আমাদের দেশের অন্যতম পরিচিত এক ভেষজের নাম হল থানকুনি পাতা (Indian pennywort)। এটি একটি দারুণ ভেষজ উদ্ভিদ। বিভিন্ন রোগের ভেষজ ঔষধ হিসেবে এর ব্যবহার অনেক। গ্রামাঞ্চলে বহু আগে থেকেই এই উদ্ভিদের পাতার ব্যবহার রয়েছে। দেখতে ছোট ও গোলাকৃতির এই পাতা অত্যন্ত উপকারী।
নানা রোগের উপশমে কার্যকর এই পাতা। অঞ্চলভেদে এর রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন নাম। কোথাও এর নাম আদামনি, কোথাও আবার টেয়া, আবার কোথাও মানকি, আদানগুনি, ঢোলামনি, আদাগুনানী, মানামানি, ধূলাবেগুন ইত্যাদি নামে পরিচিত। বিভিন্ন অঞ্চলে এটি ডোলামানিক নামেও পরিচিত। তবে মূলত থানকুনি নামেই একে সবাই চিনে।
থানকুনি পাতার উপকারিতা
থানকুনি পাতা চাষে খুব যত্নের দরকার হয় না ঠিকই কিন্তু এর থেকে প্রাপ্ত উপকারিতা কিন্তু অনেক। নানা রোগের নানা উপকারিতায় এই পাতা কাজে লাগে। স্বাদে তিতা হলে উপকারিতায় অনন্য। অনেক উপকারী এই পাতার উপকারিতাগুলো এবার জেনে নিই।
- যেকোনো ক্ষত স্থানে, শরীরের কোথাও কেটে গেলে রক্তপাত বন্ধে এই পাতা বেশ কার্যকরী। ক্ষতস্থানে সাথে সাথে এই পাতা বেটে লাগালে ব্যথা থেকে আরাম পাওয়া যায় পাশাপাশি ক্ষতও সৃষ্টি হয় না।
- থ্রম্বোসিস বা অন্যান্য শারীরিক সমস্যার কারণে অনেকের দেহে রক্তপ্রবাহের সমস্যা হয়৷ অর্থাৎ, ররক্তপ্রবাহ ঠিকমতো হয় না।এক্ষেত্রে সমাধান হতে পারে থানকুনি পাতা। এই পাতার রস খেলে অক্সিজেন যুক্ত রক্ত দেহের প্রত্যেকটি কোষে পৌঁছে যায় এবং এর পাশাপাশি রক্তপ্রবাহও স্বাভাবিক থাকে।
- এই পাতায় রয়েছে অ্যান্টি ইনফ্ল্যামেটারি উপাদান যা শরীরের জ্বালাপোড়া দূর করায় কাজ করে। এই উপাদানের কারণে খুব দ্রুত শরীরের জ্বালাপোড়া ও যন্ত্রণা দূর হয়।
- প্রচুর ভিটামিন সি থাকায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। শরীরের অবসাদ ও ক্লান্তি ভাব দূর করতেও থানকুনি পাতার রস বেশ উপকারী।
- নিয়মিত এই পাতার রস খেলে মানুষের হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
- পেটের বিভিন্ন সমস্যায় এই পাতার রস বেশ কার্যকর। আমাশয় থেকে শুরু করে আলসারও দূর করতে এই পাতার রস সাহায্য করে। আলসার কিংবা আমাশয় রোগে এই পাতার রস খেলে দারুণ উপকার পাওয়া যায় এবং রোগী খুব দ্রুত সুস্থতা লাভ করে।
- দেহের স্ট্রেস হরমোনের ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে থানকুনি পাতা। তাই এই পাতার রস খেলে মানসিক অবসাদ ও ক্লান্তি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এই পাতার রস মানসিক শান্তি প্রদানে কাজ করে বলে অ্যাংজাইটি বা উদ্বিগ্নতার মতো রোগ থেকেও মুক্তি পাওয়া যায়।
- এই পাতায় রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা মস্তিষ্কের পেন্টাসাক্লিক ট্রিটারপেনস নামক উপাদানের মাত্র বাড়ায় যা মস্তিষ্কের জন্য উপকারী। এই উপাদান মস্তিষ্কের ব্রেন সেলকে ভালোভাবে কাজ করতে সাহায্য করে। ফলে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বাড়ে এবং স্মৃতিশক্তিও ভালো হয়, পাশাপাশি বুদ্ধিও বাড়ে।
- থানকুনি পাতা ভেজানো পানি খেলে মানুষের স্নায়ু বা নার্ভ শিথিল হয়। ফলে ঘুমের সময় উত্তেজনা কাজ করে না। ফলে ভালো ঘুম হয়। তাই ভালো ঘুমের জন্য নিয়মিত এই পাতার রস কিংবা এই পাতা ভেজানো পানি খেতে পারেন।
- কাশি থেকে মুক্তির অন্যতম একটি ওষুধ হতে পারে থানকুনি পাতা। ২-৩ চামচ থানকুনি পাতার রস খেলে সহজেই কাশি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। তিতা স্বাদ কমাতে এর সাথে চিনি মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে।
- আয়ুর্বেদ শাস্ত্রমতে, জ্বরের সময় এই পাতার রস ও শিউলি পাতার রস একসাথে মিশিয়ে খেলে সহজেই জ্বর কমে যায়। পাশাপাশি শারীরিক দুর্বলতাও দূর হয়।
- গ্যাস্ট্রিকের সমস্যার দারুণ এক সমাধান হলো এই পাতার রস। নিয়মিত সকালে এই পাতার রস খেলে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা থেকে অন্য কোনো ঔষধ ছাড়াই মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
- পায়ের ব্যথায় এই পাতা খুবই উপকারী। এই পাতা খেলে পায়ের ব্যথা থাকলে কিংবা পা ফোলা থাকলে সহজেই কমে যায়।
- ত্বকের ঔজ্জ্বল্যতা ধরে রাখাতেও এই পাতার রয়েছে অনেক গুণ। নিয়মিত এই পাতা বেটে মধু বা গোলাপজলের সাথে মিশিয়ে মুখে লাগালে ত্বকের ঔজ্জ্বল্যতা বৃদ্ধি পায় এবং ত্বকের ব্রণ জনিত সমস্যাও দূর হয়।
থানকুনি পাতা খাওয়ার নিয়ম
থানকুনি পাতা কিভাবে খাওয়া যায়? বিভিন্ন উপায়ে এই পাতা খাওয়া যেতে পারে। কিভাবে এই পাতা খাওয়া যায় এবার তা জেনে নিই।
- সকালে গরম পানির সাথে মিশিয়ে এই পাতার রস খাওয়া যায়। এটি বেশ কাজে দেয়।
- কাঁচা দুধের সাথে মিশিয়েও এই পাতার রস খাওয়া যায়। এটি গ্যাস্ট্রিকের ক্ষেত্রে উপকারী। যাদের গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা আছে তারা চাইলে ঔষধের পরিবর্তে এই পাতার রস কাঁচা দুধ দিয়ে খেয়ে দেখতে পারেন।
- ভর্তা হিসেবেও থানকুনি পাতা খাওয়া যায় ভাতের সাথে। গরম ভাতের সাথে এই পাতার ভর্তা পেট ব্যথার ক্ষেত্রে উপকারী।
- মধুর সাথে মিশিয়ে এই পাতার রস খাওয়া যায়, যা রক্ত পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। তাই নিয়মিত এই পাতার রস মধু দিয়ে খেতে পারেন।
- থানকুনি পাতা কাঁচা চিবিয়েও খাওয়া যায়। এতে বেশ উপকার পাওয়া যায় এবং পেটও পরিষ্কার হয়।
- চিনির সাথে মিশিয়ে এই পাতার রস খেলে কাশির ক্ষেত্রে আরাম পাওয়া যায়। তাই কাশি হলে ১ বা ২ চামচ রসের সাথে অল্প চিনি মিশিয়ে খাওয়া উচিৎ। একটানা কয়েকদিন খেলে আপনার কাশি আর একদমই থাকবে না।
- প্রতিদিন সকালে থানকুনি পাতার রসের সাথে হলুদ মিশিয়ে খেলে লিভারের উপকার হয়। ৫ থেকে ৬ মাস এভাবে খেলে লিভার সুস্থ থাকবে অবশ্যই।
থানকুনি পাতার অপকারিতা
অন্য যেকোনো কিছুর মতো থানকুনি পাতারও রয়েছে কিছু ক্ষতিকর দিক বা অপকারিতা। যেকোনো কিছুই বেশি খেলে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই পাতার ক্ষেত্রেও একই রকম। এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে এবার আলোচনা করা যাক।
- পেট খারাপের এক মহৌষধ থানকুনি পাতা বেশি খেলে পেট ভালো হওয়ার পরিবর্তে উল্টো রোগ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
- প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পরিমাণে এই পাতা খেলে মাথা ঘোরানোর সম্ভাবনা আছে।
- অনেকের এই পাতা খেলে এলার্জি কিংবা খোসপাঁচড়া হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
- বিভিন্ন অপারেশনের রোগী যারা আছেন তারা এই পাতা না খাওয়াই ভালো। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে।
- লিভারের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীরা এই পাতা না খাওয়া উচিৎ। কারণ, এই পাতা খেলে এ ধরনের রোগীরা বিভিন্ন সমস্যায় ভুগতে পারেন।
আবার অনেকে চিনতে ভুল করে থানকুনি পাতার বদলে অন্য পাতা খেয়ে ফেলেন। এতে কিন্তু মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। অনেক পাতা বিষাক্ত হয়। তাই এক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরী।
পরিশেষে
থানকুনি পাতাকে আমরা যত্ন না করলেও এই পাতার উদ্ভিদ কিন্তু নিজেই বেড়ে উঠে নিজ গুণেই মানুষের মনে জায়গা করে নিচ্ছে বা নিয়েছে। ভেষজ চিকিৎসায় অনেক আগে থেকেই এর ব্যবহার রয়েছে। মানুষের অবহেলার শিকার হলেও এরা কিন্তু মানুষের উপকারই করে চলেছে।
সহজেই পাওয়া যায় বলে বিভিন্ন রোগের সহজ সমাধান হতে পারে এই পাতা। অনেক সময় আমরা না বুঝে কিংবা ঝোপঝাড় পরিষ্কার করতে গিয়ে উপকারী এই পাতা কিংবা এর উদ্ভিদকেও মেরে ফেলি। আবার অনেকে না চিনেও এই উদ্ভিদ বা পাতা কেটে ফেলেন। এক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই সতর্ক হওয়া উচিৎ। কেননা অত্যন্ত উপকারী ও ওষধী গুণসম্পন্ন এই উদ্ভিদের প্রতি যত্নশীল হলে আখেরে লাভ কিন্তু আমাদেরই হবে। তাই আসুন থানকুনি পাতার উদ্ভিদের প্রতি যত্নশীল হই এবং নিজেদের পাশাপাশি পরিবেশেরও উপকার করি।