জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সমূহ ও পছন্দসই পদ্ধতি কোনটি


অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান ধারণের সমস্যা রোধ‌ করার পদ্ধতিকে জন্মনিয়ন্ত্রণ বলে। দেশের জনসংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশল হিসেবে সরকার সহজ ও সরল জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সমূহ মানুষের মাঝে উপস্থাপন করে। ধরা যাক,‌ একটি নবদম্পতি তাদের বিয়ের পরের কিছু সময় একা কোনো ধরনের অতিরিক্ত দায়িত্ববোধ ছাড়া উপভোগ করতে চায়। অথবা একটি দম্পতি একজন সন্তান নেওয়ার পর কিছু সময় বিরতি দিতে চান। এমন পরিস্থিতিতে তারা বিভিন্ন জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির সহায়তা নিতে পারেন।

জন্মনিয়ন্ত্রণ কেন প্রয়োজনঃ

এখনো বেশ‌ কয়েকটি জায়গায় জন্মনিয়ন্ত্রণকে ট্যাবু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু এটি সম্পর্কে আরো সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। একজন নারীর জন্য বেশি সন্তান নেওয়া তার স্বাস্থ্যের অত্যধিক ক্ষতি করতে পারে, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে নারীর মৃত্যুও হতে পারে।

এছাড়াও একাধিক সন্তান লালনপালন করা একটি বিশাল দায়বদ্ধতার বিষয়।

অপরপক্ষে যদি বিশালতার দিকে তাকিয়ে দেখা যায়, তবে একটি দেশের জন্য বিপুল জনসংখ্যা বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে, যদি না এই জনসংখ্যাকে সঠিক পদ্ধতিতে কাজে লাগানো যায়। কেননা এতো বিশাল জনসংখ্যাকে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা একটি ছোট দেশের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় সঠিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পরিস্থিতি গড়ে তোলা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে যায়।

জন্মনিয়ন্ত্রণে পছন্দসই পদ্ধতিঃ

ব্যবহার ও প্রকৃতি ভেদে নানা ধরনের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। এই প্রতিটিরই রয়েছে আলাদা আলাদা ব্যবহারবিধি। এদের মধ্যে কনডম, ইনজেকশন ও পিল অন্যতম। নীচে বেশকিছু জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো:-

কনডমঃ

জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য যেসকল পদ্ধতির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়, তাদের মধ্যে কনডম সর্বাধিক ব্যবহৃত পদ্ধতি। এটিকে সবচেয়ে প্রাচীন জন্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যম বলে বিবেচনা করা হয়।

মিশরের রাজা তুতেনখামেনের মমি যে ঘরে সংরক্ষণ করা হয়েছিল সেখান থেকে একটি চামড়ার তৈরি থলি খুঁজে পাওয়া যায় যার সঙ্গে ছিল কোমরে বাঁধার ফিতা। এটাকেই এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত সবচেয়ে প্রাচীন কনডম বলে ধরা হয়। এ থেকে বুঝা যাচ্ছে, প্রাচীন মিশরীয়রাও জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন।

তবে আধুনিক কনডমের ব্যবহার শুরু হয় সেই ১৮০০ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। চার্লস গুডইয়ার ১৮৪৪ সালে তাপপ্রয়োগ করা রাবারে গন্ধক মিশিয়ে তা শক্ত করার পদ্ধতিকে পেটেন্ট করে নেন। তারপর ১৮৫৫ সালের দিকে প্রথম রাবারের কনডম তৈরি করা হয়। এরপর যত সময় অতিবাহিত হয়েছে ততো এটির আধুনিকায়ন করা হয়েছে।

বর্তমান সময়ে পুরুষদের মাঝে এটি সবচেয়ে সহজলভ্য জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি।

খাবার বড়িঃ

অনেক নারী জন্মনিয়ন্ত্রণের কৌশল হিসেবে খাবার বড়িকে বেশি পছন্দ করেন। কেননা এই বড়ির স্বাভাবিক কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে। নির্দিষ্ট কয়েকটি শারীরিক সমস্যা ব্যতিত প্রায় সকলেই এটি গ্রহণ করতে পারে। তবে এটি গ্রহণের আগে একজন প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে ভালো হয়।

এই বড়িগুলোকে অবশ্যই নিয়মমাফিক গ্রহণ করতে হবে। অনিয়মের ফলে শরীরে নানাবিধ সমস্যার উৎপত্তি হতে পারে। একইসঙ্গে এটিকে পাঁচ বছরের বেশি সময় ব্যবহার করা উচিৎ নয় এবং ৩৫ বছরের পূর্বেই এটির ব্যবহার বন্ধ করে দিতে হবে।

এটিকে এতোটাই সময়মতো খেতে হয় যে, বাসার বাইরে থাকলেও যাতে বড়ি সেবনের ক্ষেত্রে কোনো ব্যঘাত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হয়।

ইনজেকশনঃ

খাবার বড়ির মতো এটিও একটি জনপ্রিয় জন্মনিয়ন্ত্রণের উপায়। তবে এটিকে গ্রহণের সময় একজন প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। ইনজেকশনের প্রকারভেদে প্রতিটি ইনজেকশন ৩ থেকে ৫ মাস পরপর গ্রহণ করতে হয়। এর একটি ভালো দিক হলো স্তন্যদানকারী মায়েরাও এই ইনজেকশন ব্যবহার করতে পারে। এটির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও এতো বেশি নয়।

বন্ধ্যাত্বকরণঃ

এটি একটি স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ‌ পদ্ধতি। এই পদ্ধতিটি ব্যবহার করার পর নারী এবং পুরুষ সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। যেহেতু এটি ব্যবহার করার পর আর সন্তান নেওয়া যায় না, তাই এটি ব্যবহার করার পূর্বে ভালোভাবে বুঝেশুনে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

সাময়িক বা জরুরি জন্মনিয়ন্ত্রণঃ

যৌনক্রিয়া করা কালে দুর্ঘটনাবশত সন্তান ধারণের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এরকম সমস্যা হতে বাঁচতে যেই প্রক্রিয়াটি ব্যবহার করা‌ হয় তাকে সাময়িক জন্মনিয়ন্ত্রণ‌ বা জরুরি গর্ভনিরোধন বড়ি বলে। সাধারণ নির্দেশনা অনুযায়ী অনিরাপদ যৌনমিলনের পর ৭২ ঘন্টা বা ৫ দিনের মধ্যে এই বড়ি সেবন করতে হয়। এই বড়ি নারীদেহে ডিম্বানু নিঃসৃত হতে দেরি করায় যার ফলে গর্ভাবস্থা এড়ানো যায়।

কনট্রাসেপটিভ স্পঞ্জঃ

এটি একটি সাময়িক গর্ভনিরোধক। এই স্পঞ্জ দেখতে অনেকটা নরম ফোমের মতো, যা জরায়ুর মুখে স্থাপন‌ করা হয়। তবে কার্যকারিতার সময় অনেক কম হয়ে থাকে।

আইইউডিঃ

এটি নারীদের জন্য একটি দীর্ঘস্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি। এই পদ্ধতিকে “কপার T” ও বলা হয়ে থাকে। এতে T আকৃতির একটি ডিভাইস ডিম্বাশয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়। এতে একটি একটি কপারের তার থাকে যা শুক্রাণুকে শরীরে প্রবেশে বাধা দেয়।

প্রাকৃতিক জন্মনিরোধকঃ

পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না থাকার ফলে প্রাকৃতিক জন্মনিরোধক পদ্ধতিগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করা হলে ভালো উপকার পাওয়া যাবে। এসকল পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হয় কেননা এতে ভুল করার সম্ভাবনা বেশি থাকে। নীচে কয়েকটি প্রাকৃতিক জন্মনিরোধক কৌশল সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো –

শুক্রাণু বাইরে স্ফলন করাঃ

যৌনমিলনের শেষ ধাপে যখন পুরুষ শুক্রাণু স্ফলন করতে যাবে তখন তাকে নারী যৌনাঙ্গের বাইরে তা করতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে পুরুষের বীর্য যেনো নারীর জরায়ুতে প্রবেশ না করতে পারে।

তবে অনেক সময় পুরুষ এই মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না ফলশ্রুতিতে নারী যোনির ভেতরেই বীর্যপাত হয়ে যায়। এসকল কারণে এই পদ্ধতি ব্যবহারের সময় সতর্ক থাকতে হয়।

নারীদের মাসিকের সময় পদ্ধতিঃ

সাধারণত মাসিক শুরুর পূর্বের ৯ দিন এবং মাসিক শেষ হওয়ার পরবর্তী ৪ দিন নিরাপদ মিলন সময় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এসময় যৌনমিলনের ফলে গর্ভধারণের সম্ভাবনা কম থাকে।

প্রাকৃতিক জন্মনিয়ন্ত্রণে সমস্যাঃ

কোনো প্রকার অপারেশন বা মেডিসিন গ্রহণ করতে হয় না বিধায় প্রাকৃতিক জন্মনিয়ন্ত্রণে অনেকে আগ্রহী হয়ে থাকেন।‌ তবে এর কিছু অসুবিধাও বিদ্যমান রয়েছে। যেমন:-

  • সফলতার হার অত্যন্ত কম।
  • যেহেতু বিজ্ঞানভিত্তিক কোনো পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো হয় নি, তাই এটির স্বপক্ষে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান প্রদান করা সম্ভব নয়।
  • স্বামী-স্ত্রী একসাথে কাজ না করলে এই পদ্ধতি ব্যর্থ হবে।
  • যৌনমিলনের ফলে হয় এমন রোগ প্রতিরোধ করতে এটি সক্ষম নয়।
  • এই পদ্ধতি অনুসরণ করা প্রতি ৪ জন‌ নারীর মধ্যে ১ জন নারীকে গর্ভধারণ করতে দেখা গেছে, তাই বলা যায় এর সফলতার হার ৭৫ ভাগ।

জন্মনিয়ন্ত্রণে পুরুষের অনীহাঃ

আমাদের সমাজে এখনো একটি ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত রয়েছে যে জন্মনিয়ন্ত্রণ করার সবটুকু দায়ভার একজন নারীর উপর বর্তায়। পুরুষরা এখনো ভাবেন একজন নারী যেহেতু সন্তান জন্ম দিবেন তাই জন্মনিয়ন্ত্রণের সকল দায়িত্ব তাকেই বহন করতে হবে। তবে এটি পুরোপুরি একটি ভুল ধারণা।

একজন সন্তান জন্মদানে একজন মার পাশাপাশি একজন বাবারও সমান দায়িত্ব থাকে। তাকে জন্মদান থেকে শুরু করে লালনপালন পর্যন্ত সবকিছুতেই স্বামী স্ত্রীর সমান অংশগ্রহণ থাকে। তবে জন্মনিয়ন্ত্রণে পুরুষের দায়দায়িত্ব কেনো থাকবে না।

অনেক পুরুষ মনে করেন জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করলে তারা দূর্বল হয়ে পড়বেন বা তাদের মধ্যে অন্যান্য রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাবে। কিন্তু নারীদের তুলনায় পুরুষদের জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করা অনেকটাই সহজসাধ্য।

জন্মনিয়ন্ত্রণে স্বামী স্ত্রীর ভূমিকাঃ

একজন নারী যে জন্মনিয়ন্ত্রণ কৌশলই ব্যবহার করুক না কেনো তার যৎসামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রয়া থাকাটাই স্বাভাবিক।‌ তাই এইসকল পদ্ধতি ব্যবহার করার ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী বা পরিবার পরিকল্পনা সহায়কের পরামর্শ নিতে হবে।

অপরপক্ষে পুরুষদের জন্য এই পার্শ্বপ্রতিক্রয়ার পরিমাণ শূন্যের কাছাকাছি। সাময়িক পদ্ধতি হিসেবে যদি একজন পুরুষ কন্ডমের ব্যবহারও করে তবেও ভালো‌ ফলাফল‌‌ পাওয়ার আশা রাখা যায়। তাই স্বামী স্ত্রী উভয়ের অংশগ্রহণে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বাছাই করা উচিৎ।

পরিশেষে –

জন্মনিয়ন্ত্রণের কোন পদ্ধতিটি আপনার জন্য বেশি উপযোগী হবে তা আপনাকেই খুঁজে বের করতে হবে। একজনের জন্য যেটি ভালোভাবে কাজ করেছে তা আপনার জন্য কাজ নাও করতে পারে।

সময় নিয়ে ভেবে দেখুন আপনি কি সঠিক পদ্ধতিটি ব্যবহার করছেন কিনা। সর্বোপরি একজন চিকিৎসক, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী বা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের সহায়তা নিতে পারেন। এতেই আপনার,‌ আপনার পরিবারের ও দেশের মঙ্গল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.