নারিকেল তেলের পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা


অতি সাম্প্রতিক সময়ে, নারিকেল তেল বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। চুলের যত্ন থেকে শুরু করে খাবার এমনকি সানস্ক্রিন থেকে ডিওডোরেন্ট বা দুর্গন্ধনাশক পদার্থ পর্যন্ত এই তেলের বিস্তৃত ব্যবহার রয়েছে। এর চমৎকার গন্ধ এবং সহজেই যেকোনো কিছুতে খাপ খাওয়ানোর বৈশিষ্ট্য এটিকে জনপ্রিয় উপাদান করে তুলেছে। কিছু রেসিপিতে, এই তেল অ্যালার্জিযুক্ত ব্যক্তিদের বা যারা উদ্ভিদ ভিত্তিক ডায়েট করেন তাদের ক্ষেত্রে ডায়েটের জন্য একটি দুধের বিকল্প হতে পারে। এই তেলের রয়েছে অনেক রকমের পুষ্টিগুণ। আর এসব পুষ্টিগুণের কারণেই এটি বেশ উপকারী একটি তেল। আজ আমরা এই তেলটির পুষ্টি উপাদান, গুণাবলী ও উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।

নারিকেল তেল হল একটি ভোজ্য তেল যা নারিকেলের ভিতরের ফ্যাকাশে আবরণ বা মাংস দিয়ে তৈরি করা হয়। এটি ঘরোয়া তাপমাত্রায় কঠিন অবস্থায় এবং উত্তপ্ত করলে গলে তরল অবস্থায় পরিণত হয়ে যায়। ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, পলিনেশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ায় এর দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। কারণ, এ সকল দেশে প্রচুর নারিকেল গাছ জন্মায়।

নারিকেল তেল কেন খাবেন?

নারিকেল তেল নারিকেল গাছের নারিকেল থেকে আসে। এই তেলের দুইটি প্রধান প্রকার রয়েছে। এরা হলো: নারিকেলের শুকনো আঁশের তেল এবং ভার্জিন নারিকেল তেল। যদিও এই দুটি তেলেরই ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণ একই রকম। ভার্জিন তেলে ভিটামিন ই এবং বায়োঅ্যাকটিভ যৌগ যেমন: পলিফেনল রয়েছে যা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্যযুক্ত উদ্ভিদের উপাদান। এই পলিফেনল এর মতো পুষ্টির  পরিমাণ এই তেলে বেশি থাকে।

নারিকেল তেলে অনেক পুষ্টি উপাদান রয়েছে যা আপনার স্বাস্থ্য রাখতে সাহায্য করে। এটিতে রয়েছে ফ্যাটি অ্যাসিড যা শরীরের প্রয়োজনীয় বিপাক কাজে সাহায্য করে। পাশাপাশি চুল ও ত্বকের যত্নেও এই তেল বেশ কার্যকর। এছাড়াও এই তেলের রয়েছে আরও নানাবিধ উপকারিতা। আসুন জেনে নিই নারিকেল তেলের উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ সমূহ:

১ টেবিল চামচ নারিকেল তেলে নিম্নলিখিত উপাদানগুলি রয়েছেঃ

  • ক্যালোরি: ১২৫
  • মোট চর্বি: ১৪ গ্রাম
  • স্যাচুরেটেড ফ্যাট: ১২ গ্রাম

এছাড়াও আরও রয়েছেঃ

  • লোরিক এসিড
  • মিরিস্টিক অ্যাসিড
  • পামিটিক এসিড
  • মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাট
  • পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট
  • উদ্ভিজ্জ প্রোটিন
  • মাঝারি চেইন ট্রাইগ্লিসারাইড

নারিকেল তেল এর উপকারিতা

অনেক পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ নারিকেল তেলের উপকারিতার শেষ নেই। নানাবিধ পুষ্টি উপাদান থাকায় এটি অনেক উপকার সাধন করে থাকে। এটি আমাদের দেহের নানাবিধ উপকার করে থাকে। আসুন দেখে নিই কি কি উপকারিতা আমরা এই তেল থেকে পাই:

ওজন কমানো

লোরিক এসিড হলো এক ধরনের স্যাচুরেটেড ফ্যাট যা এই  তেলে পাওয়া যায় এবং প্রকৃতপক্ষে এই তেলে প্রাকৃতিক উৎসের সর্বোচ্চ মাত্রার লরিক এসিড থাকে।  গবেষণায় দেখা গেছে যে, লরিক এসিড লিভারে যায় এবং শরীরে চর্বি হিসাবে সঞ্চিত না হয়ে এটি শরীরের শক্তিতে রূপান্তরিত হয়, যা ওজন কমাতে সাহায্য করতে পারে। অর্থাৎ, এটি দেহের চর্বি কমায়। সরাসরি ওজন না কমালেও চর্বি গলিয়ে দেহের ওজনকে নিয়ন্ত্রণ এটি অনেকটাই কার্যকরী ভূমিকা রাখে।

দেহে শক্তি জোগায়

নারকেল তেলে রয়েছে মাঝারি চেইন ট্রাইগ্লিসারাইড বা এমসিটি যা দেহের শক্তি জোগাতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। এই মাঝারি চেইন ট্রাইগ্লিসারাইডগুলো সরাসরি মানুষের যকৃৎ বা লিভারে যায় এবং কার্বোহাইড্রেটের মতোই দ্রুত দেহের শক্তিতে পরিণত হয়। এই মাঝারি চেইন ট্রাইগ্লিসারাইড বা এমসিটি দীর্ঘদিন ধরে ক্রীড়াবিদদের জন্য পুষ্টির চাহিদা জোগাতে ও শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। অর্থাৎ, বলা যায় এই তেল দেহের শক্তি জোগানোর জন্য অন্যতম একটি উৎস হতে পারে। তাই দেহের শক্তি বাড়াতে এই তেল খাবারে ব্যবহার করতে পারেন।

ক্ষুধা কমায়

যারা ডায়েট করেন তাদের ক্ষেত্রে নারিকেল তেল হতে পারে ভীষণ কার্যকর একটি উপাদান। কারণ, নারিকেল তেলে মাঝারি চেইন ট্রাইগ্লিসারাইড থাকে যা দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা রাখতে সাহায্য করে। এর ফলে সহজে ক্ষুধা লাগে না। এর ফলে বাড়তি খাদ্য গ্রহণের ইচ্ছা হয় না যা ডায়েট করতে সাহায্য করে। পাশাপাশি এই তেলে চর্বির পরিমাণ কম থাকায় তা দেহের ওজনও নিয়ন্ত্রণে রাখে বেশ ভালোভাবেই। তাই আপনার ডায়েট চার্টে চাইলে এই তেল দিয়ে তৈরি খাবার রাখতে পারেন।

জীবাণু প্রতিরোধে

নারিকেল তেলের রয়েছে জীবাণু প্রতিরোধী ক্ষমতা। কারণ এতে থাকা মাঝারি চেইন ট্রাইগ্লিসারাইড বিশেষ করে লোরিক এসিড জীবাণু প্রতিরোধে খুবই কার্যকর একটি উপাদান।

গবেষণায় দেখা গেছে যে, এই লরিক এসিড বিভিন্ন ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করতে সক্ষম এবং এর পাশাপাশি এই এসিড ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বৃদ্ধিকেও বাধা দেয়। এর পাশাপাশি এটি উদ্ভিদের জন্য ক্ষতিকর অণুজীবের বিরুদ্ধেও লড়াই করতে সক্ষম। আর এই সকল ক্ষতিকর জীবাণু ধ্বংস করে এই তেল দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।

ত্বকের যত্নে

খাওয়ার পাশাপাশি অনেকেই ত্বকের যত্নে নারিকেল তেল ব্যবহার করে থাকেন। আর এটি থেকে বেশ ভালো উপকারও মিলে। এই তেল ব্যবহার করে ত্বকের যত্ন করলে শুষ্ক ত্বকের আর্দ্রতা বাড়ে।

এটি ত্বকের কার্যকারিতাও উন্নত করতে পারে পাশাপাশি এটি দেহ থেকে ত্বকের মাধ্যমে অতিরিক্ত পানি বের হয়ে যাওয়াও রোধ করে যা দেহে পানিশূন্যতা হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা দেয় এবং দেহকে সুস্থ রাখে। এছাড়াও এটি সংক্রামক এজেন্ট, ক্ষতিকর রাসায়নিক এবং অ্যালার্জেনের মতো বাহ্যিক ক্ষতিকর কারণ থেকেও ত্বককে রক্ষা করে।

চুলের যত্নে

চুলের যত্নে নারিকেল তেলের ব্যবহার একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি। গবেষণায় দেখা গেছে যে, এই তেল চুলের একদম গভীরে যায় এবং চুলকে মজবুত করে তুলে। তাই চুলে এই তেল দিলে তা চুল ঝরে পড়া রোধ করতে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এই তেল চুলকে পর্যাপ্ত পুষ্টি জোগায় যা চুলকে ভেঙে পড়া এবং ঝরে যাওয়া থেকে আটকায়। তাই চুলের যত্নে নিশ্চিন্তে এই তেল ব্যবহার করতে পারেন।

নারিকেল তেলের ব্যবহার

ক) মেথি ও নারিকেল তেল

নারিকেল তেলের উপকারিতা অনেক বাড়িয়ে দিতে পারে মেথির সাথে এটির ব্যবহার। মেথির সাথে মিশিয়ে এই তেল ব্যবহার করলে এটি চুলের যত্নে বেশ দারুণ কাজ করে। এই তেলের সাথে মেথির গুড়া মিশিয়ে দিলে তা তেলের উপকারিতা বাড়িয়ে দেয়।

তখন এই তেল চুলে ব্যবহার করলে তা চুলের যত্নে বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখে। মেথির সাথে মিশিয়ে এই তেল ব্যবহার করলে তা চুল শক্ত ও মজবুত করে। পাশাপাশি মেথির অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টিফাঙ্গাল উপাদান চুলের জন্য ক্ষতিকর ঈস্ট দমন করে খুশকির হওয়া প্রতিরোধ করে। চুলের খুশকি কমায়। এছাড়াও চুলকে বড় ও মজবুত করতেও এটি সাহায্য করে।

খ) লেবুর রস ও নারিকেল তেল

নারিকেল তেলের সাথে লেবুর রস মিশিয়েও ব্যবহার করা যায়। লেবুর রস ও এই তেল দুটিই ত্বকের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এই দুইটি একসাথে মিশিয়ে ব্যবহার করলে এটি ত্বককে মসৃণ করে৷ ত্বকের কালো দাগ দূর করতেও সাহায্য করে এবং এটি ত্বককে উজ্জ্বল করতেও সাহায্য করি।

পাশাপাশি এটি মুখে ব্যবহার করলে মুখের দাগ দূর হয়। এছাড়াও চোখের নিচের কালো দাগ দূর করতেও এই দুটি একসাথে মিশিয়ে ব্যবহার করতে পারেন। এতে উপকারিতা পাবেন।

গ) অ্যালোভেরা ও নারিকেল তেল

চুলের জন্য অন্যতম উপকারী একটা জিনিস হলো অ্যালোভেরা। অ্যালোভেরাতে ভিটামিন A, B12, C, E এবং ফলিক অ্যাসিড রয়েছে, এগুলো চুলের কোষের বৃদ্ধি বাড়ায় ও চুল পড়া রোধ করে। আর এই অ্যালোভেরার সাথে যদি নারিকেল তেল মিশানো যায় তবে এর পুষ্টি গুণ ও উপকারিতা বেড়ে যায় বহুগুণে। এটি চুলকে মজবুত করে, চুলকে ঘন কালো হতে সাহায্য করে এবং চুল পড়া প্রতিরোধেও বেশ কার্যকরী ভূমিকা রাখে।

ঘ) এক্সট্রা ভার্জিন নারিকেল তেল

অন্য কোনো কিছু না মিশিয়ে নারিকেলের নির্যাস থেকে সরাসরি যে তেল পাওয়া যায় সেটাই মূলত এক্সট্রা ভার্জিন নারিকেল তেল। এটির রয়েছে অসামান্য পুষ্টি গুণ। এই তেল অসাধারণ সব উপকার করে থাকে আমাদের।

এই তেল খেলে ওজন কমে। এটি ডায়েটে সাহায্য করে। পাশাপাশি ক্ষুধামান্দ্য দূর করতেও এই তেল বেশ কার্যকর। এছাড়াও এটি পেটের অতিরিক্ত ক্ষতিকর চর্বি দূর করে। পাশাপাশি এই তেল দেহ থেকে ক্ষতিকর কোলেস্টেরল দূর করে দেহের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করে। সব মিলিয়ে এটি থেকে পাওয়া যায় অসাধারণ ও দারুণ উপকারিতা।

নারিকেল তেলের ক্ষতিকর দিক

নারিকেল তেল অত্যন্ত উপকারী একটি তেল হলেও এটির অতিরিক্ত ব্যবহার ক্ষতির কারণ হতে পারে। এই তেল খেলে তা হার্টকে ভালো রাখে। তবে পরিমাণের চেয়ে বেশি খেলে তা হিতে বিপরীত হতে পারে। অতিরিক্ত পরিমাণে এই তেল খেলে রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। এর ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।৷

কিছু গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে নারকেল তেল ভালো কোলেস্টেরল বাড়াতে পারে এবং খারাপ কোলেস্টেরল কমাতে পারে,তবে অন্যান্য অনেক গবেষণায় দেখা গেছে যে অলিভ অয়েলের মতো অন্যান্য তেলের তুলনায় নারকেল তেল এলডিএল কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ায়, যা “খারাপ” কোলেস্টেরল। উচ্চ মাত্রার এলডিএল কোলেস্টেরল হৃদরোগ বা স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এক টেবিল চামচ নারকেল তেলে প্রায় ১২ গ্রাম স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে, তাই এটি বেশি পরিমাণে গ্রহণ করা হলে স্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। অত্যধিক স্যাচুরেটেড ফ্যাট উচ্চ কোলেস্টেরলের কারণ হতে পারে, যা থেকে হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি সৃষ্টি হয়।

তাই এই তেল খেলেও তা সীমিত পরিমাণে খাওয়া উচিৎ। এটি পরিমিত পরিমাণে গ্রহণ করলে তা বরং হৃদরোগের ঝুঁকি কমাবে এবং রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখবে।

উপসংহার

নারিকেল তেলের বহু স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে। ডায়েটের পাশাপাশি ত্বক ও চুলেও এটি সরাসরি ব্যবহার করা যায়। তবে যেভাবেই ব্যবহার করা হোক না কেন এটি সীমিত ও পরিমিত পরিমাণে ব্যবহার করাই শ্রেয়। প্রয়োজনের অতিরিক্ত এটি খাওয়া ডেকে আনতে পারে বিপদ। তাই এই তেল থেকে উপকার পেতে চাইলে এটি অবশ্যই প্রয়োজনমতো গ্রহণ করা উচিৎ।

আরও পড়তে পারেনঃ

তথ্যসূত্র –

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.