পনিরের বহুবিধ উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম


ক্যালসিয়াম ও প্রোটিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হল পনির, তবে এতে চর্বির পরিমাণ একটু বেশি থাকে। সাধারণ বাঙালীর ঘরে অবশ্য এটিকে সহজে খুঁজে পাওয়া যাবে না তবে এটি আমাদের স্বাস্থ্যের সর্বাঙ্গীন উন্নতি সাধন করে। আজ‌ আমরা পনিরের বহুবিধ উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম সম্পর্কে জানবো।

পনির (চিজ/cheese) কি

এটি একটি দুধ থেকে তৈরি খাদ্য। এটি গরু, মহিষ, ছাগল বা ভেড়ার দুধ থেকে তৈরি করা হয়। দুধে থাকা প্রোটিন এবং চর্বির সমন্বয়ে এটি তৈরি হয়। এটি বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। দেশ ও অঞ্চলভেদে প্রায় কয়েক হাজার প্রকারের পনিরের দেখা পাওয়া যায়। আমাদের দেশে ঢাকাইয়া ও অষ্টগ্রামের পনিরের নামডাক রয়েছে।

বেশিরভাগ পনিরই রান্নার তাপমাত্রায় গলে যায়। মূলত একে দেখতে হলুদ রঙের হয়ে থাকে। যেই পদ্ধতিতে দই প্রস্তুত করা হয় অনেকটা সেই পদ্ধতিতেই একে তৈরি করা হয়। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান আছে।

বিভিন্ন ধরণের পনির

পনির খাওয়ার উপকারিতা

এটি একটি অত্যন্ত উপাদেয় খাদ্য। পনির প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম ও প্রোটিনে সমৃদ্ধ। এতে একইসঙ্গে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, অন্যান্য উপকারি ফ্যাট, ম্যাগনেসিয়াম এবং আরও পুষ্টকর উপাদান থাকে যা নানা দিক থেকে শরীরের গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। চলুন জেনে নেই পনির খাওয়ার উপকারিতা –

ক) হাড় শক্ত করে:

পনিরে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন-ডি এর উপাদান আছে। এইসকল উপাদানের ঘাটতি দেখা দিলে হাড় দুর্বল হতে শুরু করে এমনকি ভেঙ্গেও যেতে পারে। এই কারণেই চিকিৎসকরা প্রতিদিন এক গ্লাস করে দুধ খাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু যারা দুধ খেতে পছন্দ করেন না তারা সহজেই পনির খেতে পারেন। এটি খেলে হাড়ের জরুরী পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি দূর হবে।

খ) ওজন কমাতে সাহায্য করে:

দেহের অতিরিক্ত ওজন কমাতে রোজের ডায়েটে পনিরকে অন্তর্ভুক্ত করে নিন। এতে প্রাকৃতিক ফ্যাট থাকে তা যা ওজন স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে ফলে ভারসাম্য বজায় থাকে। এতে থাকা প্রোটিন বহুক্ষণ পেট ভরে রাখে ফলশ্রুতিতে বারবার খাওয়ার প্রবণতা কমে যায় এবং নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এছাড়াও পনিরে লাইনোলেইক অ্যাসিড নামক উপাদান আছে যা শরীরের অতিরিক্ত মেদ ঝরিয়ে ফেলতে সহায়তা করে।

গ) ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে:

গবেষণা অনুযায়ী প্রতিদিন পরিমিত পরিমাণে পনির গ্রহণ করলে এটি টাইপ-২ ডায়বেটিস হওয়ার ঝুঁকি ৮% কমাতে সাহায্য করে। পনিরে প্রোবাইওটিক উপাদান আছে যা কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে।

ঘ) দাঁতের উপকার করে:

পনিরের ক্যালসিয়াম দাঁতের উন্নতিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও এটির পুষ্টিগুণ দাঁতের রোগজীবাণু ধ্বংস করে। একইসাথে এটি চিবানোর সময় এর কিছু উপাদান মুখেরও উপকার করে।

ঙ) হৃদযন্ত্রের উন্নতি করে:

পনিরের মধ্যে পটাসিয়াম থাকে যা হার্টের কার্যক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এটি একইসাথে রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করে। সুতরাং, দীর্ঘদিন হৃদযন্ত্রকে চাঙ্গা রাখতে নিয়মিত এটি খাওয়া যেতে পারে।

চ) ক্যান্সার প্রতিরোধ করে:

এতে লিনোলিক এসিড এবং স্পিংহো লিপিড নামক উপাদান থাকে যা ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। কিছু গবেষণা অনুযায়ী স্পিংহো লিপিড ও ক্যালসিয়াম কোলন ক্যান্সার প্রতিরোধে সক্ষম। এছাড়াও এটি ব্রেস্ট ক্যান্সারসহ অন্যান্য ক্যান্সারের বিপক্ষেও সমানভাবে কাজ করে। হাওয়ার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথের একটি গবেষণা অনুযায়ী ব্রেস্ট ক্যান্সার প্রতিরোধে ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন ডি সবথেকে বেশি উপকারী।

ছ) পর্যাপ্ত ঘুমে সাহায্য করে:

দুধ দিয়ে তৈরি যেকোনো খাবারই ভালো ঘুম আনতে সহায়তা করে। পনির খেলে মস্তিষ্কের স্নায়ু স্থির হয়। ফলশ্রুতিতে ভালো ঘুম আসে।  তাই সুস্থ মস্তিষ্ক ও সুন্দর ঘুমের জন্য প্রতিদিন এটি খাওয়া যেতে পারে।

জ) রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে:

দেহে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পনিরের সক্ষমতা অবিশ্বাস্য। এতে প্রচুর পরিমাণে স্বাস্থ্য সুরক্ষার উপাদান বিদ্যমান থাকে। বেশকিছু গবেষণার ফলাফল মতে, চিজে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদানসমূহ রয়েছে।

ঝ) মাইগ্রেন সমস্যায়:

এতে ক্যাম্বার্ট নামের উপাদান রয়েছে যা মাইগ্রেনের ব্যথা কমাতেও সাহায্য করে। প্রথমত এটি মস্তিষ্কের বিভিন্ন প্রদাহকে দূর করে। এতে মস্তিষ্কের পেশির ফোলা কমে এবং মাইগ্রেনের ব্যথাও কমে আসে।

ঞ) ত্বকের ও চুলের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে:

ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-বি সমৃদ্ধ খাবার হওয়ায় এটি আমাদের ত্বক ও চুলের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয়। এছাড়াও এতে সেলেনিয়াম নামের উপাদান থাকায় এটি ত্বকের ঔজ্জ্বল্যতা বাড়ায়। একইভাবে এটি খেলে চুলের পুষ্টি বৃদ্ধি পায় এবং এটির প্রাকৃতিক প্রোটিন চুলকে উজ্জ্বল ও সুন্দর করে।

ঢাকাইয়া পনির

স্বাদের দিক থেকে ঢাকাইয়া পনিরের বিকল্প খুঁজে পাওয়া আসলেই সম্ভব নয়। ঢাকার নবাব পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় এটি সর্বপ্রথম শৌখিনদের উঠে আসে। এর এমন নাম আসার পেছনে মূল ঢাকার নবাব পরিবারেরই। তাদের নবাবি রসুইঘর আর দস্তরখানে এর ব্যবহারের ফলেই মানুষের মুখে মুখে এর এমন‌ নাম ছড়িয়ে পড়ে।

নোনতা স্বাদের এই পনিরকে কাটলেই ছোট ছোট অসংখ্য ছিদ্র দেখা যায়। ছোট্ট এক টুকরো হাতে নিয়ে সামান্য চটকে দিলেই এটির দানাদার ভাব বুঝতে পারা যায়। অতিরিক্ত সাদা এবং নরম পনির মানেই কম নোনতা। অন্যদিকে ভঙ্গুর দানাদার আর সামান্য হলুদে ভাব থাকার অর্থ হচ্ছে এই পনিরে লবণের পরিমাণ বেশি হবে। সংস্কৃতির ধারা অব্যাহত রেখে এখনো রোজার মাসে পুরান ঢাকার চকবাজারের পনির সমুচা বিক্রি করা হয়। পুরান ঢাকার রীতি অনুযায়ী বিয়ে বাড়ীতে বরযাত্রী আপ্যায়নে ঢাকাইয়া পনিরের পাতলা স্লাইস অথবা বাকরখানির ওপরে পনিরের কুচি ছিটানো হয়।

অষ্টগ্রামের পনির

অষ্টগ্রামের পনির কিশোরগঞ্জ জেলাকে পুরো বিশ্বের কাছে আলাদা পরিচয়ে উপস্থাপন করছে। কিশোরগঞ্জের একটি ছোট উপজেলার নাম অষ্টগ্রাম। আর সেখানেই তৈরি করা হয় এই জগৎ বিখ্যাত পনির।

দিনদিনই এই পনিরের চাহিদা বেড়েই চলেছে। এই পনিরের ইতিহাস প্রায় ৩০০ বছরেরও বেশি পুরনো। বয়োজ্যেষ্ঠদের মতে, মোঘল শাসনামলে অষ্টগ্রামে থাকতে আসে দত্ত পরিবার এবং তাদের হাত ধরেই নাকি এর প্রচলন। ষাটের দশক থেকেই অষ্টগ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে পনির তৈরি করার রীতি রেওয়াজ রয়েছে। প্রতি ১০ লিটার দুধে মাত্র ১ কৈজি অষ্টগ্রামের পনির প্রস্তুত করা যায়।

গর্ভাবস্থায় পনির

গর্ভাবস্থায় পনির খাওয়ার তেমন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।‌ তবে সাবধানতা অবলম্বনের জন্য ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী এটি খাওয়া প্রয়োজন। এতে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম থাকায় এটি মায়ের পাশাপশি গর্ভে থাকা শিশুরও হাড়ের উন্নতি করে। এছাড়াও বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় গর্ভবতী মায়ের যেসকল পুষ্টির প্রয়োজন হয় তা পূরণ করতে পনিরের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

পনির খাওয়ার নিয়ম

এটি খাওয়ার ধরাবাঁধা কোনো নিয়ম নেয়। যার যেভাবে পছন্দ সে সেভাবে এটিকে গ্রহণ করতে পারে। অনেকে এর সাথে লেবুর রস, ভিনেগার মিশিয়ে খেতে পছন্দ করেন। কেউ কেউ আবার এটির সাথে মসলা মিশিয়ে রান্না করে খেতে পছন্দ করেন। নীচে এটি খাওয়ার কয়েকটি উপায় উল্লেখ করা হলো:

  • ডিম ভাজির সাথে এটিকে যুক্ত করে খাওয়া যেতে পারে। ভাজি করার সময়ই এটি কুচি কুচি করে উপরের দিকে ছড়িয়ে দিন।
  • বেক করা আলুর সাথে এটির ব্যবহার আলুকে আরো সুস্বাদু করে তুলবে।
  • অনেকে আবার সালাদ হিসেবে এটিকে খেয়ে থাকেন।
  • বিভিন্ন ধরনের ফাস্টফুডের সাথে একে ব্যবহার করা হয়।
  • বিভিন্ন ধরনের স্যুপের মধ্যেও এটি যোগ করে খাওয়া যেতে পারে।
  • পনিরের ছোট ছোট চিপস বানিয়েও একে খাওয়া যায়। অস্বাস্থ্যকর চিপস খাওয়ার থেকে ভালো এটির চিপস বানিয়ে খাওয়া যায়।
  • বিভিন্ন‌ প্রকার ফ্রাই বা ভাজির ভেতর একে রেখে রান্না করা যায়।

আরও জানতে চাইঃ

ক) পনির কিভাবে তৈরি হয়?

পনির একটি অত্যন্ত সুস্বাদু খাবার। প্রথমে দুধ কেটে ছানা তৈরি করা হয়, পরবর্তীতে সেই ছানা থেকেই এটি প্রস্তুত করা হয়। দুধের প্রোটিন কেসিন জমাট বাঁধার ফলে চিজ তৈরি হয়। নীচে এটি বানানোর ঘরোয়া পদ্ধতি সম্পর্কে জানানো হলো:

  • সর্বপ্রথম দুধকে ভালোভাবে ফুটিয়ে নিতে হবে।
  • এবার দুধের মধ্যে পরিমাণমতো লেবুর রস বা ভিনেগার মিশিয়ে ভালোভাবে ঢেকে রাখতে হবে।
  • এবার ১০ মিনিট পর ঢাকনা খুললে দেখা যাবে দুধের ছানা ও পানি আলাদা হয়ে গেছে।
  • তারপর পাতলা সুতি কাপড় নিয়ে ছানা ছেঁকে নিতে হবে।
  • ছানা থেকে অতিরিক্ত পানি যখন শুষে নেওয়া হয়ে যাবে তখন ভারী কোন জিনিস দিয়ে চাপা দিয়ে রাখতে হবে।
  • ৪-৫ ঘন্টা পর ছানা ভালোভাবে সেট হয়ে গিয়ে পনির ‌তৈরি হয়ে যাবে।

পরিশেষে

পনির খাওয়ার উপকারিতা সম্পর্কে জানলাম। তবে একে পরিমিত পরিমাণেই গ্রহণ করা উচিৎ। অনেকে তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে ভালো খাবারকে নিজেদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর করে তোলে। পনির আমাদের খাবারে স্বাদের পরিমাণ বাড়িয়ে তোলার সাথে সাথে আমাদের দেহের অনেক উপকার সাধন করে। তবে এর অতিরিক্ত ব্যবহার করা ঠিক হবে না।

তথ্যসূত্র:

আরও পড়তে পারেনঃ

2 Replies to “পনিরের বহুবিধ উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম”

  1. this page has given many information about cheese. Thanks a lot for giving us information about this delicious food

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.