গ্যাস্ট্রিক বা গ্যাস নিয়ে শারীরিক সমস্যা, বদহজম হলো বেশ সাধারণ ও অতি পরিচিত একটি শারীরিক সমস্যা, প্রায় প্রত্যেকেই তাদের জীবনের কোনও না কোনও সময়ে গ্যাস্ট্রিকের অস্বস্তি অনুভব করে থাকেন। এই সমস্যাগুলি হালকা থেকে গুরুতর হতে পারে এবং বিভিন্ন কারণে হতে পারে। খাদ্যাভ্যাস ও শরীরে বয়ে চলা এই সমস্যা নানা কারণে হতে পারে-
গ্যাস্ট্রিক সমস্যার কারণ
গ্যাস্ট্রিক সমস্যার সবচেয়ে সাধারণ কারণগুলি জীবনধারা এবং খাদ্যাভ্যাসের সাথে সম্পর্কিত। এর মধ্যে রয়েছে:
মশলাদার বা চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়াঃ
মসলা, চর্বি জাতীয় খাবার পেটের আস্তরণে জ্বালাতন করতে পারে এবং অ্যাসিড রিফ্লাক্সের কারণ হতে পারে, যা বুকজ্বালা এবং অন্যান্য গ্যাস্ট্রিক উপসর্গের অন্যতম কারণ।
খুব দ্রুত খাওয়াঃ
দ্রুত খাবার খাওয়ার ফলে কম চিবানো খাবার হজমে সমস্যা তৈরী করে পাশাপাশি তাড়াহুড়ো করে খাবার গ্রহণে বাতাস গিলে ফেলার সম্ভাবনা তৈরি হয়, যার ফলে ফোলাভাব এবং গ্যাস হতে পারে।
কার্বনেটেড পানীয় পানঃ
কার্বনেটেড পানীয়, যেমন সোডা, কোমল পানীয় গ্রহণে গ্যাসের জন্ম দেয়, কোমল পানীয় গ্রহণে সাময়িক তৃপ্তি প্রদান করলেও এতে থাকা চিনি ও নানা ধরনের উপাদানে দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক সমস্যার জন্য দায়ী।
মানসিক চাপঃ
স্ট্রেস বা মানসিক চাপ পেটের আলসার, ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম (আইবিএস) এবং অ্যাসিড রিফ্লাক্স সহ বিভিন্ন গ্যাস্ট্রিক সমস্যা ত্বরান্বিত করতে কাজ করে।
ধূমপানঃ
ধূমপান নিম্ন খাদ্যনালীর স্ফিঙ্কটারকে দুর্বল করে দিতে পারে, যা অ্যাসিড রিফ্লাক্স এবং অন্যান্য গ্যাস্ট্রিক সমস্যার কারণ হতে পারে।
স্বাস্থ্যবিধি না মেনে কীটনাশক দিয়ে উৎপাদিত খাদ্য গ্রহণঃ
বর্তমান সময়ে প্রকৃতিক উপায়ে সম্পূর্ণ কৃত্রিম, রাসায়নিক উপাদান ছাড়া উৎপন্ন খাদ্য, শাকসবজি পাওয়া প্রায় অসম্ভব তবু নিজে উৎপাদন করে বা অর্গানিক খাদ্য বিক্রেতা থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে গ্রহণ গ্যাস্ট্রিক সমস্যায় নিয়ামক হিসবে কাজ করতে পারে। স্বাস্থ্যবিধি না মেনে কীটনাশক দিয়ে উৎপাদিত খাদ্য গ্রহণ গ্যাস্ট্রিক সমস্যার অন্যতম কারণ।
গ্যাস্ট্রিক সমস্যার লক্ষণ
গ্যাস্ট্রিক সমস্যার লক্ষণগুলি অন্তর্নিহিত কারণের উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে। সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে:
ফোলা ফোলা ভাব, গ্যাস, বমি বমি ভাব, বমি, ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, পেটে ব্যথা, এসিড রিফ্লাক্স, অম্বল, পাকস্থলীর ঘা, বুক ও পিঠের ব্যাথা অনুভূত হওয়া।
গ্যাস্ট্রিক সমস্যা সমাধানে ঘরোয়া উপায়
সৌভাগ্যবশত, গ্যাস্ট্রিক সমস্যার জন্য বেশ কিছু ঘরোয়া প্রতিকার রয়েছে যা বাড়িতে নিজেই চেষ্টা করা যায়। কার্যকরি কিছু উপায় ও উপাদান:
- আদাঃ আদা একটি প্রাকৃতিক অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি যা পেটকে প্রশমিত করতে এবং প্রদাহ কমাতে সাহায্য করতে পারে। বিভিন্ন উপায়ে আদা খেতে পারেন, যেমন আদা চা পান করা, আদা মিছরি খাওয়া, খাবারে আদা যোগ করা এমন কি আলাদা করে এককভাবেই আদা বেশ উপকারী।
- পেপারমিন্টঃ পেপারমিন্টের অ্যান্টিস্পাসমোডিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা পাচনতন্ত্রের পেশীগুলিকে শিথিল করতে সাহায্য করতে পারে, যা গ্যাস্ট্রিকের অস্বস্তি দূর করতে পারে।বিভিন্ন উপায়ে পেপারমিন্ট সেবন করতে পারেন, যেমন পেপারমিন্ট চা পান করা, পেপারমিন্ট সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা বা খাবারে পেপারমিন্ট তেল যোগ করা।
- ক্যামোমাইলঃ আমাদের দেশে ক্যামোমাইল একটি অপরিচিত ও অপ্রচলিত হারবাল উদ্ভিদ হলেও এর প্রদাহ-বিরোধী এবং অ্যান্টিস্পাসমোডিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা পেটকে প্রশমিত করতে এবং প্রদাহ কমাতে সাহায্য করতে পারে। বিভিন্ন উপায়ে ক্যামোমাইল সেবন করা যায়, ক্যামোমাইল চা, শুকিয়ে গুঁড়া করে পানির সাথে, ক্যামোমাইলের তেল ত্বক সহ প্রদাহ নিরামক হিসেবে কার্যকরী তাছাড়া ক্যামোমাইলের পরিপূরক গ্রহণ করা বা খাবারে ক্যামোমাইল যোগ করেও গ্রহণ করা যেতে পারে।
- আপেল সাইডার ভিনেগারঃ আপেল সাইডার ভিনেগারে ক্ষারীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা পেটে পিএইচ স্তরের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করতে পারে, গ্যাস্ট্রিকের অস্বস্তি কমাতে পারে। অনেক উপায়েই আপেল সিডার ভিনেগার সেবন করা যায়, যেমন পানি দিয়ে পান করা, খাবারে যোগ করা বা আপেল সিডার ভিনেগার সম্পূরক গ্রহণ করা।
- মৌরিঃ মৌরিতে অ্যান্টিস্পাসমোডিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা পাচনতন্ত্রের পেশীগুলিকে শিথিল করতে সাহায্য করে গ্যাস্ট্রিকের অস্বস্তি দূর করতে পারে। বিভিন্ন উপায়ে মৌরি খাওয়া যায়, যেমন মৌরি চা পান করা, মৌরির বীজ চিবানো বা খাবারে মসলা হিসেবেও মৌরি যোগ করে ভিন্ন স্বাদ তৈরী করা যায়।
- অ্যালোভেরাঃ অ্যালোভেরার অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা পেটের প্রদাহ কমাতে এবং গ্যাস্ট্রিকের অস্বস্তি কমাতে সাহায্য করতে পারে। অনেক উপায়েই অ্যালোভেরা সেবন করতে পারেন, যেমন অ্যালোভেরার রস পান করা, অ্যালোভেরার পরিপূরক গ্রহণ করা বা খাবারে অ্যালোভেরা যোগ করা।
- প্রোবায়োটিকঃ প্রোবায়োটিক উপকারী ব্যাকটেরিয়া যা অন্ত্রে ভাল ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করতে পারে, যা হজমের উন্নতি করতে পারে এবং গ্যাস্ট্রিক সমস্যাগুলি দূর করতে পারে। প্রোবায়োটিক কোথায় পাবেন? প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের খাবারে প্রোবায়োটিকের উপস্থিতি রয়েছে, যেমন প্রোবায়োটিক পরিপূরক গ্রহণ করা, দই, পনির, কিমচি এবং স্যাক্রাউটের মতো গাঁজানো খাবারে প্রোবায়োটিক এর উপস্থিতি পাওয়া যায়।
- লিকোরিস রুটঃ লিকোরিস রুটে অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি এবং অ্যান্টি-আলসার বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা পেটকে প্রশমিত করতে এবং গ্যাস্ট্রিকের অস্বস্তি দূর করতে সাহায্য করতে পারে। অনেক উপায়ে লিকোরিস রুট পাওয়া যায়, যেমন লিকোরিস চা পান করা, লিকোরিস সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা খাবারে লিকোরিস যোগ করা।
- বেকিং সোডাঃ বেকিং সোডা পাকস্থলীর অ্যাসিড নিরপেক্ষ করতে এবং অম্বল এবং অ্যাসিড রিফ্লাক্স কমাতে সাহায্য করতে পারে। এক গ্লাস পানিতে এক চা চামচ বেকিং সোডা মিশিয়ে পান করতে পারেন।
- হাইড্রেটেড থাকুনঃ পর্যাপ্ত পানি পান করা শরীর থেকে টক্সিন বের করে দিতে এবং হজমের স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে সাহায্য করে। দিনে অন্তত ৮ গ্লাস পানি পান করার লক্ষ্য রাখুন।
এই ঘরোয়া প্রতিকারগুলি ছাড়াও, গ্যাস্ট্রিক সমস্যাগুলি উপশম করতে জীবনধারায় বেশ কিছু পরিবর্তন করতে পারেন। এর মধ্যে রয়েছে –
- সুষম খাদ্য খাওয়াঃ ফাইবার সমৃদ্ধ খাদ্য, গোটা শস্য, ফলমূল এবং শাকসবজি এবং কম চর্বিযুক্ত ও মশলাদার খাবার খান।
- মসলা, চর্বি ও তৈলজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলুনঃ যেসব খাবার গ্যাস্ট্রিকের উপসর্গ সৃষ্টি করে, যেমন মশলাদার খাবার, চর্বিযুক্ত খাবার, কার্বনেটেড পানীয় এবং ক্যাফেইন এড়িয়ে চলুন।
- পরিমানে কম ও নিয়ম মাফিক খাবার খাওয়াঃ একবারে বেশি পরিমানে খাবার গ্রহণ মোটেও স্বাস্থ্যকর না বরং নিয়ম মাফিক খাবার খাওয়ার অভ্যাস গ্যাস্ট্রিকের অস্বস্তি কমাতে এবং হজমের উন্নতি করতে সাহায্য করতে পারে।
- সঠিক খাবার যথাযথভাবে চিবিয়ে গ্রহণঃ খাবার সঠিকভাবে চিবানো নিশ্চিত করা কেননা খাবার ছোট ছোট টুকরোতে ভেঙ্গে গ্রহণ সহজে হজম হতে কার্যকরী।
- মানসিক স্বাস্থ্যের নিয়ন্ত্রণঃ ধ্যান, যোগব্যায়াম বা গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে দৈনন্দিন চাপ নিয়ন্ত্রণ করে মানসিক স্বাস্থ্যের খেয়াল নিতে হবে। নিজেকে সময় দিতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থার উপরে গ্যাস্ট্রিক সমস্যা বিশেষভাবে সম্পর্কিত, মানসিক স্বাস্থ্যের সুস্থ্যতা গ্যাস্ট্রিক ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে।
- ধূমপান ত্যাগ করাঃ ধূমপান খাবারে অরুচি, প্রদাহ তৈরীতে কাজ করে, ধূমপান ত্যাগ করা গ্যাস্ট্রিক সমস্যার ঝুঁকি কমাতে এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে সাহায্য করতে পারে।
পরিশেষে –
গ্যাস্ট্রিক সমস্যা বেশ অস্বস্তিকর, তবে ঘরোয়া চিকিৎসা এবং জীবনধারা পরিবর্তনের সাহায্যে এ সমস্যার কার্যকর পরিতত্রাণ পাওয়া যায়। গুরুতর বা ক্রমাগত গ্যাস্ট্রিক উপসর্গ বৃদ্ধি হচ্ছে অনুভূত হলে, অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণকরা গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্যকর অভ্যাস অবলম্বন করে এবং রুটিনে প্রাকৃতিক নানা বিধ উপাদান গ্রহণ করে গ্যাস্ট্রিক প্রতিকার ও হজম – স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে পারেন এবং গ্যাস্ট্রিক সমস্যার ঝুঁকি কমাতে পারেন।
আরও পড়তে পারেন –