মরিংগা বা সজিনা পাতার পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা


সজিনা বা মরিঙ্গা একটি অত্যন্ত উপকারী সবজি।‌ আবার মরিংগা বা সজিনা পাতা অত্যন্ত পুষ্টিকর ও অনেক খাদ্যগুণ সমৃদ্ধ হয়ে থাকে। যার জন্য মরিঙ্গা পাতাকে ‘সুপার ফুড’ বলা হয়ে থাকে। এটির উপকারী গুণাবলীর জন্য প্রাচীন চিকিৎসা শাস্ত্রে এর বহুমুখী ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।

পরিচয়ঃ

এটি Moringaceae পরিবারভুক্ত Moringa জাতীয় একটি বৃক্ষ। এটির বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে Moringa oleifera। আঞ্চলিক ভাষায় এখনো একে কোথাও কোথাও মরিংগা নামে ডাকা হয়। এটি যদিও ভারতীয় উপমহাদেশের স্থানীয় একটি গাছ তবে এশিয়া, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকাতেও এটিকে ব্যাপকভাবে চাষাবাদ করা হয়। এর নানাবিধ শারীরিক সমস্যা দূর করার ক্ষমতার কারণে একে “সুপার ফুড” হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

পুষ্টি উপাদানঃ

সাম্প্রতিক গবেষণার নিরিখে এটা বলা হয়ে থাকে যে, প্রতি ১ গ্রাম সজনে পাতাতে একটি কমলার তুলনায় ৭ গুণ বেশি ভিটামিন সি, দুধের চেয়ে ৪ গুণ বেশি ক্যালসিয়াম ও ২ গুণ বেশি প্রোটিন, গাজর অপেক্ষা ৪ গুণ বেশি ভিটামিন এ এবং কলার চেয়ে ৩ গুণ বেশি পটাশিয়াম থাকে। যা থেকে সহজেই অনুমান করা যায় এটি কতটা স্বাস্থ্যসম্মত।

মানুষের দেহে যে ৯ টি এ্যামিনো এসিড খাবারের মাধ্যমে সরবরাহ করতে হয় তার সবকটি এই সজনেতে আছে। এছাড়াও এতে প্রচুর পরিমাণে জিঙ্ক ও আয়রন রয়েছে যা পালংশাক থেকেও ৩ গুণ বেশি।

সজিনা পাতার ঔষধি গুণঃ

সাম্প্রতিক করা বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে সজিনা গাছে প্রায় 20 ধরনের অ্যামিনো অ্যাসিড, 46 ধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ৩৬ টি অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান রয়েছে যা “মরিঙ্গা পাতা” কে সেরা প্রাকৃতিক পুষ্টিকর সম্পূরক হিসাবে তৈরি করে। এর ঔষধি প্রকৃতির উপকারিতা বলে শেষ করা সম্ভব নয়। তবে এর বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা নীচে তুলে ধরা হলো:-

(ক) ডায়বেটিসের ওষুধ:

সজনে পাতার জুসে বিপুল পরিমাণে ভিটামিন ও মিনারেলের উপস্থিতি থাকায় এটি রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে। একারণে ডায়বেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য মরিংগার জুস তাদের খাদ্যতালিকায় রাখার জন্য সুপারিশ করা হয়।

(খ) হাঁড় শক্ত করে:

এটি প্রমাণিত যে, সজনে পাতায় প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম ও আয়রন পাওয়া যায় যা কিনা হাঁড় মজবুত করতে সহায়তা করে। মহিলা ও শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে মরিঙ্গা পাতা।

(গ) হার্টের উপকার করে:

হার্টের জন্য উচ্চ রক্তচাপ অত্যন্ত ক্ষতিকর। মরিংগা পাতার জুসে থাকা দরকারি উপাদান উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রেখে হার্টের উপকার করে।

(ঘ) হজমের ক্ষেত্রে উপকারী:

এটিতে রিবোফ্লাভিন নামক একটি উপাদান রয়েছে যা বি ভিটামিনের একটি শক্তিশালী উৎস। বি ভিটামিনগুলো পাকস্থলীতে থাকা খাবার ভেঙ্গে ফেলতে সহায়তা করে। ফলশ্রুতিতে হজমশক্তি বৃদ্ধি পায় এবং ক্ষুধামন্দা উপশম হয়।

(ঙ) ত্বকের সমস্যা দূর করে:

আমাদের ত্বক সারাদিন বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর দূষিত উপাদানের সংস্পর্শে আসে। এর ফলে আমাদের ত্বকের মারাত্মক ক্ষতিসাধন হয়। ত্বক পরিষ্কার এবং হাইড্রেটিং বৈশিষ্ট্য থাকায় সজিনা ত্বককে সুন্দর ও সুরক্ষিত রাখতে অনেক উপকারী।

(চ) রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা:

উচ্চমাত্রায় ভিটামিন, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান থাকায় এটি আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেয়। একারণে আমাদের খাদ্যাভাসে সজিনা বা সজিনা পাতার জুসকে অন্তর্ভুক্ত করা উচিৎ।

(ছ) দৃষ্টি শক্তির উপকার করে:

চোখের দৃষ্টি ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সজিনা পাতার রস অনেক উপাদেয়। তাই চোখের শক্তি বাড়াতে হলে অবশ্যই মরিংগার জুস খাওয়া উচিৎ।

(জ) আর্সেনিক দূষণ রোধ করে:

আমাদের দেশের নলকূপ গুলোতে প্রবল‌ মাত্রায় আর্সেনিক দূষণ লক্ষ্য করা যায়।‌ এই‌ দূষণের ফলে মানবদেহে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যার প্রকোপ দেখা যায়। গবেষণায় ইঁদুরের উপর পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে সজিনায় থাকা কিছু উপাদান আর্সেনিক দূষণ রোধ করতে সক্ষম।

মরিংগা বা সজিনা পাতা খাওয়ার নিয়মঃ

 (১) সবজি হিসেবে:

সজিনা বা মরিংগা গ্রীষ্মকালীন সবজি হিসেবে ভারতীয় উপমহাদেশে বিপুল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বাঙ্গালী নারীরা সজনে ডাটাকে সরিষা‌ বাঁটার সাথে মিশিয়ে একটি পদ তৈরি করে থাকে যা অনেক সুস্বাদু হয়ে থাকে। এছাড়াও অন্যান্য তরিতরকারির সাথে খুব সহজেই মিশে যেতে সক্ষম এই সবজিটি।

 (২) পাতা:

সজনে গাছের কোনো কিছুই ফেলনা নয়। এটির অত্যন্ত উপাদেয়।‌ এটির সাহায্যে তৈরি করা রস বা জুস আমাদের প্রাত্যহিক খাদ্যতালিকায় সামিল করলে আমাদের শরীরের অনেক উপকার হবে। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা থেকে এটা প্রমাণিত যে, সজনে পাতা ৩০০ ধরনের রোগবালাই দূরে রাখতে কাজে আসে।

 (৩) গুঁড়া ব্যবহার করা:

বাজারে সজনে পাতার গুঁড়া বিক্রি করা হয়ে থাকে। এই গুড়াকে বিভিন্ন ভাবে আমাদের খাদ্যে ব্যবহার করা যায়। এই গুড়া দিয়ে তৈরি করা শরবত পান করলে শরীরের নানাবিধ উপকার সাধনের পাশাপাশি সজনে পাতার গুণাগুণ খুব সহজেই গ্রহণ করা হয়।

 (৪) চা হিসেবে:

চা হিসেবে এটির এতো প্রচলন লক্ষ্য না করা গেলেও বর্তমানে বিভিন্ন দোকানে সজনে পাতার চা বিক্রির প্রবণতা দেখতে পাওয়া গেছে।

যদি বাজারে বিক্রি করা চায়ের উপর ভরসা না পান তবে নিজের হাতেও এই চা পাতা তৈরি করে নিতে পারেন খুব সহজেই।‌ মরিংগা পাতাকে সামান্য শুকিয়ে ব্লেন্ডারে গুঁড়ো করে নিন। এবার প্রয়োজনের মুহূর্তে ব্যবহার করুন আপনার নিজের হাতে বানানো চা পাতা

মরিংগা বা সজিনা পাতা গুঁড়া করার নিয়মঃ

খুব সহজে ঘরে বসেই মরিংগা বা সজিনা‌ পাতার গুঁড়া তৈরি করা সংরক্ষণ করা যায়। এ প্রক্রিয়ায় প্রথমে ডাল থেকে সতেজ দেখে পাতা সংগ্রহ করতে হবে। এবার পাতাগুলোকে ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে যাতে এতে কোনো ময়লা লেগে না থাকে।

এরপর একটি ছিদ্রযুক্ত পাত্রে পাতাগুলো রেখে দিন যাতে অতিরিক্ত পানি ঝরে পড়ে। শুকিয়ে থাকা পাতাগুলো একটি ডালায় সাজিয়ে রোদে শুকাতে দিন। মরিংগা পাতাগুলো অনেক ছোটো হয়ে থাকে তাই সহজেই বাতাসে উড়ে যেতে পারে। এমন পরিস্থিতি এড়াতে কোনো পাতলা কিন্তু স্বচ্ছ কাপড় দিয়ে ঢেকে দিন।

যারা রোদে শুকাতে পারবেন না তারা একটি স্টিলের পাত্রে অল্প আঁচে চুলা ব্যবহার করেও শুকানোর কাজ করতে পারবেন।

এবার ব্লেন্ডার বা হামলদিস্তা ব্যবহার করে পাতাগুলোকে চূর্ণ করে পাউডারের মতো মিহি করে নিন। ভালো‌ ফলাফল‌ পেতে ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে নিন যাতে অচূর্ণ পদার্থসমূহ দূর করা যায়।

এবার একটি ঢাকনাযুক্ত কাঁচের পাত্রে এই গুঁড়া সংরক্ষণ করুন। সংরক্ষণ করার জন্য প্লাস্টিকের পাত্র এড়িয়ে চলুন, কেননা এতে পাতার গুণাগুণ খারাপ হতে পারে।

মরিংগার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অপকারিতাঃ

একজনের জন্য যা উপকারী অপরের জন্য তা ক্ষতির কারণ হতে পারে।

গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে, মরিংগার নির্যাস মহিলাদের অভ্যন্তরীণ প্রজনন অঙ্গ সংকোচনের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। গর্ভাবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত সজিনার জুস গ্রহণ করা উচিৎ নয়।

স্তন্যপান করানো মায়েদের মরিংগা এড়িয়ে চলা উচিত কেননা এতে থাকা পদার্থসমূহ মায়ের দুধের সাথে মিশে যেতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে এতে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশী সীসা রয়েছে যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।

যাদের রক্ত পাতলা তাদের জন্য এটিকে এড়িয়ে চলায় ভালো যদি না আপনি ইতোমধ্যে আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে থাকেন।

পরিশেষেঃ

ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় প্রতিটি ঘরেই মরিংগা বা সজিনা পাতা সবজি হিসেবে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। এর নানা ধরনের পুষ্টি ও ঔষধি গুণ রয়েছে। এর পাতা থেকে তৈরি করা জুস অত্যন্ত উপাদেয় একটি পানীয়। সতেজ পাতা এবং এই পাতা থেকে তৈরি করা গুঁড়া দিয়ে সারাবছরই এই জুস তৈরি করে পান‌ করা যায়। তবে কারো‌ যদি এটি পান‌ করে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয় তবে অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ পুষ্টিবিদের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

তথ্যসূত্রঃ

আরও পড়তে পারেন –

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.