আমাদের সকলেরই খুব পরিচিত একটি মসলা হচ্ছে কালোজিরা (Black Cumin/Nigella)। তবে মসলা হিসেবে খাওয়ার পাশাপাশি এটিকে আয়ুর্বেদিক, ইউনানী ও কবিরাজি চিকিৎসার ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হয়। সেই প্রাচীনকাল থেকেই এটি নানা রোগের প্রতিষেধক এবং প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করছে। কালোজিরার উপকারিতা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। এই কারণে এটিকে সকল রোগের মহৌষধ বলা হয়।
কালোজিরা কি:
কালোজিরার বৈজ্ঞানিক নাম Nigella Sativa Linn। এটির গাছ মাঝারি আকৃতির হয়ে থাকে এবং শুধুমাত্র একবারই ফুল ও ফল দেয়। প্রতিটি গোলাকার ফল থেকে তিন-কোনা আকৃতির কালো রঙের ২০-২৫ টি বীজ পাওয়া যায়। এটির বীজ ছোট হওয়া সত্ত্বেও এর গুণাগুণ স্বাস্থ্য উপকারিতা অপরিহার্য।
কালোজিরার উপকারিতা:
ঔষধি গুণাগুণ ও খাবারের স্বাদ বৃদ্ধির জন্য এর বিকল্প খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। আমাদের দেহের জন্য কালোজিরার উপকারিতা অপরিহার্য। চলুন এটির উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক:
ক) স্মৃতি শক্তি বৃদ্ধি:
এটি স্মরণ শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। কালোজিরাতে অ্যান্টিবায়োটিক বা অ্যান্টিসেপটিক পদার্থ রয়েছে যা মস্তিষ্কের রক্তসঞ্চালন বাড়িয়ে দেয় এতে স্মরণ শক্তি বেড়ে যায়। এছাড়াও এটি মেধার বিকাশে সাহায্য করে।
খ) হজমে সাহায্য করে:
প্রতিদিন এক-দুই চা-চামচ কালিজিরা বেটে পানির সাথে খেলে হজম শক্তি বাড়ে। এটি পেটফাঁপা সমস্যাকেও দূর করে। এছাড়াও অন্যান্য হজম সমস্যার বিরুদ্ধেও এটি কার্যকরী।
গ) অতিরিক্ত চর্বি কমায়:
ডায়েটের জন্য কালোজিরা অত্যন্ত উপকারী। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে এক চামচ মধু এর সাথে আর্ধেক চা-চামচ কালোজিরা খাওয়ার অভ্যাস করলে শরীরের অতিরিক্ত মেদ বা চর্বি কমে যাবে।
ঘ) ত্বকের উজ্জ্বলতা ধরে রাখে:
কালোজিরা ত্বকের ব্রণ ও দাগ দূরে রাখতে সাহায্য করে। কালোজিরার তেল ও লেবুর রস মিশিয়ে দিনে দু’বার মুখে লাগাতে পারেন। এই দুটো একসঙ্গে মিশিয়ে ব্যবহার করলে ত্বকের অনেক সমস্যার সমাধান পাবেন।
ঙ) মাথাব্যথা দূরে রাখে:
মাথাব্যথা দূরে রাখতে কালোজিরা একটি পুরনো ঘরোয়া চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে লম্বা সময় ধরে কাজ করে চলেছে। ১/২ চা চামচ কালোজিরার তেল মাথায় ভালোভাবে মালিশ করলে মাথা ব্যথা দূর হয়। মাথা ব্যথায় কপালের উভয় চিবুকে ও কানের চারপাশে প্রতিদিন ৩ থেকে ৪ বার কালোজিরা তেল মালিশ করলে উপকার পাওয়া যায়।
চ) রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়:
এটি শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে সতেজ রাখে। ফলে জীবানুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে দেহ প্রস্তুত থাকে এবং স্বাস্থের সার্বিক উন্নতি করে।
ছ) চুল পড়া বন্ধ করে:
বর্তমানে চুল পড়া একটি বড় সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানে প্রতিদিন কালোজিরা সেবন করতে পারেন এতে চুল পুষ্টি পাবে। অধিক সুফল পেতে চুলের গোড়ায় এর তেল মালিশ করতে পারেন।
জ) অনিয়মিত মাসিক সমস্যা:
এটি মহিলাদের কমন সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি। নিয়মিত এক কাপ কাঁচা হলুদের রস বা সমপরিমাণ আতপ চাল ধোয়া পানির সাথে এক কাপ চা-চামচ কালোজিরার তেল মিশিয়ে ৩বার করে খেলে উপকার পাওয়া যাবে।
ঝ) স্তনদূধ বাড়ায়:
প্রতিরাতে ঘুমানোর আগে ৫-১০ গ্রাম কালোজিরা মিহি করে দুধের সাথে খেতে থাকতে হবে। এছাড়াও ১ চা-চামচ কালোজিরার তেল সমপরিমাণ মধুসহ দৈনিক ৩বার করে খেয়ে দেখতে পারেন।
ঢ) যৌন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে:
কালোজিরা নারী-পুরুষ উভয়ের যৌন ক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাজ করে। নিয়মিত কালোজিরা সেবন করলে পুরুষদের বীর্যের পরিমাণ বাড়ে এবং পুরুষত্বহীনতা থেকে মুক্তি দেয়। ১ চা-চামচ মাখন, ১ চা চামচ জাইতুন তেল সমপরিমাণ কালোজিরার তেল ও মধুসহ প্রতিদিন ৩ বার ৪/৫ সপ্তাহ ধরে খেলে উপকার পাওয়া যায়।
দ) শিশুর দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধিতে:
শিশুদের দৈহিক ও মানসিক ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য তাদের কালোজিরা তেলের মালিশ করানো যেতে পারে। দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের সরাসরি কালোজিরা না খাওয়ানোই ভালো। তবে দুই বছরের বড় বাচ্চাদের এটি খাওয়ানোর অভ্যাস গড়ে তোলা যেতে পারে।
এইসব উপকারিতা থেকে আমরা সহজেই ধারণা করতে পারি কেনো এটিকে সকল রোগের মহৌষধ হিসেবে অবহিত করা হয়। এছাড়াও অর্শ রোগ নিরাময়ে এটির গুণাগুণ অপ্রতিরোধ্য। গ্যাষ্ট্রীক বা আমাশয়সহ সর্দিকাশি এবং শান্তিপূর্ণ ঘুমের জন্য অভিজ্ঞরা এটিকে গ্রহণ করার উপদেশ দেন।
কালোজিরা যেসব রোগ নিরাময়ে ভূমিকা রাখেঃ
ক) জন্ডিস বা লিভারের বিভিন্ন সমস্যার দূর করে:
লিভার ক্যান্সার সৃষ্টিকারী আলফা টক্সিন ধ্বংস করতে কাজ করে কালোজিরা। একইসাথে ১ গ্লাস ত্রিফলার শরবতের সাথে ১ চা-চামচ কালোজিরার তেল দিনে ৩বার করে ৪/৫ সপ্তাহ খেতে পারেন।
খ) শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানি রোগে কার্যকর:
যাদের শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানির সমস্যা রয়েছে তারা প্রতিদিনকার খাদ্যতালিকায় কালোজিরার ভর্তা রেখে দিন। এছাড়াও ১ চা-চামচ কালোজিরার তেল, ১ কাপ দুধ বা রং চায়ের সাথে দৈনিক ৩ বার করে নিয়মিত খেলেও অনেক উপকার পাবেন। এটি শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানি উপশম করবে।
গ) চর্মরোগ সারাতে:
যেখানে চর্মরোগ দেখা দিয়েছে সেখানটা ভালোমতো কালোজিরার তেল মালিশ করা যেতে পারে। প্রতিদিন ৩ বার করে ১ চা-চামচ কাঁচা হলুদের রসের সাথে সমপরিমাণ কালোজিরার তেল, সমপরিমান মধু বা এক কাপ রং চায়ের সাথে ২/৩ সপ্তাহ খেলে উপকার পাবেন।
ঘ) রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে:
প্রতি সপ্তাহে ২/৩ দিন এক চা-চামচ কালোজিরার তেল সমপরিমাণ মধুসহ খেলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। কালোজিরা বা কালোজিরা তেল একসঙ্গে নিম্ন রক্তচাপকে বৃদ্ধি করে ও উচ্চ রক্তচাপকে হ্রাস করে।
ঙ) বাতের ব্যথা দূরে রাখে:
কোথাও বাতের ব্যথা থাকলে সেখানে ভালো করে কালোজিরার তেল মালিশ করতে হবে। এছাড়াও ১ চা চামচ কাঁচা হলুদের রসের সাথে ১ চা-চামচ কালোজিরার তেল সমপরিমান মধু বা এক কাপ রং চায়ের সাথে দৈনিক ৩বার ২-৩ সপ্তাহ খেয়ে দেখতে পারেন এতে উপকার পাবেন।
চ) ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকারী:
কালোজিরা ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য খুবই উপকারী। কালোজিরার তেল ডায়বেটিসকে নিয়ন্ত্রণে আনতে কাজ করে। এটি রক্তের শর্করা কমিয়ে আনতে সহায়তা করে। ডায়াবেটিস সম্পর্কে আরও জানতে পড়তে পারেনঃ ডায়াবেটিস কমানোর উপায়
ছ) দাঁতের ব্যথা সমাধানে:
কুসুম গরম পানিতে কালোজিরা দিয়ে কুলি করলে দাঁতের ব্যথায় আরাম পাওয়া যায়। এটি জিহ্বা, তালু, দাঁতের মাড়ির জীবাণু মেরে ফেলে।
কালোজিরা খাওয়ার নিয়ম:
প্রাচীনকাল থেকেই খাবারের স্বাদ বাড়াতে কালোজিরার ব্যবহার হয়ে আসছে। তবে কালোজিরার ব্যবহার শুধু খাবারের স্বাদ বৃদ্ধির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটির আরো অনেক ব্যবহার রয়েছে।
এটি খাওয়ার মূলতঃ কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। এটিকে বিভিন্ন উপায়ে খাওয়া যায় যার মধ্যে কিছু পদ্ধতি ইতোমধ্যে উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। নীচে কালোজিরা খাওয়ার আরো পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হলো:
কালোজিরার তেল:
এ তেল আমাদের শরীরের জন্য অনেক উপকারী। কালোজিরার তেলে প্রায় ১০০টিরও বেশি উপকারী উপাদান আছে। এদের মধ্যে প্রায় ২১ শতাংশ আমিষ, ৩৮ শতাংশ শর্করা এবং ৩৫ শতাংশ ভেষজ তেল ও চর্বি। এই তেল আমরা হলুদ এবং দুধের সাথে মিশিয়ে খেতে পারি।
মধু আর কালোজিরা:
মধু আর কালোজিরা দুটোই প্রচুর ঔষধি গুণাগুণ সম্পন্ন। যদি এই দুটিকে একত্রে খাওয়া হয় তবে তা আমাদের দেহের উন্নতিতে ভূমিকা রাখে। বাজারে কালোজিরার মধুও কিনতে পাওয়া যায়।
পান ও কালোজিরা:
ভারতীয় উপমহাদেশে পান খাওয়া একটি পুরনো অভ্যাস। খাবার খাওয়ার পর মশলা সমৃদ্ধ পান খাওয়া আমাদের মুখের স্বাদ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। অনেকে আবার মুখ দুর্গন্ধমুক্ত রাখতে পান চিবিয়ে থাকেন।
টক দই ও কালোজিরা:
বলা হয়ে থাকে টক দই ও কালোজিরা একসাথে খেলে শরীরের অতিরিক্ত চর্বি বা ওজন কমায়। টক দই প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, রাইবোফ্ল্যাভিন, ভিটামিন B6 এবং ভিটামিন B12 এ সমৃদ্ধ। বিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা গেছে, কালোজিরা ও টকদই একসাথে খেলে শরীরের মেটাবলিজম বাড়াতে সাহায্য করে। ফলে কমে যায় মেদের পরিমাণ এবং দ্রুত শরীরের ওজন কমায়।
রসুন ও কালোজিরা:
প্রতিদিন রসুন ও কালোজিরা খেলে নারী পুরুষ উভয়ের যৌন ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এই দুটিকে একসাথে খেলে পুরুষদের বীর্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
কালোজিরার অপকারিতা:
কালোজিরার ক্ষতিকর দিক বলতে তেমন কিছুকে চিহ্নিত করা হয়নি। একসাথে বেশি কালোজিরা খাওয়া উচিত নয় এতে পিত্ত সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে যাদের কালোজিরায় এলার্জি আছে তাদের এটির থেকে বিরত থাকাই ভালো। একইসঙ্গে গর্ভবতী মা ও দুই বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের সরাসরি এটি না খাওয়াই ভালো তবে বাহ্যিক ব্যবহার করা যেতেই পারে।
পরিশেষে-
আজকের আলোচনায় আমরা কালোজিরার উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ সম্পর্কে জানতে পারলাম। নিঃসন্দেহে এটিকে আমরা সকল রোগের মহৌষধ হিসেবে ডাকতেই পারি। তাই হয়ত বিস্ময়কর এই জিনিসটির প্রশংসা করেছেন খোদ রাসুল (সা.)। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত-
“তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছেন, কালিজিরায় সকল প্রকার রোগের উপশম আছে, তবে ‘আস্সাম’ ব্যতীত। আর ‘আস্সা-ম’ হলো মৃত্যু।”
(মুসলিম, হাদিস : ৫৬৫৯)
তথ্যসূত্রঃ
It was really very helpful and Jajakallahu khairan
Thanks for the nice comment.
মৃত্যু বাতিত সকল রোগের নিরাময় কালোজিরাতে রয়েছে মোহাম্মাদ (সঃ)
আমার প্রশ্ন হল, কালোজিরা ঘরে রাখা অবস্থায় পোকা ধরেছে। এখন এই কালোজিরা কী ফেলে দিব। নাকি খাওয়া যাবে। পোকা কীভাবে দূর করা যায়?
জ্বী ফেলে দিন। নষ্ট হওয়ার পরিমাণ যদি কম হয় তাহলে ঝেড়ে পরিস্কার করে, ধুয়ে শুকিয়ে আবার ব্যবহার করতে পারেন। আর পোকা দূর করার বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপায় আছে, সেগুলো চেস্টা করে দেখতে পারেন। ধন্যবাদ।
কালোজিরাএকটু ভেজে খাবো নাকি কাঁচা খাব, ক্যান্সার রোগে কালোজিরা সুফল কি কি?? 🌹🌹
বলা হয়ে থাকে কালোজিরা সকল রোগের ঔষধ। অল্প আঁচে ভাজা কালোজিরা খেতে পারেন।