ঘি একটি দুগ্ধ জাতীয় খাবার। দুধ থেকে এটি প্রস্তুত করা হয়। অনেকে এটিকে চর্বি জাতীয় খাবার বলে এড়িয়ে চলেন। কিন্তু এরও কিন্তু রয়েছে অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতা। এটি যেমন ভিটামিন যুক্ত, তেমনি এতে আরও অন্যান্য পুষ্টি উপাদানও রয়েছে। দারুণ এক উপকারী এই খাবারটির উপকারিতা অপকারিতা ও ব্যবহার সম্পর্কে আমরা আজ জানবো।
ঘি (ghee) আসলে কি?
ঘি (ghee) আসলে সম্পৃক্ত চর্বি, ইংরেজিতে যা ক্ল্যারিফায়েড বাটার (Clarified Butter) নামে পরিচিত। এর প্রায় পুরোটাই চর্বি। প্রায় ৯৯ দশমিক ৯ শতাংশই হলো চর্বি। বাকি ০.১ শতাংশ হল জলীয় দ্রবণ যা চর্বিতে দ্রবণীয়। সম্পৃক্ত চর্বি হওয়ায় এটি বাইরের সাধারণ তাপমাত্রাতেই সংরক্ষণ করা যায়।
ঘি এর উপকারিতা
একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর খাবার ঘি। এতে রয়েছে বিভিন্ন ভিটামিন ও নানা পুষ্টি উপাদান৷ মূলত শীতকালেই এটি খাওয়া ভালো। তবে গরম কালেও এটি খাওয়া যায়। এটি আমাদের দেহের নানাবিধ উপকার করে থাকে। আসুন জেনে নিই ঘি এর উপকারিতা গুলো।
ওজন বাড়াতে সাহায্য করে
ঘি একটি চর্বি যুক্ত খাবার হওয়ায় যারা ওজন বাড়াতে চান তারা এটি খেতে পারেন। এটি ওজন বাড়াতে সাহায্য করবে।
ক্ষতিকর কোলেস্টেরল কমায়
এটি একটি কোলেস্টেরল যুক্ত খাবার। তাই অনেকে মনে করেন এটি দেহে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বাড়িয়ে দিবে। কিন্তু আসলে তা নয়। এটি দেহের ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমিয়ে দেয় এবং উপকারী কোলেস্টেরল বাড়ায়।
ক্ষত সারাতে
এতে রয়েছে কনজুগেটেড লিনোলেক এসিড দেহের বিভিন্ন ক্ষত সারাতে সাহায্য করে। এজন্যই গর্ভবতী মায়েদের অপারেশনের পর এটি খাওয়ানো হয়।
হজমশক্তি বাড়ায় ও কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যায়
ঘিয়ে থাকা মিডিয়াম চেন ফ্যাটি এসিড দেহে এনার্জি বা শক্তি জোগায়। পাশাপাশি এতে থাকা বাইটারিক এসিড হজম শক্তি বাড়াতেও সাহায্য করে। এছাড়াও এটি কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দূর করতেও সাহায্য করে।
ওজন কমায়
এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। এই অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এছাড়াও এতে থাকা ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড আমাদের ক্ষুধা কমাতেও সাহায্য। আর ক্ষুধা কম লাগা দেহের ওজন কমাতেও কার্যকর। কারণ, ক্ষুধা না লাগলে খেতে ইচ্ছা হয় না। আর বাড়তি খাবার না খাওয়ার ফলে ওজনও কমে।
পজিটিভিটি বাড়ায়
প্রাচীনকাল থেকেই এটিকে একটি পজিটিভ ফুড বা খাবার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি খেলে মানুষের মধ্যে পজিটিভিটি বাড়ে। পাশাপাশি এটি মনোযোগ বাড়াতেও সাহায্য করে। পাশাপাশি এর দারুণ সুগন্ধ রাগ কমাতে কার্যকর। কারও যদি প্রচন্ড রাগ উঠে তাহলে তার নাকের সামনে ঘি ধরে দেখুন। এর দারুণ গন্ধে নিমেষেই রাগ কমে যাবে।
ত্বকের ঔজ্জ্বল্যতা বাড়ায় ও প্রদাহ কমায়
ঔজ্জ্বল্যতা বাড়াতে এটি খুবই উপকারী একটি খাদ্য। ত্বকের সোরিয়াসিস কমাতে এটি সাহায্য করে। পাশাপাশি এটি ত্বকের বিভিন্ন প্রদাহ থেকে সুরক্ষা দেয়। এর অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেন্টরি উপাদান ত্বককে মসৃণ ও কোমল করে। এছাড়াও চোখের দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে এটি।
ত্বকের যত্নে ব্যবহার করতে পারেন । রাতে শোয়ার আগে মুখে ঘি মেখে কিছুক্ষণ রেখে দিন। এরপর ধুয়ে ফেলুন। এতে ত্বক কোমল ও উজ্জ্বল হয়। পাশাপাশি ত্বক সুন্দর হয়।
ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে
ক্যান্সার প্রতিরোধে ঘি একটি কার্যকর উপাদান। এতে রয়েছ অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট যা শরীরে থাকা ক্ষতিকর রেডিক্যালদের ক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়। ফলে কোষের বিন্যাস হয়ে ক্যান্সারের কোষ বা সেল সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। এর ফলে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে।
দুধের বিকল্প হিসেবে
দুধ কিংবা দুধ জাতীয় খাবারে যাদের পেটের সমস্যা হয় তারা চাইলে ঘি খেতে পারেন। এর ফলে আপনি দুধের পুষ্টি পাবেন, আবার পেটও ঠিক থাকবে। এছাড়াও অন্য দুধ জাতীয় খাবার বা দুধের মতো এটিতে এলার্জি জাতীয় সমস্যা নেই।
এছাড়াও ঘিয়ে থাকা মিডিয়াম চেন ফ্যাটি এসিড ও ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড খুবই স্বাস্থ্যকর ও উপকারী চর্বি। এ সকল চর্বি দেহের প্রদাহ জনিত সমস্যা কমায় এবং হজম শক্তি বাড়ায় এবং কোষের স্বাভাবিক কাজে সহায়তা করে।
হৃদরোগ ও ডায়াবেটিস প্রতিরোধে
এই খাবারে রয়েছে লিনলয়েক এসিড, যা ক্যান্সার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি রোগের বিরুদ্ধে সাহায্য করে। এছাড়াও মানসিক অবসাদ দূর করতেও সাহায্য করে ঘি। মানসিক অবসাদজনিত মাথা ব্যথা হলে, এ থেকে মুক্তি পেতে এটি খেতে পারেন। এতে মাথা ব্যথা কমবে।
উল্লেখ্য, অনেকে রান্নায় ঘি ব্যবহার করেন। ঘি এর স্ফুটনাংক অনেক বেশি হওয়ায় রান্নায় এটি ব্যবহার করলেও এর পুষ্টি গুণ নষ্ট হয় না। তাই এটি রান্নায় ব্যবহার করেও খেতে পারেন। এতে উপকার পাবেন। অপরদিকে এই খাবারের আরেকটি গুণ হল এটি নষ্ট হয় না। শত বছর পরেও আপনি এই খাবার সংরক্ষণ করে খেতে পারবেন।
ঘি এর ব্যবহার
ঘি খেতে পারেন বা ব্যবহার করতে পারেন নানা ভাবে। এটি যেমন রান্নায় ব্যবহার করতে পারেন, তেমনি রূপচর্চায়ও ব্যবহার করতে পারেন। রান্নায় তেলের পরিবর্তে এটি ব্যবহার করতে পারেন। এটি যেমন খাবারের স্বাদ বাড়াবে, তেমনি এর থেকে পুষ্টি ও উপকারও পাবেন।
রান্নার পাশাপাশি রূপচর্চায় এটি ব্যবহার করতে পারেন। ত্বকে সরাসরি এটি ব্যবহার করতে পারেন। এতে ত্বক কোমল ও মসৃণ হয়। এছাড়াও কোষ্ঠকাঠিন্য বা বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায়ও এটি খেতে পারেন। রান্না ছাড়াও বিভিন্ন সিদ্ধ বা ভর্তায় কিংবা গরম ভাতের সাথেও এটি খেতে পারেন।
গাওয়া ঘি এর উপকারিতা
গাওয়া ঘি হল মূলত গরুর খাঁটি দুধ থেকে সরাসরি যে ঘি উৎপাদিত হয় তা। এক কথায় খাঁটি ঘিকেই গাওয়া ঘি বলা হয়। এই ঘি এর রয়েছে দারুণ সব উপকারিতা। এই ঘি থেকে যে সকল উপকারিতা আমরা পেতে পারি তা হল:-
- অ্যান্টি অক্সিডেন্ট যুক্ত হওয়ায় দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
- চোখের দৃষ্টি শক্তি বাড়ায়। পাশাপাশি গ্লুকোমা রোগীদের উপকার করে।
- শরীরের সন্ধি বা জোড়া গুলো ঠিক রাখতে সাহায্য করে।
- মস্তিষ্কের ধার বাড়ায় ও মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
- ত্বককে আর্দ্র রাখে ও শুষ্কতা দূর করে।
- দেহের বিভিন্ন ক্ষত সারাতে গাওয়া ঘি বেশ উপকারী।
ঘি এর অপকারিতা
ঘি এর উপকারিতা অনেক। দেহের নানাবিধ উপকার করা এই খাবার কি তাহলে খেতেই থাকবো? এর উত্তর হল না। সব খাবারের মতো এটিও অতিরিক্ত খেলে দেহের উপকারের বদলে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। তাই এটি খাওয়া উচিৎ পর্যাপ্ত পরিমাণে। পর্যাপ্ত পরিমাণে না খেয়ে অতিরিক্ত খেলে যা যা ক্ষতি বা অপকার হতে পারে:-
- অতিরিক্ত ঘি খেলে দেহে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায়। ফলে হার্ট অ্যাটাক বা হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
- এটি অতিরিক্ত খেলে দেহে চর্বির পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে৷ ফলে দেহের ওজন বেড়ে যায় এবং নানা রোগ দেখা দেয়।
- অতিরিক্ত খেলে হজমে সমস্যা হতে পারে। বদ হজমও হতে পারে। ফলে পেট খারাপের মতো নানা সমস্যা দেখা দেয়।
- এছাড়াও গ্যাস্ট্রিকের সমস্যাও হতে পারে। পাশাপাশি পেট ফাঁপা ও পেট ফুলেও যেতে পারে।
- এছাড়াও উচ্চ রক্তচাপের রোগীরা এটি খেলে সমস্যায় পড়তে পারেন। কারণ এটি একটি চর্বি যুক্ত খাবার। তাই যাদের উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের মতো সমস্যা আছে তারা এটি না খাওয়াই ভালো।
- এছাড়াও যাদের হাড়ের সমস্যা আছে তারা এটি বেশি খাওয়া উচিৎ নয়। এতে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
উপসংহার
ঘি নিয়ে আমাদের মধ্যে বিভিন্ন রকম ধারণা আছে। কারও মতে এটি উপকারী আবার কেউ মনে করেন এটি খাওয়া উচিৎ নয়। আসলে এর উপকারিতা ও অপকারিতা উভয়ই রয়েছে। তবে অপকারিতার চেয়ে উপকারিতাই বেশি। তবে এর থেকে উপকারিতা পেতে হলে অবশ্যই পরিমিত পরিমাণে খেতে হবে৷ দেহের উপকারের জন্য প্রতিদিন এক চামচ ঘি খেতে পারেন। এতে দেহ নানা উপকার পাবে।
তবে কোনো মতেই খুব বেশি খাওয়া যাবে না। আবার যাদের শরীরে এমন সব সমস্যা আছে যেগুলো এই খাবারে বাড়তে পারে, তারা লোভ সংবরণ করে এটি এড়িয়ে চলা ভালো। উপকারী খাদ্য থেকে বেশি উপকার পেতে গিয়ে প্রয়োজনের বেশি খেয়ে ক্ষতি হওয়ার চেয়ে পরিমিত পরিমাণে খাওয়াই শ্রেয়।
তথ্যসূত্রঃ
- https://www.webmd.com/diet/ghee-good-for-you#1
- https://www.healthline.com/nutrition/ghee
- https://www.food.ndtv.com/food-drinks/9-benefits-of-ghee-you-may-not-have-known-1876610
- https://www.nutritiouslife.com/eat-empowered/clarified-butter-healthy/
Excellent
ধন্যবাদ
হার্টের রিং বসানো রোগীর জন্য দৈনন্দিন কতটুকু পরিমানে ঘি খাওয়া দরকার।