প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। পাশাপাশি স্নায়ুবিক নানা রোগ প্রতিরোধেও এই চাল কার্যকর। ভিটামিন-বি, ভিটামিন-ই, ম্যাঙ্গানিজ, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, সেলেনিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদি পুষ্টিগুণ সম্পন্ন এই চাল খাওয়া চাইলে শুরু করতে পারেন। এতে উপকৃত হবেন।

ঢেঁকি ছাঁটা চাল বা লাল চাল

গ) ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়

লাল চালে রয়েছে অ্যানথোসায়ানিন নামে একপ্রকার অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট যা শরীরের বিভিন্ন প্রদাহ কমায়। পাশাপাশি এটি এলার্জিও কমায়। এছাড়াও এই অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায় এবং ওজন কমাতেও এটি বেশ কার্যকর।

লাল চালে অনেক বেশি পরিমাণে আঁশ থাকে। আর আঁশযুক্ত খাবার দেহের কোলেস্টেরলের মাত্রা ঠিক রাখে, হজমশক্তি বাড়ায়, ক্যান্সার সৃষ্টিকারী কোষকে প্রতিরোধ করে। এছাড়াও লাল চালে রয়েছে সেলেনিয়াম নামক খনিজ উপাদান যা অন্ত্রের ক্যান্সার প্রতিরোধ করে।

ঘ) হাঁড় ও দাঁতের গঠন শক্ত ও মজবুত করে

এছাড়াও লাল চালে রয়েছে ভিটামিন বি১, বি৩, বি৬ ও ম্যাঙ্গানিজ, ফসফরাস ইত্যাদি উপাদান। এই চালে বেশি পরিমাণে আয়রন থাকায় এটি খেতে খুব সুস্বাদু। এতে থাকা ভিটামিন-বি৬ দেহের জন্য প্রয়োজনীয় সেরেটোনিন ও লোহিত রক্তকণিকা উৎপাদন করে। এছাড়াও এতে থাকা ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম দেহের হাঁড় ও দাঁতের গঠন শক্ত ও মজবুত করে। সুতরাং, এ সকল উপকারিতা বিবেচনায় নিয়ে বলাই যায়, লাল চাল খাওয়া অনেক উপকারী।

এক নজরে দেখে নিন-

  • এতে থাকা ফাইবার দেহের খাদ্য হজমে সাহায্য করে।
  • লাল চালে গ্লাইসেমিক ইনডেক্স এর পরিমাণ কম হওয়ায় ডায়াবেটিস রোগীদের জন্যও এটি উপকারী।
  • এই চাল হার্টের উপকার করে। গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম হওয়ায় হৃদরোগীদের জন্য এটি বিশেষ উপকারী।
  • এই চাল প্রতিদিন অন্তত ১ কাপ খেলে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়।
  • এই চাল খেলে পেট অনেকক্ষণ ভরা থাকে। ফলে অন্য খাবার খেতে ইচ্ছা হয় না। ফলে ওজন কমে।
  • এছাড়াও এই চাল ওজন কমানোর পাশাপাশি স্থূলতা প্রতিরোধ করতেও বেশ কার্যকর।
  • গর্ভবতী মা ও স্তনদানকারী মায়েদের জন্যও এই চাল বেশ উপকারী।
  • তাছাড়া লাল চাল শ্বাসকষ্ট ও এ জাতীয় রোগ প্রতিরোধেও বেশ কার্যকর।

চাল ধোয়া পানির উপকারিতা

চাল ধোয়া পানির ব্যবহার বর্তমানে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে ত্বক ও চুলের যত্নে এর ব্যবহার হয়। এই পানি ভিটামিন-বি সমৃদ্ধ হওয়ায় এটি ত্বক ও চুলের ঔজ্জ্বল্যতা বাড়ায়।

মুলতানি মাটি, মেথির পাউডার বা গুঁড়ার সাথে চাল ধোয়া পানি মিশিয়ে ত্বকে ব্যবহার করা যায়। পাশাপাশি জিরা বাটা ও লেবুর রসের সাথে মিশিয়েও এটি ব্যবহার করা যায়। ত্বকের ঔজ্জ্বল্যতা বাড়ানোর পাশাপাশি এটি ত্বকের মেছতার দাগও দূর করে।

এছাড়াও চুলের ক্ষেত্রে মেথির গুঁড়ার সাথে মৌরি ও চাল ধোয়া পানি মিশিয়ে চুলের খুশকি থেকে মুক্তি মিলবে। এছাড়াও কোনো কিছু না মিশিয়েই এই পানি দিয়ে মুখ ধোয়া যায়। দ্বিতীয় ধোয়ার পানি ব্যবহার করা উচিৎ চাল ধোয়া পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে।

লাল চাল কোথায় পাওয়া যায়? 

বাংলাদেশে ঢেঁকিছাটা চালই মূলত লাল চাল হিসেবে পরিচিত। ঢেঁকিছাটা চালের উপরের লাল আস্তরণ রেখে দেওয়ার কারণেই মূলত এটি লাল চাল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। অনেক জায়গায় আবার আমন চালও লাল চাল হিসেবে বিক্রি হয়।

পূর্বে সারা দেশেই লাল চাল পাওয়া যেত। ঢেকির প্রচলন কমে যাওয়া ও আধুনিক যন্ত্রের প্রচলনের কারনে লাল চাল উৎপাদন কমে গিয়েছে। তাছাড়া লাল চাল প্রক্রিয়া করতে উৎপাদনকারীর খরচও অনেক বেড়ে যায়। তবে আশার কথা হল অনলাইনে অনেকেই ঢেকি ছাটা বিক্রি করছেন।

পরিশেষে –

চাল বা ভাত আমাদের প্রধান খাদ্য। তবে অনেক চাল থেকে তৈরি ভাত ক্ষতি করে থাকে। বিভিন্ন ধরনের চাল থেকে তৈরি ভাতে শর্করা অনেক বেশি থাকে যা ক্ষতি করে। পাশাপাশি শরীরে ক্ষতিকর ফ্যাট বাড়ায়। তাই এ সকল ক্ষেত্রে আমাদের সতর্ক থাকা উচিৎ। শুধু চালের সাদা রঙ দেখে না কিনে এর গুণগত মান বিবেচনা করা উচিৎ।

আরও পড়তে পারেনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.