গলা ব্যথার কারণ ও ব্যথা কমানোর ঘরোয়া চিকিৎসা


গলা ব্যথা একটি সাধারণ সমস্যা যা আমাদের অনেকেরই জীবনের কোনো না কোনো সময়ে হয়েছে। এটি যখন হয় তখন গলায় প্রচন্ড রকমের অস্বস্তির সৃষ্টি হয়। গলায় হালকা থেকে মাঝারি ব্যথা, কথা বলা কঠিন করে তোলা, খাবার গিলতে সমস্যা হওয়া গলা ব্যথার সবচেয়ে খারাপ দিক।

যদিও এটি একটি সাধারণ ব্যাধি তবে এটি বিরক্তিকর হয়ে উঠতে পারে এবং আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্মকে প্রভাবিত করতে পারে। 

এটি ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া উভয়ের সংক্রমণের কারণে হতে পারে। সাধারণ ক্ষেত্রে এটি ছোঁয়াচে বা সংক্রামক ব্যাধি নয় তবে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।

গলা ব্যথার লক্ষণসমূহঃ

  • ঢোক গিলতে সমস্যা হওয়া
  • গলায় খুশখুশ করা
  • গলায় জ্বালাপোড়া ভাব
  • গলায় শুষ্ক ভাব
  • কথা বলার সময় গলায় ব্যথা অনুভূত হওয়া
  • গলা ফোলাভাব, লালচে ভাব দেখা দেওয়া
  • গলায় কফ জমা

গলা ব্যথার পরিচিত কারণসমূহঃ

চিকিৎসকদের ভাষ্যমতে, গলা ব্যথার কারণগুলোর মধ্যে সর্দি, জ্বর বা ফ্লু অন্যতম। তবে এলার্জি, ভাইরাল ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের কারণেও গলা ব্যথা হতে পারে। নীচে গলা ব্যাথার কিছু কারণ তুলে ধরা হলোঃ

(ক) ভাইরাল সংক্রমণ:

কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভাইরাল সংক্রমণ যেমন সাধারণ সর্দি-কাশি, ইনফ্লুয়েঞ্জাকে গলা ব্যথার প্রাথমিক কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই ভাইরাল সংক্রমণসমূহ গলার শ্লেষ্মা ঝিল্লির প্রদাহ ও জ্বালার সৃষ্টি করে।‌ ফলশ্রুতিতে গলায় অস্বস্তি ও ব্যথা হয়।

(খ) ব্যাকটেরিয়া সংক্রান্ত:

ব্যাকটেরিয়ার কারণে যে গলা ব্যথা তাকে সাধারণত স্ট্রেপ থ্রোট বলে ডাকা হয়। শুধুমাত্র গলা ব্যথা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের একমাত্র লক্ষণ। সাধারণ সর্দিকাশির কোনো লক্ষণ এই গলা ব্যথায় প্রকাশ পাবে না। ক্ষেত্রবিশেষে গলায় লালচে দাগসহ ফোলাভাব লক্ষ্য করা যেতে পারে।

(গ) এলার্জি:

অনেকের কিছু খাবার কোনো দ্রব্য থেকে এলার্জি থাকতে পারে। যেহেতু মানুষের গলা একটি সংবেদনশীল জায়গা তাই এসবের সংস্পর্শে আসলে সবার প্রথমে গলাতেই তার প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। এমন‌ পরিস্থিতিতে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

(ঘ) শুষ্ক বাতাস:

বিশেষ‌ করে শীতের সময় বা শুষ্ক জলবায়ুতে যখন ঘরের ভিতরের গরম বাতাস থেকে আর্দ্রতা সরে যায়, তখন গলায় অস্বস্তি বা গলা জ্বালা করতে পারে।

(ঙ) গ্যাস্ট্রোইসুফ্যাগাল রিফ্ল্যাক্স ডিজিস:

“Gastroesophageal Reflux Disease” যাকে সংক্ষেপে GERD নামে ডাকা হয় এটি একটি বিশেষ ধরনের শারীরিক সমস্যা। এটি হলে পাকস্থলীতে থাকা অ্যাসিডসমূহ আবার খাদ্যনালীতে ফেরত আসে। ফলশ্রুতিতে গলার আস্তরণে প্রদাহ‌ ও জ্বালা হয়।

(চ) টনসিল:

এটির সাথে আমাদের মোটামুটি সকলেরই পরিচয় রয়েছে। মানবদেহের গলার ভেতরে দু’পাশে দুটি প্যালাটিন টনসিল থাকে এগুলো এক ধরনের লসিকাগ্রন্থি বা লিম্ফয়েড টিস্যু। টনসিলের কারণে গলা ব্যথা বলতে আমরা এদের ইনফেকশনকেই বুঝে থাকি।

(ছ) পরিবেশগত কারণ:

দূষিত পরিবেশও গলা ব্যথা হওয়ার একটি কারণ হতে পারে। নোংরা ধোঁয়া, তীব্র গন্ধের কারণে গলার ইসোফেগাসে ব্যথা হতে পারে।

(জ) বাহ্যিক আঘাত:

গলার আশেপাশে কোনো বাহ্যিক আঘাত থেকেও গলায় প্রদাহ উৎপন্ন‌ হতে পারে। এমতাবস্থায় পরিস্থিতি বিবেচনায় চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

এমন কাজ করা থেকে বিরত থাকা উচিত যার ফলে গলার উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে। যেমনঃ অতিরিক্ত চিৎকার চেঁচামেচি করা, গলার সঠিক যত্ন না নেওয়া ইত্যাদি।

(ঝ) টিউমার:

টিউমার থেকেও গলা ব্যথা হতে পারে। সঠিক সময়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা না করা হলে তা শরীরের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করতে পারে।

গলায় টিউমার শনাক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শুরু করে দেওয়া উচিত, নয়তো তা থেকে ক্যান্সার হতে পারে।

যারা গলা ব্যথার সর্বাধিক ঝুঁকিতে থাকেনঃ

  • যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম
  • যাদের এলার্জির সমস্যা রয়েছে
  • যারা সাইনাসের সমস্যায় ভুগছেন
  • শিশু কিশোর বা যাদের বয়স কম
  • ঠান্ডায় যারা বেশি সংবেদনশীল
  • দীর্ঘসময় ধরে যারা ধূমপান করছেন বা ধূমপায়ী ব্যাক্তিদের আশেপাশে যারা থাকেন

কখন‌ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত?

স্বাভাবিক সময়ে‌ ঘরোয়া চিকিৎসাদ্বারা বা কিছু সাবধানতা অবলম্বন করলে কম সময়ের মধ্যেই গলাব্যাথা ঠিক হয়ে যায়। তবে অবস্থা বেশি খারাপ হলে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

  • গলা ব্যথার সাথে সাথে শ্বাসকষ্ট থাকলে
  • থুথুর সাথে রক্ত বের হলে
  • গলা বেশি ফোলা থাকলে, গলায় পুঁজ জমলে
  • ঢোক গিলার সময় বেশি সমস্যা হলে
  • কোনো কারণ ছাড়াই বারবার গলা ব্যথা হওয়া
  • দীর্ঘস্থায়ী গলা ব্যথা থাকলে

গলা ব্যথা কমানোর কিছু ঘরোয়া চিকিৎসাঃ

বেশিরভাগ সময় গলাব্যথা নিজে থেকেই কিছু সময়ের মধ্যেই ঠিক হয়ে যায়। তবে বেশি ব্যথা থাকলে প্যারাসিটামল সেবন‌ করা যেতে পারে। গলাব্যথার সাথে ঠান্ডা থাকলে কফের সিরাপ খাওয়া যেতে পারে। তবে সর্বোপরি একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

 (১) গরম পানি ব্যবহার:

গরম পানি আমাদের গলার জন্য অত্যন্ত উপকারী। পানি‌ হালকা গরম করলে পানি আরো নরম হয়, যা গলার জন্য অত্যন্ত উপকারী। অনেকে গলার সমস্যা দূরে রাখতে বছরব্যাপী হালকা গরম পানি পান করে থাকেন।

 (২) কুসুম গরম পানির গার্গল:

সামান্য লবণ পানি গরম পানিতে ব্যবহার করে গার্গল করলে গলার একাধিক সমস্যা উপশম করতে সহায়তা করে। একইসঙ্গে লবণ পানি ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতেও সহায়তা করে। তাই প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে এটি করা অত্যন্ত উপকারী।

 (৩) প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন:

গলায় ব্যথা দেখা দিলে সর্বপ্রথম গলাকে বিশ্রাম দিতে হবে এবং একে শুষ্ক রাখা যাবে না। কিছুক্ষণ পর পর কুসুম গরম পানি পান করতে হবে।

 (৪) মধু:

মধুর মধ্যে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান‌ থাকে যা গলার অস্বস্তি থেকে প্রশান্তি দিতে সহায়তা করে। তাই অনেকে চায়ের সাথে মধু মিশিয়ে খাওয়ার কথা বলে থাকেন। তবে মধু থেকে যাদের এলার্জি রয়েছে তাদের এই পদ্ধতি ব্যবহার না করাই ভালো।

 (৫) লেবু:

লেবুতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি বিদ্যমান থাকে, যা আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। এতে উপস্থিত অ্যান্টিইনফ্লেমেটারি উপাদানসমূহ গলার প্রদাহ দূরে রাখে। ফলে কোনো ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে গলা ব্যথা হলে লেবুর রস তা হতে দ্রুত সুস্থ হতে সাহায্য করে।

 (৬) গরম ভাপ নেওয়া:

গরম জলের বাটি থেকে বাষ্প নিঃশ্বাস হিসেবে নিয়ে দেখা যেতে পারে। এই পদ্ধতিতে গলার লালচে ফোলাভাব অনেকাংশেই কমে যায় এবং ব্যথা উপশম করে। আরো ভালো ফলাফল পেতে পানিতে সামান্য লবণ বা ম্যানথল ব্যবহার করা যেতে পারে।

 (৭) কম কথা বলা:

অনেককে কাজের স্বার্থে অত্যধিক কথা বলতে হয়, যেমন শিক্ষক, গায়ক তাদের ক্ষেত্রে গলাকে বিশ্রাম দেওয়া উপকারী ফলাফল বয়ে নিয়ে আসতে পারে।

 (৮) প্যারাসিটামল ও অ্যান্টিবায়োটিক:

যদি ওষুধ ব্যবহার করতেই হয় তাহলে প্রাথমিক পর্যায়ে প্যারাসিটামল গ্রুপের ওষুধ ব্যবহার করতে হবে। তবে বারবার একই সমস্যা ফিরে আসলে বা কয়েকদিন ব্যবহার করার পরেও ব্যথা না কমলে অবশ্যই ডাক্তার দেখাতে হবে।

কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার মোটেও নিজে থেকে করা যাবে না। পরিস্থিতি বিবেচনা করে একজন প্রশিক্ষিত চিকিৎসক আপনাকে ব্যবস্থাপত্র প্রদান করবেন। ব্যবস্থাপত্রে যতদিন উল্লেখ থাকবে ঠিক ততোদিনই অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করতে হবে।

 (৯) মেথি:

একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, মেথিতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-ফাঙ্গাল উপাদান রয়েছে। ফলে ক্ষতিকর ছত্রাক বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে হওয়া গলা ব্যথা উপশমে সহায়তা করে। কিন্তু গর্ভবতী নারীদের জন্য মেথি থেকে দূরে থাকাই উত্তম।

 (১০) রসুন:

রসুনের জীবাণু ধ্বংস করার ক্ষমতা অকল্পনীয়। এতে থাকা প্রদাহনাশক গলার ব্যথা উপশম করতে অধিক কার্যকরী। এছাড়াও প্রতিদিন এক টুকরো রসুন দাঁতের নীচে রাখলে মুখের ভেতর লুকিয়ে থাকা জীবাণু ধ্বংস করার পাশাপাশি দুর্গন্ধও দূর করে।

 (১১) গোলমরিচ:

গোলমরিচের বহুমুখী ব্যবহার ও এর উপকারিতা বলে শেষ করা যাবে না। এতে বিপুল পরিমাণে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টিভাইরাল এবং অ্যান্টিইনফ্লেমেটরি উপাদান রয়েছে। এগুলো গলার বিভিন্ন সমস্যা দূরীকরণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। গোলমরিচে বিদ্যমান মেন্থলের বৈশিষ্ট্য সর্দিকাশি দূর করে। আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে প্রতিদিন একটি আস্ত গোলমরিচ গরম পানিতে ফুটিয়ে চায়ের মতো পান করলে শ্বাসনালী ও পেটের একাধিক সমস্যা দূরে রাখে।

 (১২) আদা:

আদাতে আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে প্রতিদিন এক টুকরো আদা টনসিলের কারণে হওয়া গলা ব্যথা দূরে রাখে। সবথেকে ভালো হয় সকালে আদার রস দিয়ে শুরু করলে।।

উপসংহারঃ

গলা ব্যথা একটি অস্বস্তিকর ও বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা দিতে পারে। বেশিরভাগ সময়ই এটি ভাইরাল বা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ, অ্যালার্জি, পরিবেশগত অবস্থা বা গলার পেশীতে চাপের কারণে হয়ে থাকে। সঠিক পরিচর্যা ও বিশ্রামের সাহায্যে অল্প সময়েই এর থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

তবে অবস্থা যদি আরো খারাপের দিকে এগুতে থাকে বা বারংবার একই উপসর্গগুলো ফিরে আসে তবে যথাসম্ভব একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

এছাড়াও গলা আমাদের একটি অতি সংবেদনশীল অঙ্গ। এর যেকোনো সমস্যাকে আমাদের গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে।

তথ্যসূত্রঃ

  • https://www.nhsinform.scot/illnesses-and-conditions/ears-nose-and-throat/sore-throat
  • https://www.healthline.com/health/sore-throat #https://www.verywellhealth.com/throat-pain-4174240

আরও পড়তে পারেন –

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.